আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাবেদ, তুই কবে ফিরে আসবি?

তারা বলে সম্ভব না, আমি বলি সম্ভাবনা আমাদের সাংবাদিক পাড়ায় যেন শনির দশা লেগেছে। গত ৪-৫ মাসে ঢাকার সাংবাদিকদের জন্য বারবার অশ্রু বিসর্জন দেয়ার মতো হƒদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হচ্ছে। সাংবাদিক নিখিল ভদ্রের ডান পা পিষ্ট হলো সরকারি বাসের চাপায়। যিনি এখনও অবশিষ্ট শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ব্যাংককের হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন।

অন্তত বেঁচে তো আছেন। এটুকুই যা সান্তনা। এই দুর্ঘটনার দুদিন পরে রাজপথে পিষ্ট হলেন আমাদের দীনেশ দা। পিতৃহারা অথৈ এখন কেমন আছে, কে তাকে প্রতিদিন স্কুলে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে, আমরা কজনাইবা তার খবর রাখি। তারপর বাংলাদেশের সাংবাদিক কমিউনিটির মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক ও নির্মমতার শিকার হলেন প্রিয় সাগর ভাই (সাগর সরওয়ার) ও মেহেরুন রুনী।

‘মেঘে’র আকাশ প্রচণ্ড এক টর্নেডোতে লণ্ডভণ্ড। জানি না, স্মরণকালের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার আদৌ হবে কি না। পরলোকে বরেণ্য সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ। ’৮০-এর দশকের তরুণ-হƒদয়ে ঝড় তোলা সাংবাদিক মিনার মাহমুদের অকাল মৃত্যুর জন্য কে দায়ী, তার জবাব হয়তো কখনোই মিলবে না। এমনই শোকের মিছিল নিয়ে চলছে আমাদের প্রতিদিনকার সাংবাদিকতা।

চলছে খবরের খোঁজে প্রতিনিয়ত ছুটে বেড়ানো। এই বেদনাময় সময়টা আরও একটু ভারী করল সাংবাদিকতায় তরুণ প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি। ফেব্র“য়ারি শেষ সপ্তাহের কথা। ‘ওর’ সঙ্গে চ্যাট হচ্ছিল, ফেসবুকে। ভাষার মাস বলেই হয়তো, আমরা বাংলাতেই কথা বলছিলাম।

জিজ্ঞেস করলাম -তুমি কেমন আছ? কাজকর্ম কেমন এনজয় করতেছ? চ্যাটে ও আমার প্রশ্নের কোনো উত্তরই দিল না। তার বদলে সরাসরি মোবাইলে ফোন। কেমন যেন ব্যথিত কণ্ঠে জানতে চাইল- আমি কোনো কারণে ওর সঙ্গে রাগ করেছি কি না। অবাক হয়ে বললাম কেন? ওর উত্তরে যেটা জানলাম, সেটা হলো- এতদিন ওকে তুই তুই করে বলতাম, আজ কেন তুমি করে বলছি। আমিও অবাক! তাই তো।

ওকে তো তুই করেই বলি। আমার নিজের কোনো ছোট ভাই নেই। তাই ওর ছোট ছোট অনুরোধ-আবদার বেশ এনজয় করতাম। সহোদরের মতোই। সেই তারুণ্যদীপ্ত, সদা প্রণোচ্ছল ও হাস্যোজ্জ্বল ছোট ভাইটি আজ জটিল ‘গুলেন বারি সিনড্রম (জিবিএস)’ রোগে আক্রান্ত।

ওর দুই পা সম্পূর্ণ অবশ। পা থেকে কোমর পর্যন্ত কোনো সেন্স পাচ্ছে না। এমনকি দুহাত দিয়েও কিছু ধরতে পারে না। ঢাকার কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে ওর বর্তমান ঠিকানা সাভারের সিআরপি। জানি না, কতদিন ওকে হাসপাতালের জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে হবে, সাদা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিলিং ফ্যানের একঘেয়ে, অবিরাম ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাক খেতে হবে! আবারও ফিরে আসি ওর সঙ্গে আমার কিছু নস্টালজিয়ায়।

কাজের ব্যস্তাতায় কখনও পাঁচ-সাত দিন কথা না হলে, জাবেদই ফোন করত। সেদিন তেমনই, হঠাৎ ওর ফোন। ভাইয়া, আমি আপনাদের টিভি সাংবাদিকতা কোর্সটি করতে চাই। আমারে নেবেন। আমি বললাম, ধুর! তোরে নেব মানে, এটা তো এক্কেবারে শিক্ষানবিশদের জন্য।

তুই তো ওদের শেখাতে পারবি। বরং একদিন তোর কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য ডাকব। বলতে বলতে সেদিন সন্ধ্যাতেই আমাদের অফিসে হাজির। চা খেতে খেতে টেলিভিশনের পর্দায় তার রিপোর্ট। ওর বিট বিএনপি।

আমাদের টেলিভিশনটার রিমোট খুঁজে পেলাম না। অগত্যা ম্যানুয়ালি টিউন করে এটিএন নিউজে গেলাম। বেশ গোছানো রিপোর্ট। তার সঙ্গে ওর ভরাট কণ্ঠস্বর। বেশ ভালোই লাগছিল, কেমন তর তর করে আমার ছোট ভাইটি এগিয়ে চলছিল! এই অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে চলা ছেলেটির নাম জাবেদ।

জাবেদ আখতার। আমি প্রায়শই ভুল করে ‘জাভেদ’ লিখে ফেলতাম। আর তাতে ওর কী যে মনে কষ্ট হতো! কপোট আফসোস করে বলত, আমার নামটাও ঠিক করে লিখছেন না। কদিন পরে তো ভুলেই যাবেন। নারে ভুলিনি জাবেদ।

