আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন সুভাষ মল্লিক

আমি এক ভ্রাম্যমান পথিক সুভাষ মল্লিক বর্তমানে একটি পরিচিত নাম। মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ ভ্রমণে গিয়েছেন এমন ব্যক্তি নেই যার সাথে সুভাষ মল্লিকের সাক্ষাৎ হয় না। তিনি একাধারে স্মৃতিসৌধের স্বেচ্ছাশ্রমে নিয়োজিত অবৈতনিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর সাক্ষী, এবং স্মৃতিসৌধের ইতিহাস বর্ণনাকারী। গত কয়েক বছর ধরে ঐতিহ্য-সচেতন বাঙালি পর্যটক ও বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টিতে আসে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, আর এই স্মৃতিসৌধের সাথে জড়িয়ে যায় একটি নাম- সুভাষ মল্লিক। যেকোনো পর্যটক এই স্মৃতিসৌধ ভ্রমণে আসলে এর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যের জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় সুভাষ মল্লিকের বক্তব্যের উপর।

কে এই সুভাষ মল্লিক? দেশ-বিভাগের ক্রান্তিকালে (১৯৪৭-৪৮) মেহেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন সুভাষ মল্লিক। খুলনা সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে ১৯৬৪ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আর্থিক অনটনের দরুন পড়াশোনা ছেড়ে দেন। বাঙ্গালির মুক্তিসংগ্রামের বছর ’৭১-এ ২৩-২৪ বছর বয়স্ক সুভাষ শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হন; ফলে বিপুল আগ্রহ থাকা স্বত্ত্বেও প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। তথাপি, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিরন্তর সহযোগিতা দিয়ে যান। ’৭১-এর ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ মঞ্চ নির্মাণের জন্য যে ক’জন ব্যক্তি বাঁশ, চৌকি, চেয়ার, টেবিল-সহ নানা উপকরণ সরবরাহ করেন তাদের মধ্যে সুভাষও ছিলেন।

সুভাষ মল্লিকের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ১৬ই এপ্রিল রাত জেগে যে ক’জন মানুষ শপথ গ্রহণ মঞ্চ তৈরীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি তাদেরই একজন। সারারাত লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিকেনের আলোয় কাজ করে তারা মঞ্চ তৈরী করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা জাতীয় নেতাদের দেখেছি কাছ থেকে, গর্ববোধ করেছি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করে, এই আমার পরম পাওয়া”। যুদ্ধ শেষ হয়, জাতি স্বাধীন হয়, কিন্তু নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না সুভাষ- কারণ, তিনি যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। পুরোহিতের কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে শপথ গ্রহণের স্থানে এসে সম্মান প্রদর্শন করে যান তিনি।

১৯৮৭-তে এখানে তৈরী হয় কংক্রিটের স্মৃতিসৌধ। ১৯৯৩ সালে পুরোহিতের কাজ ছেড়ে দিয়ে সুভাষ তার দেহমন নিয়োগ করেন স্মৃতিসৌধের সংরক্ষণে। এখন এই সৌধই তার জীবন। সুভাষের পারিবারিক জীবন সুভাষের পিতার নাম অনিল মল্লিক(মৃত)। ঘরে তাঁর স্ত্রী আন্না মল্লিক (৪৯), বিবাহিত কন্যা চিত্রা (৩২), নাতি অর্পণ (১০) ও নাতনি ইতি (৮) আছে, ছেলে সুখন ২৪ বছর আগে মারা গেছে।

বাঁশের ঝাঁপ দিয়ে ঘেরা আর টিনের ছাউনির একচালা দুটি কক্ষের ঘর ছাড়া তার কিছুই নেই। সুভাষের চিন্তা তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী, কন্যা, নাতি, নাতনি এদের কি হবে? সুভাষের কর্ম ’৭১-এর স্মৃতি বিজড়িত মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ বর্তমানের বিচারে একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। প্রতি বছর অনেক পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন। স্মৃতিসৌধের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষা আর এর প্রকৃত ইতিহাস পর্যটকদের সামনে তুলে ধরাই সুভাষের কাজ। অবশ্য এই দায়িত্ব তাকে বাংলাদেশ সরকার বা কোনো স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ দেয় নি।

