বসন্তে মাতাল আমি এক অপূর্ণতা ... সাধারণ সদস্যদের কাছ থেকে সংগৃহীত সঞ্চয় ও শেয়ার মূলধনের পুরোটা জমা পড়েনি ডেসটিনির অ্যাকাউন্টে। সমবায় অধিদপ্তরের বার্ষিক হিসাব নিরীক্ষায় এ অনিয়ম ধরা পড়েছে। বিষয়টি উল্লেখ করে নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলা হয়_ প্রতিষ্ঠানটির সংগৃহিত প্রকৃত সঞ্চয় ও শেয়ার মূলধন স্থিতিপত্রে প্রদর্শিত সঞ্চয় ও শেয়ার মূলধন অপেক্ষা অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অতিরিক্ত অর্থের পরিমাণ কত এবং ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ তা কোথায় কিভাবে গচ্ছিত রেখেছে সে সম্পর্কে প্রতিবেদনে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এ টাকা ডেসটিনির মালিকদের ব্যক্তিগত একাউন্টে জমা পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যথাযথ মনিটরিং না থাকায় আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা বছরের পর বছর ধরে এ অনিয়ম চালিয়ে আসছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডেসটিনি কোম্পানির মালিকপক্ষ ইতোমধ্যেই টাকার পাহাড় বানিয়ে ফেলেছেন। নিজস্ব অ্যাকাউন্টে সিংহভাগ টাকা জমা করেছেন। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামান্য টাকা কোম্পানির অ্যাকাউন্টে রয়েছে। এ অবস্থায় ডেসটিনি বন্ধ ঘোষণা করলেও মালিকপক্ষের কোনো ক্ষতি নেই।
তাই তারা নিজেরাই এখন প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করার পক্ষে কাজ করতে পারে বলে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি। এ অবস্থায় ডেসটিনির বর্তমান কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে এর মালিকদের নজরদারিতে রেখে অধিকতর তদন্তের পরামর্শ দিয়েছেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে জানা গেছে, আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকায় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সিএ (চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস) ফার্ম দিয়ে ডেসটিনির হিসাব বিবরণী নিরীক্ষা করা হয়নি। সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক সর্বশেষ ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানের হিসাব নিরীক্ষিত হয়েছে। এ সময় প্রতিষ্ঠানের শাখাওয়ারী সঞ্চয় আহরণ, শেয়ার মূলধন, আয়, ব্যয় ইত্যাদির কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
একই সঙ্গে ওই অর্থবছরে অনুমোদনবিহীন ব্যয় ২১২ কোটি ৫৫ লাখ ১৬ হাজার ২৬৫ টাকা, সঞ্চয় ও শেয়ারমূলধন আহরণে কমিশন বাবদ ব্যয়কৃত প্রায় ২০০ কোটি টাকাকে স্থিতিপত্রে গবেষণা ও উন্নয়ন ব্যয় খাতে সম্পদ হিসাবে প্রদর্শন; প্রাপ্তি ও প্রদান হিসাবের উদ্বৃত্তের সঙ্গে ট্রায়াল ব্যালান্সের মিল না থাকা এবং সামগ্রিক বিষয়ে নিরীক্ষাকালে ব্যবস্থাপনা কমিটির কোনো সদুত্তর দিতে না পারায় ডেসটিনির স্থিতিপত্রে প্রকৃত আর্থিক অবস্থা প্রতিফলিত হয়নি বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমবায় সমিতি বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির তারল্য ঘাটতি রয়েছে। তারল্য সঙ্কটের কারণে যে কোনো সময় আমানতের টাকা ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে এবং আমানতকারীদের আস্থাহীনতার মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে। এদিকে ডেসটিনির অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম জেনেও সরকারের রহস্যজনক আচরণের সমালোচনা করেছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। আলাপকালে তারা বলেছেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কি উদ্দেশ্যে বিষয়টিকে এতদিন চিঠি চালাচালির পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রেখেছেন সে বিষয়েও অধিকতর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর অবস্থায় পেঁৗছেছে। কেননা এখানে মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ মানুষের কাছ থেকে টাকা এনে বিনিয়োগ করানো হয়েছে। হঠাৎ করে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সরকার যদি বন্ধ করেও দেয় তাহলে এর প্রভাব পুরো সমাজের ওপর পড়বে। তাছাড়া সামাজিক অস্থিতিশীলতাও দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দপ্তর থেকে ডেসটিনির কার্যক্রম সম্পর্কে বিভিন্ন সময় নেচিবাচক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
কোম্পানিটির কার্যক্রম শুরুর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এ ধরনের প্রতিবেদন বা চিঠি চালাচালি করা হলেও অবৈধ কাজগুলো বন্ধ করতে কোনো কার্যকরী উদ্যোগ কখনোই নেয়া হয়নি। এটা অত্যন্ত হতাশার। এ বিষয়ে সরকার এখন কি করবে সেটাও দেখার বিষয়। এ বিষয়ে আরো কয়েকদিন পর মন্তব্য করা যাবে বলে মনে করেন ড. আকবর আলি খান। এদিকে ডেসটিনির অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে স্থানীয় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়।
এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই সংস্থাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়েছে সমবায় অধিদপ্তর। একই সঙ্গে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টকে রেজিস্ট্রার প্রধান করে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি তাদের তদন্ত কাজ শুরু করেছে। অন্যদিকে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি ডেসটিনির আয়কর ফাঁকি তদন্তে জোরেশোরে মাঠে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংশ্লিষ্ট কমিশনারেটগুলো মঙ্গলবার ডেসটিনির বর্তমান ও পুরান আয় বিবরণীর নথিপত্র সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স সেলে (সিআইসি) পাঠিয়েছে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের অডিট, ইন্টিলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সদস্য মো. আলাউদ্দিন বলেন, ইতোমধ্যেই সব কমিশনারেটগুলো ডেসটিনির বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের আয়ের নথি পাঠিয়েছে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে কত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে তা তিনি তৎক্ষণিক জানাতে পারেননি। সমবায় অধিদপ্তর মনে করে সমবায়ের সদস্যদের ঋণ দেয়া, আমানত সংগ্রহ ও শেয়ার বিক্রির বিষয়গুলো তাদের আইনেই রয়েছে। ডেসটিনি এ ক্ষেত্রে কতটা অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে তা জানা নেই সমবায় অধিদপ্তরের।
তবে জানা গেছে, সমবায় অধিদপ্তরের অনেকেই এই ডেসটিনি সংস্থাটির সাথে জড়িত। ডেসটিনির কার্যক্রম সমবায় কর্মকর্তারা প্রতি সপ্তাহে নিরীক্ষা করছে বলে ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ যে দাবি করেছে তা অসত্য বলে জানিয়েছে সমবায় অধিদপ্তর। তবে এ বিষয়ে প্রধান রেজিস্ট্রার গণমাধ্যমকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলছেন। ডেসটিনির এক কর্মকর্তা বলেছেন_আমি এসব বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। আমাদের যিনি বড় সাহেব আছেন তিনি এ মুহূর্তে নেই, মিটিংয়ে ব্যস্ত।
সব তথ্য আপনারা উনার কাছ থেকেই পাবেন। অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার জানান-অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তে মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। সমবায় অধিদপ্তর থেকে একজন অতিরিক্ত নিবন্ধকের নেতৃত্বে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত টিম করা হয়েছে। বিষয়গুলো তারা খুঁটিয়ে দেখবেন।
এখানে কোনো ব্যত্যয় হয়েছে কি-না। এ অনুযায়ী রিপোর্ট প্রাপ্তির পর সরকার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। এদিকে ডেসটিনির অনিয়ম ও দুর্নীতির দায় এখনো অপরের ওপর চাপিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ও মন্ত্রণালয়গুলো। বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার লাইসেন্স নিয়ে পরিচালিত ডেসটিনির কার্যক্রমের আইনি ভিত্তি নিয়ে সংস্থাগুলো এখনো রয়েছে বিভ্রান্তিতে। সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও কাজের পরিধির সীমাবদ্ধতা নিয়ে ডেসটিনি মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অনেকেই জড়িত থাকতে পারে বলেও তাদের অভিযোগ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ইব্রাহিম খালিদ বলেন, এমএলএম কমার্স মিনিস্ট্রির দায়িত্ব। কো-অপারেটিভ হলে সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। আমি তো মনে করি সমবায়ের লাইসেন্স নিয়ে যদি এই সংস্থাটি কাজ চালিয়ে থাকে তাহলে সমবায় অধিদপ্তরও এর সাথে যুক্ত। কেননা, তারা কেন এটাকে সময়মতো উদঘাটন করতে পারলো না? তাদের নীতি কী? তাদেরও কি পয়সা দিয়ে বশ করা হয়েছে কি-না এ বিষয়গুলো কিন্তু তদন্তের মধ্যে আসা উচিত।
নিয়ন্ত্রক যারা আছেন তারা কর্তব্যে অবহেলা করলে অবশ্যই এর দায়-দায়িত্ব তাদেরই বহন করতে হবে। কিন্তু কোনো অবৈধ কাজ কেউ যদি কোনো কাগজপত্রের পারমিশন নিয়েও করে তাকে কখনোই বৈধতা দেয়া যাবে না। যদি কোনো রকম ফাঁক ফোকড় দিয়ে কাগজ তৈরি করে অবৈধভাবে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের নামে কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে হাজার হাজার টাকা আত্মসাতের ঘটনা এটা দুর্নীতির সমতুল্য। এর যদি কোনো অনুমতিও থেকে থাকে তাহলেও তা কোনো অপরাধীকে প্রটেকশন দেবে না। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এর আগেও বাংলাদেশে এ ধরনের মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের আখের গুছিয়ে সটকে পড়েছে।
হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ারও নজির এ দেশে রয়েছে। প্রতারিতরা বিক্ষুব্ধ হয়ে মামলাও করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রতারণার মাধ্যমে ডেসটিনি তাদের অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আরো কঠোর ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালিতেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল।
কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত রহস্যজনক। প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারকেই ম্যানেজ করে তারা তাদের কাজ পরিচালনা করেছে। তবে গণমাধ্যমে যেভাবে বিষয়টি উঠে এসেছে, এরপর সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আরো অনেক মানুষ প্রতারিত হবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, শুধু ডেসনিটি নয়; এরকম আরো কয়েকটি কোম্পানি এমএলএম ব্যবসার নামে নিজেরা টাকা বানিয়ে নিচ্ছে। দৃশ্যত কোনো পণ্য নেই, এরপরও মানুষ বিনিয়োগ করেছে।
অধিক লাভের আশায় মানুষ বোকার মতো বিনিয়োগ করে ঠকলে বলার তো কিছুই থাকে না। এ ধরনের হায় হায় কোম্পানি ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বিনিয়োগের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে নেয়। এ অবস্থায় ডেসটিনির বিরুদ্ধে মামলা করেও কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। সরকারকে অবশ্যই এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে মনে করেন এম এম আকাশ।
সুত্র ঃ হ্যালো-টুডে ডটকম ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।