আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিশুতোষ মহাকর্ষ পাঠ -৩

গ্যালিলিও তার অসাধারণ প্রজ্ঞা ও যৌক্তিক মানসের জন্য ততটা আলোচিত হতে পারেন নি, জ্ঞানচর্চায় ধর্মীয় পুরোহিতদের হস্তক্ষেপের দরুণ তার কারাভোগের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি বিজ্ঞানে তার একক অবদানকে অনেকটা নম্লা করে ফেলেছে। নিউটন স্পষ্ট বাক্যে উচ্চারণ করার আগেই তিনি বস্তুর গতি পরিবর্তনে বলের ভুমিকার কথা আলোচনা করেছেন। দর্শণগত আলোচনায় কোনো বস্তুর গতির পরিবর্তনের মীমাংসার বদলে তিনি পরীক্ষলব্ধ জ্ঞানকেই অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার পিতার গবেষক মানসের কিছুটা তার ভেতরেও সঞ্চারিত হয়েছিলো, তিনি প্রতিটি বিষয়কেই পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। বর্তমানের বৈজ্ঞানিক কর্মপদ্ধতির ধারাবাহিকতা গ্যালিলিও'র সময় থেকে অদ্যাবধি একই রকম রয়ে গেছে।

এরিস্টটল তার পুস্তকে লিখেছিলেন ভারী বস্তু হালকা বস্তুর তুলনায় দ্রুত ভুমিতে পতিত হবে। এটা পর্যবেক্ষণ লব্ধ জ্ঞান, গ্যালিলিও আগে কেউ যৌক্তিক ভাবে এই পর্যবেক্ষণ লব্ধ জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন নি। যেহেতু তখনও নিউটনের গতিসূত্রগুলো লিপিবদ্ধ হয় নি( নিউটন জন্মগ্রহন করেছিলেন গ্যালিলিওর ঠিক ১০০ বছর পরে) সুতরাং গ্যালিলিও একটি যৌক্তিক দ্বন্দ্ব তৈরি করলেন, তিনি বললেন ধরা যাক ভারী বস্তু হালকা বস্তুর চেয়ে দ্রুত পতিত হয়, এখন যদি আমরা একটা ভারী বস্তুকে একটি হালকা বস্তুর সাথে বেধে দেই, তাহলে তার পতনের পরিণতি কি হবে? প্রথম যুক্তি বলছে ভারী বস্তু যেহেতু হালকা বস্তুর তুলনায় দ্রুত মাটিতে পরবে, সুতরাং একসাথে বাধা থাকবার দরুণ হালকা বস্তুটি ভারী বস্তুকে পেছনে টেনে রাখবে, ফলে ভারি বস্তুটি একক ভাবে যতটা দ্রুত মাটিতে পরতো তার চেয়ে ধীরে মাটিতে পরবে- দ্বিতীয় যুক্তি বলছে যেহেতু আমরা দুটো বস্তুকে একই সাথে বেধেছি, ফলে তাদের সর্বমোট ভর বেড়ে যাবে, ফলে তারা আগের তুলনায় দ্রুত মাটিতে পরবে- শুধুমাত্র দর্শণের উপর নির্ভর করে এ বিষয়ে কোনো মীমাংসা সম্ভব নয়। তিনি ঘোষণা করলেন যদি বাতাসের বাধা না থাকে তাহলে হালকা বস্তু এবং ভারী বস্তুকে একই উচ্চতা থেকে ছাড়া হলে তারা উভয়েই একই সময়ে মাটিতে পরবে। কোনো পড়ন্ত বস্তুর গতি পরিবর্তনের সূত্রগুলো গ্যালিলিও লিপিবদ্ধ করেছিলেন, পড়ন্ত বস্তুর গতির সূত্রগুলোর মূল বক্তব্য কোনো বাধার অনুপস্থিতিতে সকল বস্তুই একই সময়ে একই গতিবেগ অর্জন করবে।

বস্তুর ওজন তার গতির মাণকে পরিবর্তিত করে না। ১৯০৮ সালে আইন্সটাইন পুনরায় এ সমস্যা নিয়ে ভাবা শুরু করেছিলেন। তিনি গ্যালিলিওর বক্তব্যের সামান্য সাধারণীকরণ করলেন। ৪০০ বছর আগে গ্যালিলিও বলেছিলেন মুক্তভারে পড়ন্ত সকল বস্তু একই সময়ে একই দুরত্ব অতিক্রম করে। আইন্সটাইনের প্রিন্সিপল ওফ ইকুইভ্যালেন্স মোটামুটি এ বক্তব্যই প্রকাশ করে।