বাঙ্গালির স্বাধীনতার তীর্থস্থান মুজিবনগরের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও মমত্ববোধে আবদ্ধ হয়ে আর মুক্তিসংগ্রামে নিজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ব্যর্থতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতেই তিনি এই কাজ করছেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো কেনো তিনি এই কাজ করছেন। জবাবে সুভাষ বলেন, “মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না করার বেদনা আজো আমায় কুড়ে কুড়ে খায়, প্রতিদিন এখানে প্রচুর পর্যটক আসে, তাদের কেউ স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস বলে না, ফলে তারা ভ্রান্ত ধারনা নিয়ে ফিরে যায়। তাছাড়া, স্মৃতিসৌধ সর্বদাই অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে, গরু-ছাগল এখানে ঘুরে বেড়ায়, আমি এসব সহ্য করতে পারি না, আমার খুব কষ্ট হয় যখন এমন একটি পবিত্র সৌধ অপবিত্র হয়ে থাকে”। স্মৃতিসৌধ সংরক্ষণে দিনরাত ছুটে বেড়ান সুভাষ।

ঝড়, বৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো কিছুই থামাতে পারে না সুভাষকে। যখনই তরুণ প্রজন্মের কেউ এই সৌধে ঘুরতে আসে সুভাষ নিজ দায়িত্বে তাকে শুনিয়ে দেন বাঙ্গালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস, ’৭১-এর মুজিবনগরের সরকার, এই সৌধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্বন্ধে। স্মৃতিসৌধের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও সুভাষের ধারনা বেশ পরিচ্ছন্ন। তার বক্তব্য শুনলে যে কেউ মনে করবে এই সৌধ বুঝি তারই নিজ হাতে সৃষ্টি। দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি গরগর করে বলতে থাকেনঃ এই যে দেখেন ২৩টি দেয়াল--- এই ২৩টি দেয়ালের সমন্বয়ে বোঝানো হয়েছে উদীয়মান সূর্যরশ্মি যা ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানি শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙ্গালির স্বাধিকার আন্দোলন ও স্ব্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক।

দেয়ালগুলোর প্রথমটির উচ্চতা ৯ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ্য ২০ ফুট। পরবর্তী প্রতিটি দেয়াল ক্রমান্বয়ে দৈর্ঘ্যে ১ ফুট ও উচ্চতায় ৯ ইঞ্চি করে বেড়ে গেছে। শেষ দেয়ালের উচ্চতা ২৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট। প্রতিটি দেয়ালের ফাঁকে অসংখ্য ছিদ্র আছে যেগুলোকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির অত্যাচারের চিহ্ন হিসেবে প্রদর্শন করা হয়। এই দেখেন লাল মঞ্চ--- ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের শপথ গ্রহণের স্থানে ২০ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট প্রশস্থ সিরামিক ইটের তৈরী আয়তকার এই লাল মঞ্চটিকে স্থান দেয়া হয়েছে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের মূল ভিতের মাঝখানে।

এখানে দাঁড়িয়েই অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এই দেখেন ১ লক্ষ বুদ্ধিজীবির খুলি--- স্মৃতিসৌধের ভূতল থেকে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু বেদীতে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত দ্বারা ১ লক্ষ বুদ্ধিজীবির খুলি বোঝানো হয়েছে। এই দেখেন ৩০ লক্ষ শহীদ--- স্মৃতিসৌধের ভূতল থেকে ৩ ফুট উচ্চতার বেদীতে অসংখ্য পাথর দ্বারা ৩০ লক্ষ শহীদ ও মা-বোনের সম্মানের প্রতি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা ও স্মৃতিচারণা প্রকাশ করা হয়েছে। পাথরগুলোর মাঝখানে ১৯টি রেখা দ্বারা তৎকালীন (পূর্ব)বাংলার, যা পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিলো, ১৯টি জেলা বোঝানো হয়েছে। এই দেখেন সাড়ে সাত কোটি ঐক্যবদ্ধ জনতা--- লাল মঞ্চ থেকে যে ২৩টি দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে তার ফাঁকে অসংখ্য নুড়ি-পাথর মোজাইক করা আছে।

