সম্প্রতি জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের কিছু নারী সাংসদের অশালীন, কুরুচিপূর্ণ ও অসত্য বক্তব্যকে কেন্দ্র করে আমাদের মহান সংসদের মর্যাদা-ক্ষুণ্নতা ও জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মত প্রকাশ করছেন, সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত করা হোক। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত কলাম লেখক ও আমার প্রিয় লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বাঙালি নারীর মুখকে এতটাই কলুষিত মনে করছেন যে আমাদের জাতীয় সংগীতকে ‘কলুষিত’ করার দায়ভারটাই নারীর ওপর চাপিয়েছেন। (প্রথম আলো, ২৬ জুন)। পত্রিকান্তরে আরেকজন একই কারণে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য পড়ে মনে হলো সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যরা এতটাই স্বাধীন, সাহসী ও তৎপর যে তাঁরা নিজ সিদ্ধান্তে যেকোনো ব্যক্তি, নেতা বা দল সম্বন্ধে সীমাহীন কুরুচিপূর্ণ প্রায়ই অসত্য বিষোদ্গার করতে দ্বিধাবোধ করেন না এবং এ জন্য পুরুষ সহকর্মীদের তালিও পেয়ে থাকেন তাঁদের স্বপ্রণোদিত সাহসী ভূমিকার জন্য।
কিন্তু ব্যাপারটি সত্যিই এত সরলীকরণ! যে সংসদে নির্বাচিত নারী সাংসদেরাও কোনো জাতীয় বা নারী ইস্যুতে সহজে মুখ খোলেন না, কখনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন না, কেন বাংলাদেশে ১৫ শতাংশ হারে নারী নির্যাতন বেড়ে চলেছে, কেন ব্র্যাকের সাম্প্রতিক জরিপে গ্রামীণ নারীরা ন্যায়বিচারের অভাব ও লিঙ্গবৈষম্য তাঁদের জীবনের প্রধান অন্তরায় বলে উল্লেখ করেছে এবং এ ব্যাপারে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেন সন্ত্রাসীর বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় গুলশানের জোড়া খুনের আসামি এখনো প্রকাশ্যে অপর দুই বোনকে শাসিয়ে চলেছে। নারী সাংসদেরা কেন প্রশ্ন তোলেন না, বর্তমানে সরকারের ৭১ জন সচিবের মধ্যে মাত্র তিনজন মহিলা এবং ২৪২ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে মাত্র ১২ জন মহিলা, যা শুধু ব্যাপক লিঙ্গবৈষম্যই নয়, সুশাসনেরও অন্তরায়। কেন তাঁরা সংসদে বিল উত্থাপন করেন না বিদ্যমান শ্রম আইনের সংশোধন করে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যেখানে ৭০ শতাংশ নারী কাজ করেন, সেখানে লিঙ্গভিত্তিক মজুরিবৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। সে ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসনের মহিলা সাংসদদের তথাকথিত সাহসী ভূমিকা মূলত অলীক, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
তাঁরা যেহেতু অন্যায্য প্রাপ্তি লাভ করেছেন, তাই তাঁরা অন্যায্য কাজে ব্যবহূত হতেই পারেন। তাঁরা অন্যের প্রতিভূ হয়ে কাজ করে থাকেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ আরও বলেছেন, ‘সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশে গণতন্ত্র থাকবে না’। প্রকৃতপক্ষে দেশে, বিশেষত দলে গণতন্ত্র নেই বলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে।
পৃথিবীর সব দেশে রাজনীতিতে নারীর সমঅংশীদারির ইস্যুটি গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির অংশ হলেও এযাবৎ রুয়ান্ডা ছাড়া কোনো দেশে এ নীতির বাস্তবায়ন হয়নি।
যে কারণে বিশ্বগণতন্ত্রায়ণে নারীর প্রবেশ সাম্যতা, মর্যাদা ও প্রভাব কোথাও পুরুষের সমকক্ষ নয় এবং এ ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই ক্ষমতার প্ল্যাটফর্মে এ সক্ষমতাই একবিংশ শতাব্দীতেও নারীকে ক্রমবর্ধমান হারে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার, যা কিছুটা হলেও কোটাপদ্ধতির মাধ্যমেই মোকাবিলা করা হচ্ছে। নারী যেহেতু প্রায় সব দেশেই জনসংখ্যার অর্ধেক, তাই রাজনীতিতে নারীর সমঅংশীদারির বিষয়টি একই সঙ্গে ন্যায্যতা ও গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি হিসেবে সংযোজনের একমাত্র পন্থা হিসেবে সংসদে নারীর জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ বা রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে কোটাপদ্ধতির প্রচলন একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত পদ্ধতি হিসেবে গৃহীত। তবে উভয় ক্ষেত্রেই নারীকে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আসতে হবে।
উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বে মাত্র ২৩টি দেশে সংসদে ৩০ শতাংশ বা তার ঊর্ধ্বে নারী প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এবং প্রতিটি দেশেই কোটাপদ্ধতির মাধ্যমে সরাসরি নারী-নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না হওয়া পর্যন্ত কোটাব্যবস্থা ব্যতিরেকে কোনো দেশেই নারীর ন্যূনতম ৩০ শতাংশ আসনে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
একমাত্র রুয়ান্ডার পার্লামেন্টে নারীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। দীর্ঘকাল গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটি পার্লামেন্টে নারী সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর সুশাসনের কারণে পাঁচ বছরে মাথাপিছু গড় আয় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে পুরুষপ্রধান হওয়ায় রাজনীতিতে নারীর প্রবেশগম্যতা ঘটাতে বিভিন্ন দেশে যেসব কৌশল ও প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রচর্চার প্রসার এবং আইন প্রণয়নের মাধ্যমে দলীয় মনোনয়নে নারীর জন্য কোটা সংরক্ষণ সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
ষাটের দশক থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ও কিছু ইউরোপিয়ান দেশে রাজনৈতিক দল এবং সব ধরনের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পরিচালনা পর্ষদে নির্দিষ্টসংখ্যক নারীর অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়। কিউবাতেও একই আইন প্রবর্তন করা হয়।
ফলে সেসব দেশে পার্লামেন্টে বর্তমানে ৪০ শতাংশের ঊর্ধ্বে নারী সদস্য রয়েছেন, যা জনকল্যাণমুখী সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
আশির দশকে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার কিছু দেশও সংসদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করে। কারণ, বহু ক্ষেত্রে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোয় আইন রক্ষা করতে প্রায়ই ‘নন-উনেবল’ আসনে নারীকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমেই নারীকে সংসদে আসতে হয়।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলন দীর্ঘকাল ধরে দাবি করে আসছে সব রাজনৈতিক দলের জন্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য।
যতক্ষণ সে ধরনের আইন প্রণীত না হচ্ছে, নারীর জন্য সংসদে সংরক্ষিত আসন হিসেবে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ আসন রাখতে হবে এবং সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমেই নারীকে সংসদে থাকতে হবে।
এ ধরনের নির্বাচন-প্রক্রিয়ার সম্ভাব্য রূপরেখা নিয়ে উইমেন ফর উইমেন, এনসিবিপি এবং আরও নারী সংগঠন বেশ কিছু সেমিনার ও আলোচনা সভা করেছে।
আসনের নির্দিষ্ট কোটা সংরক্ষণ ও সহায়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে ওই আসনে সরাসরি নির্বাচন ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক কালচার তো দূরের কথা, বহু উন্নত দেশেও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবারের হাতে গোনা দু-চারজন নারী ব্যতিরেকে মূলধারার জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী নারীর জন্য রাজনীতি হবে অপ্রবেশগম্য এবং সে ক্ষেত্রে আরও কয়েক শতাব্দী সম্পূর্ণ পুরুষশাসিত সমাজেই হবে আমাদের বসবাস।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ ও নারীনেত্রী। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।