একই সাথে আইন্সটাইন তার থট এক্সপেরিমেন্টগুলোর সাহায্য গ্যালিলিওর ধারাবাহিকতা মেনেই প্রমাণ করতে পারলেন যেকোনো বদ্ধ ঘরে মুক্ত ভাবে পড়ন্ত কোনো বস্তু অন্য কোনো বলের প্রভাবে গতিশীল না কি মহাকর্ষের কারণে গতিশীল এটা নির্ধারণ করা সম্ভব না। উভয় ক্ষেত্রেই পর্যবেক্ষণের চরিত্র একই হবে- অতীতে মহাকর্ষ বল এবং সাধারণ বলের ভেতরে এক ধরণের কষ্টকল্পিত ব্যবধান ছিলো, আইনস্টাইন এই ব্যবধানটুকু মুছে দিলেন। পরবর্তীতে ১৯১৬ সালে( যদিও তার আগেই গণিতবিদ হিলবার্ট এ সমস্যাটির সমাধান করেছিলেন) আইনস্টাইন তার সাধারণ মহাকর্ষ তত্ত্ব প্রকাশ করলেন। মহাকর্ষ তত্ত্ব বুধের কক্ষপথের ধীর ঘূর্ণনকে সাফল্যের সাথে ব্যাখ্যা করলো, আইনস্টাইনের মহাকর্ষতত্ত্বে বলা হলো মহাকর্ষ বলের প্রভাবে এমন কি আলোর গতিপথও পরিবর্তিত হবে। ১৯২২ সালে( সম্ভবত) ব্রাজিলে এডিংটন সুর্যগ্রহণের সময়ে আলোর গতিপথের পরিবর্তন পরিমাপ করে বললেন আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্ব সঠিক, মহাকর্ষের প্রভাবে সত্যি সত্যিই আলোর গতিপথ পরিবর্তিত হয়।

পরবর্তীতে কেউ কেউ বলেছেন এডিংটন মহাকর্ষ তত্ত্বের সৈন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে সেটাকে সঠিক প্রমাণের জন্য কিছুটা ছলচাতুরি করেছিলেন। আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বের মাহত্ব্য তাতে ক্ষুন্ন হয় নি, বরং পরবর্তীতে আরও সুক্ষ্ণ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে আইনস্টাইনের তত্ত্ব মোটামুটি সকল বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণই সমর্থন করে। কয়েক দিন আগে সুইজারল্যান্ডের সার্নের পরীক্ষাগারের বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ আইনস্টাইনের একটি অনুস্বীকার্যকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছিলো, পরে নিশ্চিত হওয়া গেলো আসলে বিষয়টি ঘটেছিলো পরীক্ষণের ত্রুটির কারণে- পৃথিবীতে আলোর চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন কোনো কণিকার অস্তিত্ব নেই। ১৯১৭ সালেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক শোয়ার্সচাইল্ড আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বের একটি সমীকরণ সমাধান করে সিদ্ধান্ত জানালেন ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব সম্ভবপর। ১৯২৪ সালে ফ্রিডম্যান আইনস্টাইনের সমীকরণ সমাধান করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল, আইনস্টাইন তার এই সমাধানকে স্বীকৃতি দেন নি।

পরবর্তীতে ১৯২৯ সালে হাবল যখন প্রমাণ করলে দুরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো অধিকাংশই পৃথিবী থেকে দুরে সরে যাচ্ছে তখন আইনস্টাইন মেনে নিলেন মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল। তার আগ পর্যন্ত তিনি কসমোলজিক্যাল ধ্রুবক এনে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বকে স্থিতিশীল করার নানাবিধ প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহন করেছিলেন। সে সময়েই এডিংটনের ছাত্র হিসেবে ইংল্যান্ডে আসছিলেন চন্দ্রশেখর। অতিরিক্ত ভারী নক্ষত্র নিজের ভরের মহাকর্ষীয় আকর্ষণে কেন্দ্রে পতিত হবে, ফলে ব্ল্যাকহোলের উদ্ভব ঘটবে- এই সীমাস্থ মাণটি নির্ধারণ করবে পাউলির বর্জন সূত্র- নক্ষত্রের মতো এত ভারী বস্তুর মহাকর্ষীয় সংকোচনের সীমাস্ত মাণ নির্ধারণ করবে পাউলির বর্জন সূত্র এডিংটন প্রাথমিক ভাবে এ অনুসিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। পরবর্তীতে জানা গেলো চন্দ্রশেখরের অনুমাণ সঠিক।

