কোনটা আমি? এই যে সবাই আমার আমার করছে, এটাই কি আমি? নাকি এটা আমার খোলস, খেলনা কিংবা আমার প্রতিবিম্ব কি ছায়া। এমনও তো হতে পারে এটা আমিতো নয়ই বরং আমারই ভিলেন হয়ে আমার সঙ্গে সার্বণিক আঠার মত লেপটে আছে এবং চালাকি ভরা ইন্দ্রজালে আমাকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে নিয়ে আমারই অজান্তে আমার বিপক্ষে কর্ম করে চলছে। আর আমি তাকে আপন ভেবে পুষছি, যেন দুধ কলা দিয়ে পুষছি সাপ, যে সাপ ছোবল দেয়ার মৌকা খুঁজে বেড়াচ্ছে, তক্কে তক্কে রয়েছে, ফনাটি লুকিয়ে খেলা আর নাচনে দেহটা দুলিয়ে দুলিয়ে আমাকে বশ করে রেখেছে, আমিও খেলা দেখছি, খেলছি সাপুড়ে হয়ে, মুখ ফুলিয়ে বাজাচ্ছি বেদে-বাঁশী।
আমি কি তাকিয়ে থেকে আমার দিকে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখি, তাঁকে চিনি কি না! চিনি কিংবা চিনি না, তবে কেন অচেনা মনে হয় এবং অসহায়। তাহলে এ কে রে বাবা! প্রাণের সঙ্গে লেপ্টে আছে জীবনের মত, যেন আমি তাকে চিনি, যেন একই সঙ্গে মেসে থাকি একই বিছানায়।
আমি রোজ ভোরে উঠি। অথবা বেলা করে কখনো কখনো। প্রায়শঃ কাজা নামাজ পড়ি। নামাজ শেষে সারাদিনের জন্য ঐ তাঁর কাছে প্রার্থনা করি যিনি আমাকে এ ধরায় এনেছেন। কখনো কখনো হাঁটতে যাই, ফ্রি হেন্ড ব্যায়াম করি।
প্রচুর সাবান মেখে গোসল করি। তাঁর আগে ব্রাশে ঝাঁঝালো মাজন নিয়ে ফেনা তুলে দাত ঘষে আয়নায় বাঁদর-ভেংচি কেটে দাঁতের ঘিয়া সাদা কতটুকু সাদা করা গেল তা চোখ ঢেলে দেখি। খাই-দাই, পড়ি-লিখি, ঘুমাই, রাগ-অভিমান করি, ধমকাই, ধমক খাই, ভয়ে মুসড়ে যাই, নতুন দিনের লোভে সড়াৎ করে বিছানা থেকে উঠি। নতুন একটা কিছু লেখার ভাবনা নিয়ে রাতা মোরগের মত পা উঠিয়ে হাই তুলি, তুলি নিয়ে হিজিবিজি ছবি আঁকি, ভাবি, ভাবনার বেলুনে উড়ে যাই বহুদূর বানকুড়ানী বাতাস পেয়ে , তারপর আমার মনের ঘুড়িটিকে আমিই আমার আকাশে আর দেখিনা, শেষে সন্ধ্যা হলে, চারপাশ কালো হয়ে গেলে নাটাই দ্রুত চালিয়ে যেমন ঘুড়ি-বালক তার ঘুড়ি নামিয়ে কাঁধে করে বাড়ি ফিরে, আমিও তেমনি আমাকে নামিয়ে আনি আমারই আঙ্গিনায়। অদ্ভুত, তবু আমি বারবার ভাবি এই আমি যাকে নামিয়ে আনলাম সে কি একান্ত আমি! না ভিন্ন কোন আমি
ফিরে আসে আমার আমিকে ফেলে, বারবার।
আমি যে ব্যাথা পাই, তা কি প্রকৃত আমি পাই না আমার ভেতরের আমিটা পেয়ে আমার বৈঠক ঘরে ট্রলিতে করে চা বিস্কুট পাঠাবার মত আমার কাছে ব্যাথা চালান করে দেয়। নিত্য আমার যে সব অসুখ বিসুখ কি যৎসামান্য সুখ হয়, তা কি আমি ভোগ করি? না আমার আমি ইঁদুরের গর্তে ইঁদুর যেভাবে জড়ো করে শস্য দানা তেমনি জড়ো করে ফেলে রেখে যায় আমার কাছে কিছু প্রাত্যহিক খাবার অথবা উপস্থিত করে আমার জেরক্স কপি?