এটা সাড়ে সাত কোটি ঐক্যবদ্ধ জনতার প্রতীক। এই দেখেন ১১টি সিঁড়ি--- স্মৃতিসৌধের বেদীতে আরোহণের জন্য ১১টি সিঁড়ি রয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর ও বাঙ্গালির ১১ দফার ভিত্তিতে এই ১১টি সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এই দেখেন ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রতীক--- স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটক থেকে যে রাস্তাটি মূল স্মৃতিসৌধের রক্তের সাগর নামক ঢালকে স্পর্শ করেছে সে-রাস্তাটিকে ভাষা আন্দোলনের বা ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রতীকি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এ রাস্তায় সকল প্রকার যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ।

এই দেখেন বঙ্গোপসাগর--- স্মৃতিসৌধের উত্তর পাশের আমবাগান ঘেঁষা যে স্থানটি মোজাইক করা আছে তার দ্বারা বঙ্গোপসাগর বোঝানো হয়েছে। যদিও বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের দক্ষিণে, তবুও শপথ গ্রহণ মঞ্চটির সাথে স্মৃতিসৌধের সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য এটিকে উত্তরে স্থান দেয়া হয়েছে। এই দেখেন রক্তের সাগর--- পশ্চিম পাশে স্মৃতিসৌধের প্রথম দেয়ালের পাশ দিয়ে শহীদদের রক্তের প্রবাহ বয়ে গেছে যাকে রক্তের সাগর বলা হয়। এভাবেই সব দর্শনার্থীর কাছে গিয়ে এই সৌধ সম্পর্কে বলে বেড়ান সুভাষ। এরই ফাঁকে সৌধ চত্বরে গরু-ছাগল ঢুকলে পর্যটকের কাছে ক্ষমা চেয়ে ছুটে যান পশু তাড়াতে।

গাছ থেকে পাতা পড়লে কিংবা কেউ কিছু ফেলে নোংরা করলে তা ছুটে গিয়ে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেন। এভাবেই মহান পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থেকে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন সুভাষ মল্লিক। সুভাষের আয়ের উৎস স্মৃতিসৌধের সংরক্ষণে সীমাহীন ত্যাগ সুভাষের, অথচ তার কোন আয় নেই। অভাবের সংসার, নুন আনতে পান্তা ফুরায়, পরিবারও অনেক বড়, অর্থাভাবে জর্জরিত সুভাষ। পর্যটকদের কাছে যা পায় তাতেই চলে তার সংসার।

বছর কয়েক আগে আমেরিকা প্রবাসী বঙ্গবন্ধুর খালাত বোন পরিচয়ে একজন তাঁকে খুশি হয়ে ৫০০ টাকা দিয়ে তাঁর পিঠে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। বছর কয়েক আগে শুটিং কাজে গিয়েছিলেন মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী। তিনিও খুশি হয়ে তাঁর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বৈমানিক মতিউর রহমানের স্ত্রী খুশি হয়ে তাঁকে ২০০ টাকা দিয়েছিলেন। সুভাষের স্বপ্নও প্রাপ্তি জীবনে খুব বেশী কিছু পেতে চায় না সুভাষ।

তাঁর নিজের কোনো চাহিদা নেই, আমৃত্যু এ কাজ করে মরতে পারলে শান্তি। তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী, কন্যা, নাতি-নাতনিও যেন এই কাজটি করতে পারে। সে কারণে তাঁদের জন্য কিছু করে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর। কিন্তু কার কাছে বলব, কে দেবে_এই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন! স্থানীয় অনেকে মনে করেন, গণপূর্তের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সুভাষকে মাস্টাররোলে অন্তত চাকরি দিতে পারে। বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম তাঁর কর্মে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে চাকরির আশ্বাস দেন।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে প্রতিমন্ত্রী সুভাষ মল্লিকের চাকরির আবেদনপত্র নিয়েছেন। তবে একটি কথা না বললেই নয়, এযাবৎকাল পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারের সময়ে সুভাষ শুধু আশ্বাসই পেয়েছেন কোন সহায়তা পাননি। আমাদের করণীয় দেশকে ভালবেসে সুভাষের মতো এমন ত্যাগ আমরা কজনই বা করতে পারবো? দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের কি উচিৎ না সুভাষের পাশে দাঁড়ানো? আমাদের কারো একার পক্ষে হয়তো সুভাষের দুঃখ লাঘব করা সম্ভব নয়। তবে আমাদের সামষ্টিক প্রচেষ্টা কি পারে না সুভাষকে একটি সুন্দর জীবন দিতে? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.