আমি কাল্পনিক তবে অবাস্তব নই, আমি দুঃখকে কল্পনার সুখে রূপান্তর করি...... বেশ অনেকদিন যাবত আমি এক জায়গায়। বিরক্তিকরভাবে পার করছি দিন রাত্রিগুলো। অসহ্য রকমের যন্ত্রণা কাজ করে মনের ভেতর। এই যন্ত্রণা ভরা মনের মাঝেই ভাসতে থাকে মাত্র কয়েকদিনের ব্যাবধানে হয়ে ওঠা স্মৃতিগুলো, যা ছিল বর্তমান। কিন্তু স্মৃতিগুলো কেমন যেন অস্পষ্ট আর ফ্যাঁকাসে।
তবে কি স্মৃতিগুলো আমার সাথে প্রতারনা করছে?
এইতো সেদিনের কথা,
তখনও আমার কাছে কত সুন্দর ছিলম পৃথিবী। শত আনন্দ-বেদনা আর হাসি-কান্নার মাঝেও অদ্ভুত সুন্দর লাগতো পৃথিবীটা। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়ানো, বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর নানান দুষ্টামিতে ভরা দিনগুলো।
কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
মাত্র একটা ডাক্তারি রিপোর্টই বদলে দিল আমার সুন্দর পৃথিবীটাকে।
সবকিছুকে আঁধারে ঢেকে দিল। তবুও আমি হাল ছাড়িনি। আবার পৃথিবীটাকে সুন্দর করে দেখার চেষ্টা করি আমার বাবা-মায়ের চোখ দিয়ে, আমার বন্ধুদের চোখ দিয়ে। কিন্তু বেশিদিন আর দেখা হলোনা। মরন ব্যাধি যার দেহে বাসা বাধে সে আর কতটুকু টিকে থাকতে পারে মনের জোর দিয়ে।
খুব দ্রুতই দুর্বল হয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের সামনে।
ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসতে থাকে সবকিছু। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে মনের শক্তি। একসময় হাল ছেড়ে দেই।
আর এখন হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে যুদ্ধ করছি, জীবন যুদ্ধ।
ক্যানসারের সাথে যুদ্ধের জয় পরাজয়টা এখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। তবে পরাজয় সুনিশ্চিত। অপেক্ষা শুধু সময়ের।
কাছের বন্ধুগুলো সময় অসময়ে ছুটে আসে আমার এখানে। আমাকে বঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।
বাবা-মা বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে বসে থাকে আমার পাশে। আমার বুকটা কেপে কেপে ওঠে। তবু আমি তাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসি। নির্ভয়ের হাসি, আশ্বাসের হাসি, মিথ্যা হাসি। কিন্তু তাদের মুখ থেকে শঙ্কার ছায়া সরেনা।
তাদের দিকে তাকাতে আমার এখন আর ভালো লাগে না। ভীষণ রকম কষ্ট হয়।
কষ্টগুলো ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। তবু কিছুই করার নেই। একদিন হয়ত হঠাৎ করেই থেমে যাবে সবকিছু।
সে অপেক্ষাতেই আছি।
সবারই তো থেমে যাবে কোন একসময়। হয়ত কারো আগে কারো বা পরে। কিছু মানুষ খুব দ্রুতই হাড়িয়ে ফেলে ভালোবাসাগুলোকে। আমিও না হয় আগেই হাড়িয়ে ফেলব।
তারপর কষ্টগুলো একদিন ভীষনভাবে বাড়তে বাড়তেই হঠাৎ থেমে গেল।
অদ্ভুত তো,
এখন আর কোন কষ্টই হচ্ছে না। কিছুক্ষন আগেই দেহের যে অংশগুলো খুব যন্ত্রণা করছিল, এখন তা আর নেই। কিন্তু সবাই কেমন যেন করতে লাগলো। সবাই আমাকে ডাকতে লাগলো।
