পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ভারতে এখন চলছে বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সামরিক প্রশাসনের দ্বন্দ্ব। আর এই দ্বন্দ্ব উন্মোচিত করেছে এই মুহূর্তে দিল্লিতে বসে ভারত শাসন করা কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের প্রশাসনিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের নানা দুর্বলতা। ভারতের বিখ্যাত ইংরেজি সাময়িকী ইন্ডিয়া টুডে সম্প্রতি এ ব্যাপারে একটি প্রচ্ছদকাহিনি প্রকাশ করেছে। যেখানে উঠে এসেছে সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে সেনাপ্রধানের হঠাত্ নানা ধরনের বিতর্কিত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার বিষয়। যা কুঠারাঘাত করেছে ভারতের ৬৫ বছরের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে, আঘাত করেছে দেশটির প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিমূলে।
ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিং এ বছরের শুরুর দিকে খবরের শিরোনাম হন একটি বিতর্কিত বিষয়ে। তিনি তাঁর জন্মতারিখ পরিবর্তন করে চাকরির মেয়াদ বাড়াতে চেয়েছিলেন। এই অন্যায় কাণ্ড সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে খারিজ হওয়ার পরপরই এই জেনারেল যেন বেসামরিক প্রশাসনের প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠেন। ব্যক্তিস্বার্থে অন্ধ হয়ে ভি কে সিং এমন কিছু কর্মকাণ্ড করে যেতে থাকেন, যাতে ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ হয়ে পড়ে রীতিমতো উপেক্ষার বস্তু।
সেনাপ্রধান ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার ভালো একটি সময়ও বেছে নেন।
তিনি বেছে নেন এমন একটি সময়, যখন ভারতীয় সংসদে চলছে বাজেট অধিবেশন, যখন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা বিশ্বের দ্রুত অগ্রসরমাণ অর্থনীতির দেশ চীন, ব্রাজিল, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও স্বাগতিক ভারতকে নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ের (ব্রিকস) সম্মেলন। গত ২৮ মার্চ প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনির কাছে লেখা এক চিঠিতে সেনাপ্রধান উল্লেখ করেন চীন-সীমান্তে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর অধীনে কাজ করা ‘গোপন’ বাহিনী এসএফএফের বিভিন্ন উপকরণ ক্রয়ে দুর্নীতির কথা। সেখানে তিনি অভিযুক্ত করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল দলবীর সিং সুহাগকে। এই দলবীর সিং সুহাগের ২০১৪ সালে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা। তিনি এই চিঠি লিখে ভারতের জন্য দুটি সমস্যা সৃষ্টি করেছেন।
প্রথম সমস্যাটি হলো তিনি সেই এসএফএফের কথা উল্লেখ করেছেন, যে এসএফএফের কথা রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারত স্বীকার করে না। মূলত চীন-সীমান্তে তিব্বতি গেরিলাদের সহায়তা করার জন্যই সেই এসএফএফ কাজ করে থাকে। তিনি এ কে অ্যান্টনিকে চিঠি লেখার জন্য এমন একটি সময় বেছে নেন, যখন চীনের সরকারপ্রধান ভারত সফরে ছিলেন। তিনি একবারও চিন্তা করেননি, নিজ দেশের সম্মানের কথা।
শুধু তা-ই নয়, এর আগের দিন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে লেখা এক চিঠিতে জেনারেল সিং ভারতের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন।
তিনি প্রতিরক্ষা বিষয়ে বেশ কয়েকটি কারিগরি ত্রুটি ও দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীকে জানান, যেকোনো যুদ্ধপরিস্থিতিতে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি এই মুহূর্তে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে। এ জন্য তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেন। প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে তিনি সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিলেন না?
যে মুহূর্তে জেনারেল ভি কে সিং তাঁর চাকরির মেয়াদ বাড়াতে পারলেন না, ঠিক তখনই তিনি সামনে নিয়ে এলেন এক ঘুষপ্রস্তাবের গল্প। ২০১০ সালে তিনি নাকি লেফটেন্যান্ট জেনারেল তাজিন্দর সিং নামের এক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার কাছ থেকে ১৪ কোটি রুপির ঘুষ প্রস্তাব পেয়েছিলেন। তিনি ব্যাপারটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যান্টনিকে জানিয়েও ছিলেন।
অ্যান্টনির পাল্টা অভিযোগ, এত বড় ঘুষপ্রস্তাব পেয়েও তাজিন্দর সিংয়ের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ধারে-কাছে যাননি ভারতীয় সেনাপ্রধান। অথচ বিভাগীয় কিছু ব্যবস্থা তাজিন্দরের বিরুদ্ধে তো সেনাপ্রধানই নিতে পারতেন।
পুরো ব্যাপারটিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতা। ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, সেনাপ্রধান বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্যারিকেচার শুরু করলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস পর্যন্ত হয়নি কেন্দ্রীয় সরকারের। এটা কি ভারতীয় গণতন্ত্রের একটি প্রাতিষ্ঠানিক পরাজয় নয়? সেনাপ্রধান অবশ্য তাঁর দিক দিয়েও কিছু ব্যাপারে সঠিক।
তিনি ভারতের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে চিঠি লিখেছেন, তার সবই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তিনি সেই চিঠিতে বলেছেন, কেবল আমলাতান্ত্রিক চক্করে পরে ভারতীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলোর ক্রয়প্রক্রিয়া হয় দীর্ঘ। এতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে হয় বিপুল দুর্নীতি। সেনাপ্রধানের এই অভিযোগ কিন্তু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
কিন্তু সেনাপ্রধানের অভিযোগ করারও একটা ক্ষেত্র আছে, পদ্ধতিগত বিষয় তো আছেই।
নিজের স্বার্থের বিপরীতে ঘটনাপ্রবাহ চলে যাওয়ার পরপরই তিনি এসব নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছেন। বিশ্লেষকেরা বলেছেন, তিনি যে পদ্ধতিতে পুরো বিষয়টি নিয়ে খেলেছেন, কোনো শক্ত মেরুদণ্ডের সরকার থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতো, যা অতীতে নেওয়া হয়েছে অনেক ‘বাড়-বাড়ন্ত’ সেনা-কমান্ডারের বিরুদ্ধেই—অনেক দেশেই। ভারতেও অতীতে এমন ব্যবস্থা নেওয়ার ইতিহাস আছে।
এই দ্বন্দ্ব ভাবিয়ে তুলেছে ভারতের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষকে। গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় সেনাপ্রধান সরকারের মুখোমুখি কীভাবে হন, এটাই ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষকে।
বিষয়টি তাঁরা দেখছেন গণতন্ত্রের প্রতি দুই পক্ষেরই একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।