ভূত ধুলো-ধোঁয়া, ব্যস্ততা আর ইট পাথরের অরণ্যজালে বন্দী এই নগরজীবন, যেখানে মানুষে মানুষে যোগাযোগ মানেই এসএমএস আর মুঠোফোন, জীবন মানেই শেয়ার বাজারের সূচক আর সম্পর্ক মানেই কেবল ফর্মালিটিজ এমন পরিবেশে ভালবাসার খোঁজে মানুষের অন্তহীন পথ চলার কাহিনীই অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী করেছেন তাঁর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র "অন্তহীন" এ। ভালবাসার প্রতি আস্থা হারানো পুলিশ অফিসার অভিক চৌধুরী(রাহুল বোস) ভালবাসা খুঁজে বেড়ায় তার ভার্চুয়াল বন্ধু সাংবাদিক বৃন্দা রায়ের(রাধিকা আপ্টে) মাঝে। চোখে না দেখা এই ভালোবাসার জন্য অভিক অনন্তকাল অপেক্ষা করতে রাজী। ওদিকে অভিকের কাজিন রঞ্জন(কল্যাণ রায়) তার স্ত্রী পারমিতার(অপর্ণা সেন) সাথে বিচ্ছেদের বেদনা ভুলতে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় শিভাস রিগাল আর শেয়ার বাজারের সূচকে। মিডিয়ার ব্যস্ত কর্মকর্তা পারমিতা এখনো তাঁর প্রাক্তন স্বামীকে ভালবাসে, কিন্তু কোন এক অদৃশ্য দেয়াল যেন তাদের এক হতে বাধা দিয়ে যায় নিরন্তর।
আবার ব্যস্ত ব্যবসায়ী মেহরার কাছে ভালোবাসা মানে তার স্ত্রীর যত্নে অবহেলা করা ভৃত্ত্যকে ধমকানো। ব্যক্তিভেদে ভালোবাসার অর্থ কতটা বদলে যায় "অন্তহীন" এর অভিক-বৃন্দা, রঞ্জন-পারমিতা, শিল্পপতি মেহরা ও তাঁর বিপর্যন্ত্র স্ত্রী - চরিত্রগুলো তা-ই বর্ণনা করে গেছে।
অন্তহীন ছবিটির কাহিনী এগিয়েছে বেশ ধীর গতিতে। ছবির বাণিজ্যিকীকরণের জন্য পরিচালক কিছু ক্লিশে সীন ব্যবহার করেছেন যা কাহিনীর স্বাভাবিক গতিকে কিছুটা হলেও মন্থর করেছে। বিশেষ করে শর্মিলা ঠাকুরের মণি পিসি চরিত্রটির প্রতি পরিচালক মোটেও সুবিচার করতে পারেন নি।
সব থেকে দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে চলচ্চিত্রে ঘন ঘন রিলায়েন্স, নিহার, পেপসি জাতীয় করপোরেট ব্র্যান্ডগুলোর ক্রমাগত প্রচারণা। রঞ্জন-পারমিতার সম্পর্কটিকে পরিচালক মাঝেমধ্যে মূল কাহিনী থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছেন যা সাধারণ দর্শকদেরও চোখে লাগবে। তবে ছবির এসমস্ত দুর্বলতা ঢাকতে অব্যর্থ ছিল ছবির অপূর্ব সংগীত পরিচালনা এবং ক্যামেরার কাজ। সংগীত পরিচালক শান্তনু মৈত্র তাঁর দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার সুস্পষ্ট ছাপ রেখেছেন ছবির প্রতিটি গান এবং আবহ সংগীতে। সেই সাথে জানালার কাঁচে বৃষ্টির অবিরাম আঘাতের মতো কিছু সামান্য দৃশ্যকেও অসামান্য করে ফুটিয়ে তোলার জন্য সিনেম্যাটোগ্রাফার অভিক মুখার্জী বাহবা পাওয়ার দাবী রাখেন।
মিডিয়ার হাই প্রোফাইল কর্মকর্তার চরিত্রে অপর্ণা সেন ছিলেন দুর্দান্ত। চলচ্চিত্রের পর্দায়(এবং বাস্তব জীবনেও) অপর্ণার স্বামী কল্যাণ রায় নিঃসঙ্গ সূরাসক্ত একজন মধ্যবয়সী কর্পোরেট কর্মকর্তার ভূমিকায় করেছেন অনবদ্য অভিনয়।
২০০৬ সালের ভারতের জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত ছবিটি আমাকে একেবারে হতাশ করে নি। হ্যা, ছবিটির চিত্রনাট্য হয়তো দু'ঘন্টা দর্শকদের আটকে রাখবার মতো নয়, নিসন্দেহে আপনি এটাও বলতে পারেন যে এমন ভালবাসার কাহিনী এর আগেও হাজারখানা হয়েছে তবুও এই চিরাচরিত কাহিনীর মাঝেই অনিরুদ্ধ কিছু কিছু দৃশ্যপট উপহার দিতে পেরেছেন যা চলচ্চিত্রটিকে মনে রাখবার জন্য যথেষ্ট। ভালবাসার জন্য আজন্ম অপেক্ষা এর আগেও হাজারটা ছবিতে দেখানো হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু "অন্তহীন" আরো একবার দর্শকদের মনে করিয়ে দেবে যে ভালবাসা কখনোই পুরনো হয় না, ভালবাসার জন্য অপেক্ষা করাই যায়, অন্তহীন অপেক্ষা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।