সূর্যের চেয়ে মোটামুটি দেড়গুণ ভারী নক্ষত্র একটা পর্যায়ে নিজের মহাকর্ষীয় আকর্ষণে সংকুচিত হয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে। ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ন নি:সংশয়ে প্রমাণিত হয় নি, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে যখন এস্ট্রোনমি, মাহকর্ষ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক আগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলো তখন কোনো কোনো গবেষক নিউট্রন স্টারের অস্তিত্বের কথা বললেন। নিউট্রন স্টার নক্ষত্রের একটা পর্যায়- যে পর্যায়ে জ্বালানি নি:শেষ হওয়া নক্ষত্র নিজের কেন্দ্রে পতিত হয়ে একটি বিশালাকার নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। নক্ষত্র নিজ অক্ষে ঘুর্ণায়মান। একটি ঘুর্ননশীল বস্তুর ঘুর্ণন গতিবেগের বর্গ এবং এর ব্যাসার্ধের গুণফল একটি ধ্রুবক।

যখন নক্ষত্র নিজের কেন্দ্রের দিকে পতিত হওয়ার সময় একটি নিউক্লিয়াসে পরিণত হচ্ছে তখন এর ব্যাসার্ধ কমে যাচ্ছে- অনুমান করা হয় একটি নিউট্রন স্টারের ব্যাসার্ধ আনুমাণিক কয়েক শত কিলোমিটার। ফলে এর ঘুর্ণনবেগ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। এক ঘন মিটার নিউক্লিয়াসের ভর এক মিলিয়ন বিলিয়ন কেজি। এটা নিউক্লিয়াসের গড় ঘনত্ব- কোনো ভারী বস্তুর মহাকর্ষীয় বলের পরিমান নির্ধারণ করে এর গড় ঘনত্ব এবং এর ব্যাসার্ধের গুণফল। একটি নিউট্রন স্টারের ব্যাসার্ধ যতই হোক না কেনো এর পৃষ্টভাগে কোনো বস্তু মহাকর্ষীয় আকর্ষণে নিউট্রন স্টারের সাথে আটকে থাকবে কি না সেটা নির্ধারণ করে নিউট্রন স্টারের ঘুর্ণনবেগ।

সামান্য অঙ্ক কষে প্রমাণ করা সম্ভব এই সীমাস্থ মাণটি বলছে কোনো নিউট্রন স্টার তার অক্ষে প্রতি সেকেন্ডে ৮১ বারের বেশি ঘুরতে পারবে না। নিউট্রন স্টারের ক্ষেত্রে তার ঘুর্ণন বেগ এই সংখ্যা দ্বারাই সীমাবদ্ধ। এটার অর্থ প্রতি ১২.৩ মিলি সেকেন্ডে নিউট্রন স্টারটি নিজের অক্ষে একবার ঘুরে আসবে। মিলিসেকেন্ড পালসারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে ১৯৬৮ সালেই। নির্ধারিত সময় পর পর এই পালসারগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণের তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকীরণ করে।

এই বিকীরণ যদি পৃথিবীর অক্ষের সাথে সমান্তরাল হয় তবেই পৃথিবী থেকে এটা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। মহাবিশ্বের নক্ষত্রের প্রাচুর্যতায় সম্ভবনা অতিক্ষীণ হলেও এমন অসংখ্য পালসারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে। পালসারের ঘুর্ণনবেগ, বিকীরিত তরঙ্গশক্তির পরিমাণ থেকে পালসার( নিউট্রন স্টার) এর ভর অনুমাণ করা সম্ভব। এ বিষয়ে এখনও গবেষণা অব্যাহত। এইসব নিউট্রন স্টারের পরিণতি কি হতে পারে এ বিষয়ে তেমন কোনো মীমাংসায় উপনীত হন নি বৈজ্ঞানিকগণ।

তবে বলা হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে এই নিউট্রন স্টারগুলোর ঘুর্ণনগতি হ্রাস পাবে, একটা সময়ে এগুলো স্থির হয়ে যাবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।