আমি জবাব দিচ্ছি তা কেও কানেই তুলছে না। সবাই ছুটে চলল ডাক্তারের কাছে অথচ আমি যে চিৎকার করছি, কেও খেয়ালই করল না। ডাক্তার এল, আমার হাত ধরে দেখছে কিন্তু আমার কোন অনুভূতি নেই। আমার হাত থেকে স্যালাইন দেহ থেকে আরও কি কি সব খুলে নিচ্ছে। অন্যসময় হলে ভীষণ ব্যাথা হতো।
আশ্চর্য, এখন কোন ব্যাথাই লাগছে না। সবাই অনেক কান্না করছে আমায় নিয়ে।
আচ্ছা, তাহলে কি আমি মারা গেছি? মারা গেলে কি কোন অনুভূতি থাকে না? হ্যাঁ, তাহলে মনে হয় মারাই গেছি। হসপিটাল পক্ষের সবাই ব্যস্ত হয়ে পরছে আমাকে রিলিজ করে দেবার জন্য।
একটু পরই আমায় নিয়ে যাওয়া হবে বাসায়, তারপর শেষ আশ্রয়স্থল কবরে।
আচ্ছা আমি কি সবার সাথে বাসায় যেতে পারব তো? নাকি শুধু দেহটা যাবে আমি রয়ে যাব এই হসপিটালের কেবিনে?? নাহ, আমার মত আর কাওকে তো দেখছি না। তারমানে আমিও থাকবো না।
আচ্ছা বাসায় গেলে কি আবার আগের মত কম্পিউটারে গেমস খেলতে ইচ্ছে করবে আমার??
ভাইস সিটি, মিশন ২৫, নীড ফর স্পীড আরও কত কি??
আমার যখন খুব মেজাজ খারাপ থাকতো, তখন লং ড্রাইভে বেড়িয়ে পরতাম। নিয়ন্ত্রনহীনভাবে ছুটে চলা আর ক্রমেই বাড়তে থাকা ওয়ারেন্ট। একসময় ওয়াস্টেড হয়ে ফিরে আশা ডেস্কটপে।
মনে হয় খেলতে ইচ্ছে করবে না। কেননা মারা যাবার পর থেকেই অনুভূতিরা হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছে।
আর অনুভূতি যখন চলে যায় তখন সাথে করে ইচ্ছেগুলোকেও নিয়ে যায়।
এখন আমি বাসায়, আমার বাসায়। না, আমার বাসা বলা বোধহয় এখন আর ঠিক হবে না।
তারচেয়ে বরং পৃথিবীর বাসা বলি। বাসা ভর্তি মানুষে। কারো মুখে হাসি নেই। যে রাশেদকে কখনো দুষ্টামি ছাড়া দেখিনি, সেই রাশেদও আজ নির্বাক। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই মৃত্যু পরবর্তী কাজ সম্পাদন করে আমায় নিয়ে যাওয়া হবে শেষ আশ্রয়স্থলে।
বেঁচে থাকতে তো প্রশ্নের উত্তরগুলো মুখস্থ, ঠোটস্থ ছিল। কিন্তু আমাকে যখন মুনকার নাকির প্রশ্ন করবে, আমি কি সঠিক উত্তর দিতে পারব?? জানিনা ভালো খারাপ হিসেবের পাল্লায় কোনদিক ভারি হবে।
মারা গেলে অনুভূতি চলে যায় কিন্তু হঠাৎ কেমন একটা কম্পন অনুভুত হল।
সব কিছু ধুসর আর ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি বুঝতে পারছি আমাকে চলে যেতে হবে অজানায়।
চারিদিক কেমন অন্ধকার হতে শুরু করেছে। সেই আঁধার ভেদ করেই অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে এক বিন্দু উজ্জ্বল আলোর রেখা। যা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তীব্রভাবে। সেই আলোর অদ্ভুত আকর্ষণে আমি ছুটে চলেছি। সবাইকে ছেড়ে, সব ভালোবাসা উপেক্ষা করে।
আমি চলেছি একা, অজানার উদ্দেশে অন্তহীন পথে. . .
এভাবে কি হতে পারে বিদায়?
একটি সুন্দর জীবনের ক্ষয়
কোন এক সময়ের পরাজয়??
উৎসর্গঃ বন্ধু রায়হান
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।