আজকে যে প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চলেছি, সেটি বড়ই লজ্জার। এই লজ্জার অংশভাক্ আমিও একজন। সুতরাং শরমিন্দা হয়েই কলম ধরেছি। স্যরি, কলম তো না—কম্পিউটারের কিবোর্ড ও মাউস ধরতে হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন হয়ে গেল।
বহুত বহুত ঘটা করে। সমাবর্তন যেদিন, তার বেশ আগে থেকেই ছিল ধুন্ধুমার প্রচারের বর্ণচ্ছটা। হেন হবে, তেন হবে। এই হেনতেনর মাঝখানে একদিনের খবর পড়ে রীতিমত চমকে উঠতে হলো। ঢাবি গ্র্যাজুয়েটরা সমাবর্তনের উপহার লুটপাট করেছেন।
ছেলেমেয়ে উভয়পক্ষই তাদের লুটেরা সত্তা জাতির সামনে জাহির করেছেন। সবাই চুরি করেনি, করেছে মাত্র কয়েকজন। তাতেই হেঁট হয়েছে মাথা। আমার নিজেরও। কারণ আমিও এই বিশ্ববিদ্যায়তনের একজন দুর্ভাগা স্নাতক।
আমাদের কালে সমাবর্তন ছিল না, পরেও হয়নি। মরণোত্তরও না। সুতরাং, আমাদের ব্যাচের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও কেউ লুটেরা বা চোর ছিল কিনা, সেই টেস্ট হয়নি। হতে পারেনি। আর কোনোদিন হওয়ারও নয়।
লুণ্ঠিত উপহারসামগ্রী উদ্ধার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বয়ং। তিনি তিরস্কার করেছেন ‘চোরা’ গ্র্যাজুয়েটদের। বিরাট লাইন ছিল সমাবর্তনের। গাউন, হ্যাট ও অন্যান্য উপহার সংগ্রহের জন্য। আরও ছিল ঢাবি’র মনোগ্রাম-খচিত হ্যাট, কলমদানি, পার্স, টাই এবং মগ।
এগুলো দেয়ার জন্য বুথ ছিল মাত্র ছয়টি। কোন আক্কেলে হাজার হাজার ছেলেমেয়ের জন্য মাত্র ছয়খানা বুথ করা হয়েছিল, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই ভালো জানেন। তাদের এই অ্যামেচারিশ কীর্তির (?) জন্য কে তাদের ভর্ত্সনা করবে? উপহার নেয়ার জন্য হুড়োহুড়ি একপর্যায়ে ধাক্কাধাক্কিতে রূপ নেয়। আহত হন বেশ কয়েকজন। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান কিছু মহিলা গ্র্যাজুয়েট।
গণ্ডগোলের কারণে উপহার প্রদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। উপাচার্য কয়েক শিক্ষার্থীর ব্যাগে ৫-৭টি মগ পান। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, পাঁচ বছরে তোমাদের আমরা এই শিক্ষা দিয়েছি! অবশ্য অব্যবস্থাপনার কথা তিনি স্বীকারও করেছেন।
কেউ বলতে পারেন, এটি অত গুরুতর ঘটনা নয়। এটাকে এত সিরিয়াসলি দেখার কিছু নেই।
আবার দ্বিমতও পোষণ করবেন অনেকেই। এই ছেলেমেয়েদের হাতেই ভবিষ্যত্ দেশ চালানোর ভার। তারা যদি এমন স্খলিত হয়, তবে ভরসাটা কোথায়? নাই ভরসা নাই। ভবিষ্যত্ আমাদের ফরসা। উপাচার্য বলেছেন, ‘অনেক ছাত্রীর কাছে ছাত্রদের টাই পাওয়া গেছে।
আবার অনেক ছাত্রের কাছে পাওয়া গেছে ছাত্রীদের হাতব্যাগ। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ’ শুধু ছাত্রছাত্রীদের কাঁধে দায় চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না। সমাবর্তন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। এটি নতুন করে হচ্ছে না।
