আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিশুতোষ মহাকর্ষ পাঠ -১

চাঁদ পৃথিবী থেকে প্রায় ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার মাইল দুরে প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে, পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যকার মহাকর্ষ বল চাঁদকে এই কক্ষপথে আটকে রেখেছে, সেই চাঁদের মহাকর্ষীয় আকর্ষণে পৃথিবীতে প্রতিদিন দুইবার জোয়ার ভাটা হয়- বিজ্ঞানের অগ্রগতির কল্যানে ৩২৫ বছর আগে নিউটনের সার্বজনীন মহাকর্ষীয় তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার পর এখন এই বিষয়টি সাধারণ জ্ঞানে পরিণত হয়েছে, বুঝে কিংবা না বুঝে আমরা এই বিষয়টি উচ্চারণ করতে পারি। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যেকোনো জ্ঞানের এমন সাধারণীকরণ এক ধরণের বিভ্রান্তি তৈরি করে, হয়তো পরিচিত বিষয়ের এমন গাণিতিক-শাব্দিক ব্যাখ্যার পর এর অন্তর্নিহিত জটিলতাগুলো নিয়ে মানুষ তেমন করে ভাবতে চায় না। নিউটনের সার্বজনীন মহাকর্ষ বলের বিবৃতিতে বলা হয়েছে পৃথিবীর সকল বস্তুকণা সকল বস্তুকণাকে পরস্পরের দিকে আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণ বল বস্তুকণাদুটোর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং এদের মধ্যকার দুরত্বের ব্যস্তানুপাতিক। মহাকর্ষীয় বল পরস্পরকে আকর্ষণ করে, সুতরাং মহাকর্ষীয় বলের প্রভাবে তেমন কোনো সাম্যাবস্থা তৈরি করা অসম্ভব। যেকোনো ভারী বস্তু অন্য একটি ভারী বস্তুর আকর্ষণে বস্তু দুটোর ভরকেন্দ্রের সংযোজক সরলরেখা বরাবর পরস্পরের দিকে এগিয়ে যাবে- এটাই নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্রের ভাষ্য- যদিও মহাকর্ষীয় বলের মাধ্যমে দুটো বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে কিন্তু এই দুটো বস্তুর সংযোজক সরল রেখা বরাবর এমন একটা বিন্দু পাওয়া সম্ভব যেখানে বস্তুকণাদুটোর পরস্পরের আকর্ষণ বলের মাণ সমান।

এই বিন্দুতে কোনো বস্তুকে স্থাপন করলে সেটা চাঁদের এবং পৃথিবীর আকর্ষণের মিলিত প্রভাবে সেখানেই স্থির থাকবে। জুলভার্নের "ফ্রম আর্থ টু দ্যা মুন" বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে এই বিন্দুর বর্ণনা আছে- চাঁদ এবং পৃথিবী পরস্পরকে প্রদিক্ষণ করছে এবং এই সংযোজক সরলরেখা কখনও পরিবর্তিত হচ্ছে না বলে এই বিন্দুটিতে সব সময়ই আকর্ষণ বলের সমতা থাকবে, আমরা এখানে যেকোনো তিনটি গ্রহকে বিবেচনা করলে পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে? এমন সজ্জ্বার জন্য কি কোনো বিন্দু খুঁজে পাওয়া সম্ভব সেখানে এই তিনটি গ্রহের পারস্পরিক আকর্ষণ বল পরস্পরকে নাকচ করে দিবে? জ্যামিতিক ভাবে ভরকেন্দ্র এবং ভরের পরিমাণ বিবেচনা করে এমন বিন্দু হয়তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব, তাত্ত্বিক ভাবে এমন বিন্দু খুঁজে পাওয়া সম্ভব হলেও সে বিন্দুটা একেবারে স্থির কোনো বিন্দু হবে এমনটা নিশ্চিত বলা কঠিন। এমন ভাবে ৪টি-৫টি-৬টি, অসংখ্য বস্তুকণা দিয়ে এমন বিন্দুর অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব কিন্তু এই গাণিতিক সাম্যাবস্থা কি আদৌ বজায় থাকবে? ২০০ বছর আগেই এমন সম্ভবনা নাকচ করে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। নিউটন তার স্থির মহাবিশ্বের ধারণায় এমন একটি পরিস্থিতি কল্পনা করেছিলেন, তিনি মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বলে যে মহাবিশ্বের স্থিরতার প্রতি এক ধরণের হুমকি এমন সংশয়ের উত্তরে বলেছিলেন- যদি অসীম সংখ্যক বস্তুকণা ছড়িয়ে থাকে মহাবিশ্ব জুড়ে তাহলে তাদের পারস্পরিক আকর্ষণ বল পরস্পরকে নাকচ করে এক ধরণের সাম্যাবস্থা তৈরি করবে,ফলে মহাবিশ্ব একটি বিন্দুতে ভেঙেচুড়ে মিলিয়ে যাবে না। নিউটনের প্রস্তাবিত "ইউনিভার্সাল কোলাপস" নিয়ন্ত্রনকারী ধারণাটি যে ভ্রান্ত তা পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে।

