প্রবাসী আধুনিক কালের যুদ্ধের গুরুত্বপুর্ন অস্ত্র হল মিসাইল বা ক্ষেপনাস্ত্র। আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র ( Inter Continental Ballistic Missile) বা সংক্ষেপে ICBM হল এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে আঘাত হানতে সক্ষম ৫,৫০০ কিলোমিটার এর বেশী পাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র। উৎক্ষেপন থেকে লক্ষবস্তু পর্যন্ত এর গতিপথ উপবৃত্তাকার হওয়ার ফলে এই ক্ষেপনাস্ত্রকে বলা হচ্ছে “ব্যালিস্টিক”(Ballistic ) । নিরাপত্তা পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্য দেশ, আমেরিকা রাশিয়া,চীন,বৃটেন,ফ্রান্স এর পর এবার ভারত পরীক্ষা চালালো তার প্রথম আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র অগ্নি-৫ এর। আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্রের উদ্দেশ্য হল দুরবর্তী স্থানে পারমানবিক বোমার সাহায্যে আঘাত হানা ।
এখনকার সময়ের ক্ষেপনাস্ত্রগুলো হল multiple independently targetable reentry vehicles (MIRVs), অর্থাৎ তারা অনেকগুলো বোমা নিয়ে গিয়ে একাধিক স্থানে পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করতে সক্ষম । ক্ষেপনাস্ত্রকে ভাগ করা হয়ে থাকে তার পাল্লা অনুযায়ী, স্বল্প পাল্লা, মাঝারি পাল্লা এবং দুরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র হিসেবে। দুরপাল্লার আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র গুলো অত্যন্ত দ্রুতগতি সম্পন্ন, এবং নির্ভুল লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম। ৭০০০ কিলোমিটার দুরেও এর ভুল হয় মাত্র কয়েকশ ফুট ।
ইতিহাস- ক্ষেপনাস্ত্রের প্রথম ব্যবহার হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে।
জার্মানী ১৯৪৪/৪৫ সালে লন্ডনে আঘাত হানে কয়েক হাজার V-1 এবং V-2 ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে শুর হয় আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার। ১৯৬০ সালের দিকে রাশিয়া আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র Atlas এবং D R-7A ,আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র সেনাবাহিনীতে সংযোজন করে। একইভাবে আমেরিকা উদ্ভাবন করে LGM-30, Minuteman, Polaris and Skybolt. প্রভৃতি ক্ষেপনাস্ত্র। ক্ষেপনাস্ত্রের সাথে শুরু হয় ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরোধের উপায় খোজা।
অবস্থা এমন বেগতিক দাঁড়ায় যে ১৯৭০ সালের দিকে এসে সবাই সম্ভাব্য পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র যুদ্ধ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে । সম্ভাব্য এ যুদ্ধের নাম হয় - Mutual Assured Destruction। ১৯৭২ সালে রশিয়া এবং আমেরিকা সাক্ষর করে স্ট্র্যাটেজিক আর্মস কন্ট্রোল ট্রিটি বা SALT-১ । ১৯৮০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রীগান শুরু করেন ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা Strategic Defense Initiative যা তারকা যুদ্ধ নামে খ্যাত।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর ঠান্ডা লড়াই থেমে গেলেও ক্ষেপনাস্ত্র উৎপাদন থেকে থাকে নি।
ক্ষেপনাস্ত্রের সুবিধা- ১) হাজার হাজার মাইল দূর থেকে লক্ষবস্তুতে আঘাত হানা সম্ভব ২) বিমান এবং বৈমানিক শত্রুর গোলার আঘাতে ধ্বংশ প্রাপ্ত হলে লোকক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু ক্ষেপনাস্ত্রে সে ভয় নেই ৩) গোলা এবং মিসাইলের পার্থক্য হল যে ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষিপ্ত হওয়ার পর থেকে আঘাত হানা পর্যন্ত ক্ষেপনাস্ত্রের গতি , দিক প্রভৃতি নিয়ন্ত্রন করা যায়। যে সমস্ত গোলা নিক্ষেপের পর তার উপর আর নিয়ন্ত্রন থাকে না তাকে বলা হয় রকেট। ৪) এরা অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতির, মুহুর্তের মধ্যে গতিপথ পরিবর্তন করে ১৮০ ডিগ্রী পর্যন্ত ঘুরে যেতে পারে। ৫ ) ক্ষেপনাস্ত্রএর নিজস্ব জ্বালানী এবং ইঞ্জিনের ব্যবস্থা থাকে।
আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্রের রয়েছে –১) জ্বালানী বা প্রপেল্যান্ট বাহিত অংশ ।
নির্দ্দিস্ট লক্ষ্যবস্তুতে বয়ে নিয়ে ক্ষেপনাস্ত্রে ব্যাবহৃত হয় রকেট বা জেট ইঞ্জিন । এই ইঞ্জিনে তরল বা কঠিন, উভয় ধরনের জ্বালানী ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষেপন এবং আঘাৎ হানার বিভিন্ন স্তরে আলাদা আলাদা ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়।
২) লক্ষ্যবস্ততে আঘাত হানার নির্দেশনা বা গাইডেন্স সিস্টেম, (Guidance systems ) সঠিক লক্ষে পৌছানোর জন্য ক্ষেপনাস্ত্র বিভিন্ন ধরনের বিকিরন রশ্মি যেমন – ইনফ্রারেড রশ্মি, বেতার তরংগ, লেজার, প্রভৃতির নির্দেশনা ব্যাবহার করে থাকে । লক্ষবস্তুর বিকিরন, ক্ষেপনাস্ত্রের নিজস্ব বিকিরন বা অন্য কোথা থেকে আসা বিকিরনের নির্দেশনায় ক্ষেপনাস্ত্র এগিয়ে যায় লক্ষ্যবস্তুর দিকে।
টেলিভিশন ক্যামেরার ব্যবহার করেও ক্ষেপনাস্ত্রের নিয়ন্ত্রন করা হয়ে থাকে। । ক্যামেরার সেন্সর লক্ষবস্তুর চিত্র পাঠিয়ে দেয় উৎক্ষেপন স্থলে যেখানে অপারেটর অথবা স্ব্যংক্রিয়ভাবে কম্পিউটার সে চিত্রকে বিশ্লেষন করে আঘাৎ হানার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে । Targeting systems পদ্ধতিতে ইনার্শিয়াল নেভিগেশান সিস্টেম(INS) বা গ্লোবাল পজিশানিং সিস্টেম(GPS) ব্যবহার করে মিসাইল এবং লক্ষবস্তুর অবস্থান নির্নয় করে বেতার তরংগ বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির মাধ্যমে ক্ষেপনাস্ত্রের গতিপথ নিয়ন্ত্রন করা হয়ে থাকে।
৩) বিস্ফোরকের অংশ পে লোড( Pay Load) এটি হল মিসাইলের বিস্ফোরক অংশ।
একটি বা অনেকগুলো বোমা বহন করে থাকে । প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ বস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম পারমানবিক বোমা হল, এক একটি ওয়ারহেড( Warhead ) । অনেক গুলো ওয়ারহেড বয়ে নিয়ে গিয়ে পৃথকভাবে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র ।
ক্ষেপনাস্ত্রের গতিপথের রয়েছে তিনটি পর্য্যায় ১) উৎক্ষেপন বা (boost, ৩ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে তা বায়ুমন্ডলে ছাড়িয়ে সেকেন্ডে ৭ কিলোমিটার বেগে উঠে যায় ১৫০ থেকে ৪৫০ কিলোমিটার উপরের Low Earth Orbit।
২) উপবৃত্তাকার পথ বা ballistic,পর্য্যায় হল বায়ুমন্ডলে পুনরায় প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত , এর স্থায়িত্ব আনুমানিক ২৫ মিনিট।
৩) re-entry এই পর্য্যায়ে ১০০ কিলোমিটার উপরে বায়ুমন্ডলে ঢুকে সেকেন্ডে ৪ কিলোমিটার বেগে তা মাত্র দুই মিনিটে আঘাত হানে লক্ষবস্তুতে।
বিভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক কালের আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র-
১) রাশিয়া- ২০১১ সালে সংযোজিত RS-24 হল রাশিয়ার সাম্প্রতিকতম আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র । ১০,৫০০ কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপনাস্ত্র ৪ থেকে ৬টা পর্যন্ত পারমানবিক ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। ৪৭ টন ওজনের এই ক্ষেপনাস্ত্রে পে লোড এর ওজন হল ১। ২ টন।
রাশিয়ার অপর ক্ষেপনাস্ত্র হল RSM-56 Bulava। সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য এই ক্ষেপনাস্ত্র ৮ থেকে ১০হাজার কিলোমিটার দুরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ১০টি পারমানবিক বোমার ওয়ারহেড থাকে এই ক্ষেপনাস্ত্রে।
রাশিয়ার ভ্রাম্যমান আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র Topol.