কম্পিউটারের ডেক্সটপে মেটার বিহীন আইকনের মত আমি কি নকল অলংকারে জ্বলজ্বল করি, মানুষ দেখে আমাকে ভেবে এই নকল আমাকে সালাম দেয়, বলে- কি, কেমন আছেন? আমি বলি - ভাল। কিংবা বলি- শ্বাসের অসুখটা বেড়েছে। তা কি আমি আমাকে জিজ্ঞাসা করে বলি? নাকি শিখানো বুলির মত সেইভ কাউন্টার থেকে পুর্ব বিছানো পদবাচ্য দিয়ে উত্তরের কাজ সারি।
আমি কি আমাকে চিনি? চিনেছি? চিনতে চেষ্টা করেছি? খুঁজি? খুঁজেছি? খুঁজে পেয়েছি? কিংবা পাবো অথবা খুঁজে লাভ নেই, পাবোনা।
আর পাবোনা বলেই ভাবিনা। ভাবা কিংবা না ভাবার কারণ নিয়েও কি আমি ভাবি? এই যে উপরে উপরে থেকে আমি আমাকে নিয়ে লিখছি, তাও কি আমার ভিতর থেকে নাকি ছাদের উপরে আমার পোষাক শুকাতে দিয়ে, সে পোষাক দেখিয়ে বলছি যে- দেখুন এই তো আমি, আমিই আমার কথা বলছি, অন্য কেউ নয়, বিশ্বাস করুন এটা আমারই নাম, বাব-দাদা এ নামেই আমাকে ডাকতো, পাড়ার বন্ধুদের কাছেও আমি এ নামে পরিচিত, এটাই আমার আকার-বিকার-গন্ধ-চোখ-নাক, নাকের শ্লেষা, মুখের হা, মুখের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসা ফসফরাসের গন্ধমাখা শ্বাস। এসবই আমি, এ সবই আমার।
কিন্তু এত করে বলেও আমার সন্দেহ যে যায় না, তাই তো আমি এ কথা বলতে চাই। বলতে চাই তাকে, আমাকে এখন যিনি এসএমএস পাঠিয়েছেন।
আমার ভিতরে যে প্রকৃত আমি কলের পুতুলের মত ‘আমাকে’ নাড়ায়- চাড়ায়, আঙ্গুল মেলে দেয়, পায়ের পাতার নিচে দাঁড়ানোর খুঁটি দিয়ে যায়, ভাবায় কাঁদায়, সেই আমি কে আমার ভেতরের আলো ফেলে খুঁজি কি আমি! নাকি খুঁজি না, নাকি কি শুধু 'অন্তিম শয়ানে তার সনে' আমার দেখা হবে। কেমন করে দেখা হবে? যেমন রেললাইনের জোড়া পাত মিশে যায়, ধারাপাতে মিলে গিয়ে শুন্য হয় গরল সরলের ফল, তেমনি?
ঠিক এভাবে অথবা অন্য কোন ভাবে আমার আমিকে খুঁজে পেতে হবে। নিরব হয়ে, নিশ্চুপ শান্ত হয়ে, একদম সুনসান-পরিপুষ্ট-পরিপক্ক-নিখাদ-নিসংশয়-নিরাভরণ-পরিতৃপ্ত, আর না কিছু চাইবার, না কিছু পাবার অবস্থায় গিয়ে আমাকে আমি পাব যেমত, সেমত আমার আবিষ্কারের জন্য কি রকম ধ্যান, মৌনতা ও মুদিত চোখ দরকার তা আমার জানা নেই। এ কথা নিশংকোচে স্বীকার করি আজ আমি এবং অতএব, আমার আমাকে দেখে আমার উপর মায়া, রাগ-অভিমান কিংবা ক্ষোভ দিয়ে যারা মূল্যায়নের কাঁটা কি মালা দিতে চান আমাকে, তাদেরও ভাবা উচিত তারা তাদের ‘আমি’ দিয়ে আমার আমিকে দেখার ও বুঝার মুদ্রা জানেন কিনা? নাকি সর্বোত ভাবে তা কেবল খোলসে খোলসে খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
দুই
এ আমার বিকার নয়।
কিংবা বিকার হলেও আমাকে উগলে দেবার সততা ও সরলতা মাখানো একটি রহস্য প্রস্তাবনা। অনেক আগে আমারই মত করে অথবা অন্য রকম ভাবে অনেকেই বলেছেন, ভবিষ্যতে বলবেন, বলতে হবে।
আমার কথাটি তাচ্ছিল্য সমেত পুরানো কাগজের মত ডাস্টবিনে ফেলে দেবার আগে ভাবুন একবার শিশুদের দিকে। যে শিশু তার পিতা কিংবা মাতার কাছে জিজ্ঞাসা করে- ওটা কি? আমি এভাবেই কোন বিষয়-আশয়, বস্তু-পরাবস্তুর প্রতি আঙ্গুল তুলে জানতে চাই? শিশুর জিজ্ঞাসা, শিশুর জানতে চাওয়ার মত নিখাদ ও কৃত্রিমতাহীন, আমার এ জানতে চাওয়া, এটা কোন রকমের উদ্দেশ্য প্রবণতার শৃংখলে বাঁধা, ধান্দা, স্বার্থ, পাবার তাড়না, হারাবার ভয়, সঙ্কা ও সন্দেহ ভরা নয়।
শিশু- সারল্য ভরা স্বার্থহীন জিজ্ঞাসা, অফুরন্ত বেহেশতি চেতনায় দেখা, শোনা এবং অবশ্যই নির্দোষ ও একান্ত সম্ভাষণের মায়া ভরা হাসি দেখে আমার সন্দেহ বাড়া কি স্বাভাবিক নয় যে, আমার হাসি প্রকৃত হাসি নয়।
আমার হাসিতে কত মুখোসের নির্যাস, কত সামাজিকতা, রাজনীতি ও সুশীলতার স্বার্থমাখা প্রলেপের বিন্যাস। তাহলে নিশ্চই শিশুর ভূবন-ভাবনা ও এমনি ধারার যা কিছু শিশুর কাছে দেখি তা আমার জন্য কল্পনা করাও কঠিন। অতএব ‘আমি’ কে আমার শিশুর মত করে তুলতে আমার প্রচেষ্টা আজ কতদুর এগিয়ে নেয়া যাবে কিংবা যাবে কিনা এবং তা কিভাবে নেয়া যাবে এই ভাবনা ও তাড়নার পাখা মেলে দেবার ইচ্ছাবোধ এ প্রস্তাবনায় মেখে দিয়ে আমি বিস্তার করি আমার অক্ষমতা ও আমার আমি সমন্ধে বিন্যাস করি আমার ধারণা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।