তোর অসুস্থতার দুঃসংবাদ শুনে একদন্ডও অপেক্ষা করতে পারিনি। ছুটে গিয়েছি তোর পাশে। কিন্তু তোর গরিব ভাইটির কি সামর্থ্য আছে তোকে সুস্থ করে তোলার! শুধু ভালবাসা আর স্নেহ দিয়ে যদি তোকে সুস্থ করে তোলা যেত, তাহলে আর যাই হোক এই মেধাবী যুবকটিকে কিছুতেই হাসপাতালের বিছানায় নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে দিতাম না। ওর চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। সেই খরচের সবটুকুই বহন করে চলছে এটিএন নিউজ।

শুধু ধন্যবাদ শব্দটি দিয়ে এটিএন নিউজ কর্তৃপক্ষকে খাটো করতে চাই না। ড. মাহফুজুর রহমান, মুন্নী সাহা, নাদিম কাদির, প্রভাষ আমীন, প্রণব সাহাসহ জাবেদের সহকর্মীদের অকৃত্রিম ভালবাসা আর সহায়তার হাত বাড়িয়ে না দিলে, ওর সুস্থতা হয়তো আরও দীর্ঘায়িত হতো। জাবেদকে হাসপাতালে দেখতে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ অনেকেই। পেশাগত কারণেই জাবেদের সঙ্গে আমার পরিচয়। সেটা এক সময়ে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে উন্নীত হয় গত কয়েক বছরের ব্যবধানে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তির কিছুদিন পরই দৈনিক আমাদের সময়-এ ইন্টার্নশিপ শুরু করল। মাত্র কয়েক মাস। তারপর ওই সেখানকার ন্যাশনাল ডেস্কের অপরিহার্য অংশ হয়ে গেল। এরই মধ্যে রেডিও ফুর্তির প্রতিবেদক। নিয়মিত কন্ট্রিবিউট করত ‘সাপ্তাহিক’ নামের সাপ্তাহিক পত্রিকায়।

আমার পূর্ববর্তী কর্মস্থল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (যাত্রী) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জাবেদ ছিল অন্যতম সংগঠক। রিসার্চের ডাটা কালেকশন, ট্রেনিং-এ সহযোগিতা করা, এমন ছোট-বড় কোনো কাজেই ওর কখনও ‘না’ নেই। এর মাঝেই নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা, পারিবারের খোঁজখবর রাখা - এসবই সামলা তো বেশ নিপুণভাবে। কখনও কোনো দিন কোনো অনুষ্ঠান, আয়োজন ওর অগোচরে করে ফেললে, স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে ফোন করে, ছোট একটু অনুযোগ, ভাইয়া, ‘আপনি কি আমারে ভুইলা গেছেন’??? মাস চারেক আগের কথা। আমার বিয়ের জন্য বাবা-মা উঠে পড়ে লেগেছেন।

এরই সূত্র ধরে, ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর বাড়ি থেকে প্রস্তাব আসল। আমি কালবিলম্ব না করে জাবেদকে ফোন দিলাম। '‘ক'’ নামের, '‘খ'’ ইয়ারের, ‘'গ'’ ডিপার্টমেন্টের মেয়েটি তোর ভাবি হলে কেমন হবে রে। ও বলল, একটু অপেক্ষা করুন, আজ রাত ১২টার মধ্যেই আপনি ডিটেইল পেয়ে যাবেন। আমি ওর কনফিডেন্স দেখে তো অবাক! রাত পৌনে ১২টার দিকে ওর এসএমএস- ডিয়ার ভাইয়া, প্লিজ, চেক ইউর ই-মেইল।

ই-মেইল খুলে দেখি সেই মেয়েটির বেশকিছু ছবি। আমি মেয়েটির ছবি পেয়ে যতটুকু না হতবাক, তারচেয়ে বহুগুণ বিস্মিত ও মুগ্ধ জাবেদের এই স্ট্রং নেটওয়ার্ক ও সাকসেসফুল অ্যাটেম্পট দেখে। জাবেদ! যে ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনটাও শেষ করতে পারেনি, এত অল্প সময়ে বাংলাদেশে আর একজন সাংবাদিকও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না আমার সন্দেহ রয়েছে, যে আমাদের সময়, বিসিডিজেসি, যাত্রী, এনটিভি, রেডিও ফুর্তি এবং এটিএন নিউজের মতো ছয়টি বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এসব ঝামেলাপূর্ণ কাজের সঙ্গে সমানতালে চালিয়ে গেছে লেখাপড়া। বন্ধুদের সঙ্গে জম্পেস আড্ডাতেও জাবেদ সবসময় প্রাণভোমরা।

এমন ব্যাপক সম্ভাবনাময় একজন সাংবাদিক অংকুরেই ঝরে যাবে, এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। জাবেদ, আমাদের ভালবাসা আর প্রাণখোলা আশীর্বাদ আর ভালবাসা অবশ্যই তোকে ফিরিয়ে আনবে রাজপথের কঠিন কঠোর বাস্তবে। সেখানে তুই আবারও মাইক্রোফোন, ক্যামেরা, টাইপ হাতে নিয়ে মনের আনন্দে ছুটবি খবরের পিছু পিছু। আর টেলিভিশনের পর্দায় হঠাৎ তোর কণ্ঠস্বর শুনে অথবা তোর মুখখানি দেখে আমরা আবারও গর্ব করে বলতে পারব, ওই তো ‘আমাদের জাবেদ’! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.