২)যুক্তরাস্ট্র- প্রধান আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র হল Minuteman III. এই ক্ষেপনাস্ত্রের পাল্লা ১৩,০০০ কিলোমিটার , ওজন প্রায় ৩৫ টন , এবং ১৮। ৫ মিটার লম্বা।
২০২০ সালের পর এর যায়গা নেবে Minuteman -৪ সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য যুক্তরস্ট্রের অপর আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র হল Trident D-5 । ১২ হাজার কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপনাস্ত্র ২। ৮ টন পে লোড বয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম। এই ক্ষেপনাস্ত্রের পরবর্তী সঙ্গস্করন উন্নততর প্রযুক্তির Trident E-6 ২০৩০ সাল নাগাদ যুক্তরাস্ট্রের সেনবাহিনীতে সংযোজিত হবে।
উৎক্ষেপনের পর যুক্তরাস্ট্রের আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র MInuteman-3
চীন- চীনের অস্ত্রভান্ডার অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়।
এ দেশের প্রধান আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র হল DF-5A । ১৩ হাজার কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপনাস্ত্র ৩,২ টন ওজনের পে লোড বয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম। চীনের সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপনাস্ত্র হল JL-2 যা ৮ ০০০ কিলোমিটার পাল্লার এবং একাধিক ওয়ারহেড সংযোজিত।
ফ্রান্স- ৩০০ এর ও বেশী ওয়ারহেড সংবলিত ক্ষেপনাস্ত্রের অধিকারী ফ্রান্সের অবস্থান যুক্তরাস্ট্র, রাশিয়া, এবং চীনের পরেই। ফ্রান্সের সাম্প্রতিকতম ক্ষেপনাস্ত্র হল সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য M-51 ।
৮০০০ কিলোমিটার পাল্লার, ১৩। ৫ মিটার দৈর্ঘের এই ক্ষেপনাস্ত্রের ওজন ৫৩ টন এবং তা ৬টি পারমানবিক ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম।
বৃটেন- বৃটেনের রয়েছে আমেরিকায় তৈরী আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র। কেবলমাত্র সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপনযোগ্য এই ক্ষেপনাস্ত্রের ওয়ারহেড বৃটেন নিজেই তৈরী করে থাকে।
ভারত- গত ১৯ শে এপ্রিল আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র অগ্নি-৫ এর সফল পরীক্ষা চালানোর মধ্য দিয়ে আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র প্রযুক্তির অধিকারী ৬ষ্ঠ দেশ ভারত ।
অগ্নি-৫ ক্ষেপনাস্ত্রের পাল্লা ৫ হাজার কিলোমিটারের বেশী, ১৭ মিটার লম্ব্ ২ মিটার পরিধি, এবং ৫০ টন ওজনের এই ক্ষেপনাস্ত্র ১ টন ওজনের পারমানবিক বোমা বহন করতে সক্ষম।
জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন প্রত্যাশি , উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ভারত তার সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। ইতিমধ্যেই ভারত সর্বাধিক অস্ত্র আমদানী কারক দেশ। অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিজস্ব পারমানবিক শক্তি চালিত ডুবো জাহাজ সংযোজন করছে নৌবাহিনীতে। ১৯৬০ সালে শুরু হয় অগ্নি ক্ষেপনাস্ত্র কর্মসুচী ।
ইতিপুর্বে উদ্ভাবিত অগ্নি -৪ ক্ষেপনাস্ত্র পাকিস্তান এবং চীনের পশ্চিমাংশে আঘাত হানতে সক্ষম ছিল। এই ক্ষেপনাস্ত্র ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সংযোজিত হবে ২০১৪ সাল নাগাদ। সমগ্র এশিয়া মহাদেশ এবং ইউরোপের ৭০% এলাকা এই ক্ষেপনাস্ত্রের পাল্লার অধীন। চীনের প্রধান শহর যেমন বেইজিং , সাংহাই প্রভৃতি শহরে আঘাত হানতে সক্ষম হবে ভারত। ভারতের দাবী এই ক্ষেপনাস্ত্রের উদ্দেশ্য হল শত্রুকে চাপের মধ্যে রাখা বা Deterrence ।
ভারতের ক্ষেপনাস্ত্র- অগ্নি-৫।
ইজরায়েল তার সামরিক তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করে না করলেও সে তার সেনাবাহীনিতে আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র Jericho 3 ইতিমধ্যেই যোগ করেছে।
দক্ষিন আফ্রিকার প্রথম আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র RSA-4 নির্মানের চুড়ান্ত পর্য্যায়ে।
সুত্র- ১) এখানে
২) এখানেও
৩)ekhane
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।