প্রশাসনিক যে বিশৃঙ্খলা হলো, উপাচার্য সাহেব কি সে ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন? উপহার লুণ্ঠনের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তিই আছে। সেসব খতিয়ে দেখতে যাওয়া মানে হলো প্যানডোরার বাকেশর ঢাকনা খুলে ফেলা। না খোলাই বাঞ্ছনীয়।
গ্র্যাজুয়েট/মাস্টার্স, এম-ফিল, পিএইচ-ডি মিলিয়ে প্রায় ১৭ হাজার শিক্ষার্থী পেলেন সনদ-সম্মাননা। যারা স্নাতকোত্তর হলেন এখন তাদের কর্মজীবনে প্রবেশের পালা।
কর্ম কোথায়, কী পরিমাণ আছে? সবাই কি পাবে চাকরি? ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার স্লোগান আমরা আর শুনি না। মহাজোট নেতারা এই স্লোগান শুনলে শরমিন্দা হন। বিব্রত বোধ করেন। হয়তো মনে মনে বলেন, মা ধরণী দ্বিধা হও। সদ্য পাস করা হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ক’জনের কর্মসংস্থান হতে পারবে শেষতক? কার মামুর জোর কতটা? চাকরির বাজার বড়ই মন্দা।
ঘুরে ঘুরে কেবলই জুতোর সুকতলি ক্ষয় করা। পর্বতপ্রমাণ এই নৈরাশ্যের মধ্যে কোনো আশার আলো কি আছে আদৌ? নাই নাই।
তবে কোনো কোনো ছাত্র আছেন, যার কপাল রাজকীয়। আল্লাহ যারে দেয় তারে ছাপ্পর ফুইরা দেয়। সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর সাবেক এপিএস এমনই এক ভাগ্যবান ব্যক্তি।
হেঁজিপেঁজি নন তিনি, গোল্ডেন জিপিএ পাওয়া ভাগ্যবান। কথায় বলে, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়। ওই ভদ্রলোক ছিলেন ছাত্রনেতা। কোন সংগঠনের? — আন্দাজ করে নিন পাঠক। সমঝদারকে লিয়ে ইশারায়ে কাফি।
তো, তিনি চটজলদি সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। উপলক্ষ তার বিবাহ। ঢাকা থেকে দুইখান হেলিকপ্টারে বরযাত্রী ও নববধূসহ ফরিদপুর গেছেন তিনি। বৌয়ের মাথায় যে মুকুট ছিল, তা ১০০ ভরি সোনায় নির্মিত। সেঞ্চুরিয়ান।
এক ভরি সোনা আজকাল বিকোচ্ছে ৬০ হাজার টাকায়। ইকোয়েল টু ৬০ লাখ টাকা। খানাপিনাও ছিল ধুম। যাহা তাহা কথা না রে ভাই, ১০ হাজার লোকের ভূরিভোজ। খানাপিনা বাবদ গেছে ৩০ লাখ টাকা।
আনুষঙ্গিক খরচাপাতি তো আরও অনেকই আছে। সব মিলিয়ে কোটি টাকার নিচে না।
আমরাও বলি, টাকা-পয়সা হচ্ছে গিয়ে হাতের ময়লা। বিবাহ উপলক্ষে কত কিছু হলো। হবেইবা না কেন? ধুমধাম হলো, কাড়ানাকাড়া বাজল।
সাঁই সাঁই হেলিকপ্টার উড়ল। তাল তাল সোনাদানা বিক্রিবাট্টা হলো। ধুম খানাপিনা ভোজনরসিকরা তারিয়ে তারিয়ে উদরস্থ করলেন। বিয়ের খাওয়া বলে কথা! অনেকে এসব দৃশ্য-ঘটনা উপভোগ করলেন আরামসে। কত সহজেই না ওই সাবেক এপিএস জাতীয় আড্ডা/আলোচনা/বিতর্কের বিষয়বস্তুতে পরিণত হতে পারলেন।
কে বলে বাংলাদেশ গরিব দেশ? কে বলে বাঙালি ফুটানি করতে জানে না? এই যে কোটি টাকা ব্যয়িত হলো—এর উত্স কি কেউ জানে না। দুদক তো অন্য কাজে (বিরোধী দল ঠেঙানো) ব্যতিব্যস্ত। এমন ‘ট্রিফলিং ম্যাটারে’ তাদের নজর দেয়ার সময় নাই। হয়তো এখতিয়ারও নাই। সব জায়গায় (অর্থাত্ বেজায়গায়) হাতও দিতে নাই।
সেটা দেয় বেকুবে!
হা সা ন হা ফি জ
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।