হয়তো কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে এমন একটি সাম্যাবস্থা কল্পনা করা সম্ভব কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে আদতে সকল বস্তুকণাই একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকেই পতিত হবে। প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর বয়সী মহাবিশ্ব এমন কোনো প্রবনতা এখন প্রকাশ করে নি, এখন প্রতিটি গ্যালাক্সি পরস্পর থেকে দুরে সরে যাচ্ছে। ব্যতিক্রম এন্ড্রোমিন্ডা নক্ষত্রপূঞ্জ, সে নক্ষত্রপূঞ্জ মিল্কিওয়ের দিকে ছুটে আসছে, হয়তো ভবিষ্যতে কোনো একসময় এই নক্ষত্রপূঞ্জ মিল্কিওয়ের সাথে মিলিত হবে। বিশাল একটি মহাকর্ষীয় সংঘর্ষ হবে সে সময়। চাঁদ এবং পৃথিবীর মধ্যকার দুরত্ব প্রায় ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার মাইল- এই দুরত্ব অতিক্রম করতে আলোরও ২ সেকেন্ডের বেশী সময় লাগে- এত দুরের চাঁদের আকর্ষণে পৃথিবীতে দুই বার জোয়ারভাটা হলেও আমরা যখন কোনো চেয়ারে বসছি তখন আমরা চেয়ারের সাথে আটকে থাকছি না, যদিও আমাদের দুজনের ভর আছে, এবং আমাদের মধ্যকার দুরত্ব চাঁদ এবং পৃথিবীর দুরত্বের চেয়ে অনেক অনেক কম।

আমরা যখন কোনো বড় দালানের সামনে দিয়ে হাঁটছে তখন সে দালানের মহাকর্ষীয় আকর্ষণে আমরা সে দালানের দেয়ালে আটকে যাচ্ছি না। আমাদের বড় বড় ট্রাকগুলোও দিব্যি পৃথিবীর রাস্তায় চলাচল করছে- কোথাও তেমন স্থবিরতা নেই। এর কারণটা কি? মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মাণ অনেক অনেক কম বলে স্বল্প দুরত্বেও মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বলের পরিমাণ অনেক কম, আকর্ষণ বলের পরিমাণ অনেক অনেক কম হতে পারে কিন্তু যখন আমরা কোনো চেয়ারে বসছি তখন চেয়ার এবং আমার মধ্যকার দুরত্বও প্রায় শূণ্যের কাছাকাছি, মহাকর্ষীয় বলের প্রাবাল্য তখন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা, কিন্তু এরপরও আমরা চেয়ারের সাথে আটকে থাকছি না কেনো? শুধুমাত্র মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মাণের স্বল্পতা এই কারণটা ব্যাখ্যা করতে পারে না। বিজ্ঞান চারপাশের ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্ন অনুমাণ করে, সেসব অনুমাণের কোনো কোনোটি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়, কোনো কোনো অনুমাণ গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তার ব্যাখ্যাযোগ্যতা সীমিত হয়ে যায়। সকল পরিস্থিতিতে সে অনুমাণ ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধ শতকেই প্রমাণিত হয় পরমাণু অন্য আরও কয়েকটি মৌলিক কণিকা দিয়ে তৈরি, ১৮৯৬ সালে থমসন ইলেক্ট্রনের অস্তিত্ব এবং ভর-আধানের অনুপাত নিয়ে গবেষণা করার সময় তার গবেষণাগারে ছাত্র হিসেবে আসেন রাদারফোর্ড- তিনিই প্রথম পরিক্ষাগারে প্রমণা করলেন পরমাণুর অধিকাংশ ভরই এর কেন্দ্রের খুব সামান্য একটা অংশে কেন্দ্রীভুত থাকে, এই ভারী অংশটুকুকে বলা হয় নিউক্লিয়াস এবং এটার ধণাত্মক আধান আছে। একটি পরমাণুর ব্যাসার্ধ এক মিটারের এক কোটি ভাগের সামান্য কম। দুরত্বের ব্যস্তানুপাতিক মহাকর্ষীয় বলের পরিমাণ প্রচন্ড বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভবনা আছে এ ক্ষেত্রে, কিন্তু তারপরও পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তুরই নির্দিষ্ট আকৃতি বিদ্যমান, প্রতিটি কঠিন পদার্থের আকৃতি অনন্তকাল ধরেই অবিকৃত। হঠাৎ কোনো একদিন পাহাড় চুপসে যাচ্ছে না। রাদারফোর্ডের কাছে অবশ্য মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল ততটা সমস্যার বিষয় ছিলো না, মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মাণের স্বল্পতায় তিনি ধরেই নিয়েছিলেন ইলেক্ট্রন নিউক্লিয়াসের দিকে ধাবিত হবে না ততটা প্রবল ভাবে কিন্তু তার বিবেচনায় ছিলো অন্য একটি দুরপাল্লার বল।

পৃথিবীতে প্রতিটি আধান পরস্পরকে আকর্ষণ কিংবা বিকর্ষণ করে( সমজাতীয় আধান পরস্পরকে আকর্ষণ করে, বিপরীত আধানগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করে) এদের আকর্ষণ বল এদের দুরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। তবে সংকটের বিষয় হলো তড়িৎ চুম্বকীয় বলের ধ্রুবকের মাণ অনেক বড়, সুতরাং মহাকর্ষীয় বলের মতো উপেক্ষণীয় নয় এই আকর্ষণী বল। এই আকর্ষণে ইলেক্ট্রন নিউক্লিয়াসে পতিত হওয়ার কথা- যেহেতু তেমনটা ঘটে নি কখনও সুতরাং এর কোনো একটি গ্রহনযোগ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিদ্যমাণ। রাদারফোর্ড পৃথিবী-চাঁদ- পৃথিবী -সুর্যের কক্ষপথের আদলে কল্পনা করলেন ইলেক্ট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরছে, ফলে তারা কেন্দ্রে পতিত না হয়েও দীর্ঘ সময় এই কক্ষপথে থাকতে পারবে। কিন্তু তারও কয়েক দশক আগে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ছিলো যদি কোনো আধানের গতি পরিবর্তিত হয় তাহলে সেখান থেকে আলোর তরঙ্গ নির্গত হবে- সুতরাং দপ করে জ্বলে উঠে প্রতিটি বস্তুকণাই বিলীন হয়ে যাওয়ার তাত্ত্বিক সম্ভবনা তৈরি হলো।

রাদারফোর্ড এই ধারণা দেওয়ার দুই বছরের মাথায় নিলস বোর অল্য একটি ধারণা দিলেন, কোনো গ্রহনযোগ্য কারণ ছাড়াই সেটা এখন পর্যন্ত একমাত্র ব্যাখ্যা। কেনো এমনটিই হতে হবে এর কোনো যুক্তি নেই, তবে এমনটিই ঘটতে দেখা গিয়েছে এবং যেহেতু অন্য কোনোভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, সুতরাং বোরের পরমাণু কল্পনাই এখন পর্যন্ত পৃথিবী ও মহাবিশ্বকে তার নির্দিষ্ট আকৃতি বজায় রাখতে সাহায্য করছে। নিলস বোরের পরমাণু কল্পনা এবং উলফগ্যাং পাউলির অনুমাণ আমলে না আনলে আমাদের নিত্যদিনের চলাফেরার অন্য কোনো কার্যকারণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। পাউলি বলেছেন পরমাণুর কক্ষপথের প্রতিটি ইলেক্ট্রনকে চারটি সংখ্যার মাণ দিয়ে নির্দিষ্ট করা সম্ভব- কিন্তু পরমাণুর প্রতিটি ইলেক্ট্রনের ক্ষেত্রে এই চারটি সংখ্যা মাণ হবে আলাদা, পরমাণুর যেকোনো দুটি ইলেক্ট্রনের ক্ষেত্রে এই চারটি সংখ্যার মাণ সমান হতে পারবে না। এটা পাউলির বর্জন সূত্র হিসেবে পরিচিত এই অনুমাণের কি ধরণের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, আমরা যদি কোনো বস্তুর উপরে চাপ প্রয়োগ করি, সেটার প্রভাবে এর পরমাণুর চারপাশের ইলেক্ট্রনগুলোর কক্ষপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়, কিন্তু পাউলির বর্জন সূত্র নির্ধারণ করছে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ইলেক্ট্রনই থাকতে পারবে, এবং ইলেক্ট্রনগুলো পরস্পরের কাছে আসামাত্রই এদের বিকর্ষণ বলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, সুতরাং যত প্রবল চাপই প্রয়োগ করা হোক না কেনো, সে চাপ সামলে নেয় পরমাণু।

ফলে আমরা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বাইরে কোনো পদার্থকে সংকুচিত করতে পারি না। কেনো আমরা পৃথিবীর প্রবল মহাকর্ষ বলের প্রভাব সত্ত্বেও হাঁটছি, ফিরছি, ঘুমাচ্ছি এবং দিব্যি বিছানা থেকে উঠে পরতে পারছি তড়িৎচুম্বকীয় বল এবং পাউলির বর্জন সূত্রের সাথে মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মাণের স্বল্পতা বিবেচনা করলে আমরা এ ধাঁধার সমাধান করতে পারি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।