আমি সাংবাদিক এবং ইংরেজি সাপ্তাহিক ব্লিটজ-এর সম্পাদক। এছাড়াও আমি গীতিকার, সুরকার, লেখক এবং চলচ্চিত্র পরিচালক নারকীয় হত্যাকান্ডের পর-পরই মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন "৪৮ ঘন্টার মধ্যেই খুনিরা গ্রেফতার হবে"! এখনতো ৯৬০ ঘন্টারও বেসি অতিক্রমের পথে। গোয়েন্দা এবং পুলিশ মুখে কুলুপ এঁটেছে, ওদের শব্দযন্ত্রে যেনো হাজার বছরের জং ধরে গেছে! কেউ বলতে পারছেনা এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যার আদৌ কোনো তদন্ত হচ্ছে কি-না! কেউ-কেউ বলছেন, তদন্তের নামে আসলে যা হচ্ছে তা নেহায়েত লোক ঠকানো নাটক। যতোই দিন যাচ্ছে আমার কাছেও কেমন যেনো সব কিছুতেই একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। নাহ, আমার মাথায় এদেশের রাজনীতিক আর ক্ষমতাসীনদের মতো উদ্ভট রহস্য আবিস্কারের ভুত চাপেনি।
আমিতো অনেক আগেই বলেছি, সাগর-রুনি হত্যার পেছনে এমন কোনো কারণ আছে যার ফলে ক্রমশ এই নারকীয় হত্যাকান্ডের বিষয়টি ধামাচাঁপা দিতেই যেনো রাষ্ট্রযন্ত্র বড় বেশি অস্থির হয়ে পড়ছে। আমার এই সন্দেহ যেনো ভুল হয় তা কায়মনবাক্যে কামনা করি। কিন্তু যতোই দিন যাচ্ছে, কেমন যেনো রহস্যের উটকো গন্ধটা ক্রমশ বাড়ছেই! এর শেষ কোথায়, অথবা আদৌ কোনো শেষ আছে কিনা তা বলে দেয়ার সাধ্য আমার নেই!
কেউ-কেউ বলছেন, সাগর-রুনি হত্যার দ্বায় চাপাতে গোয়েন্দার দল এখনো একজন "জজ মিয়া" আবিষ্কারে ব্যর্থ। দু'জন সম্ভাবনাময় তরুণ সাংবাদিক অনেক বেশি অসময়ে নিহত হলো, অথচ পুলিশ আর গোয়েন্দারা গোটা ঘটনাটা নিয়ে এমন সব নাটক শুরু করে দিয়েছে, যা দেখে যে কোনো মানুষের মনেই খটকা লাগা স্বাভাবিক। পুলিশ বলছে আগে নাকি সাগরকেই খুন করা হয়, এবং তার পর রুনিকে! এটা মানতেই পারছিনা।
সাগরের হাত-পা বাঁধা ছিলো, এটা খুনের পর প্রকাশিত ছবিতে আমরা সবাই দেখেছি। সাগরের দেহে আঘাত করা হয় মোট ষোলটি। আবার কখনো-কখনো শুনছি আঘাতের পরিমান নাকি "কিছু" বেশি। ফরেনসিক বিশেসজ্ঞদের মতে, সাগরকে খুন করেছে "অপেশাদার" হন্তারক। আবার সেই একই বিশেসজ্ঞরা বলেছেন, "রুনিকে আনফরচুনেটলি পেশাদারী আঘাতের মাধ্যমে হত্যা করা হয়"।
এটা যদি সঠিক হয়, তাহলেতো প্রশ্ন জাগবে, সেদিন রুনির সাথে এমন কে দেখা করতে যান, যার সঙ্গে পেশাদার খুনি ছিলো? রুনি কি বুঝতে পারেননি এই পেশাদার খুনির পরিচয়? এখানেই প্রশ্ন, রুনি'র সামনে তার স্বামীর হাত-পা বাঁধা হলো, খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে খুন করা হলো, আর সব কিছু সুবোধ বালিকার মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে রুনি দেখলো! এটাও বিশ্বাস করতে হবে?
সাগর-রুনি যে বাড়িতে খুন হলো ওই বাড়ির দারোয়ানকে এতোদিন রিমান্ডে রাখা হলো। কই, কোথাও শুনলামনাতো ওই দারোয়ান আদালতে কোনো বিবৃতি দিয়েছে কিনা! ওই দারোয়ানের জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টা কোনো বিশেষ কারণেই বেশ কৌশলের সাথে ধামাচাপা দেয়া হয়ে গেছে। ওই বাড়িতে রুনির সাথে যারাই গেছে তাদেরকে নিঃসন্দেহে ওই দারোয়ান দেখেছে। এসব বৃত্তান্ত পুলিশ বা গোয়েন্দারা লুকাচ্ছেন কেনো? কোন অদৃস্য শক্তির ভয়ে অথবা হাতের ইশারায় এতো রহস্যের জন্ম দিচ্ছেন পুলিশ এবং গোয়েন্দারা?
এখানে বলে রাখি সাগর এবং রুনি পেশাগত কারণে দেশের খনিজ সম্পদের বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজ-খবর রাখতো। এমনতো নয়, যে ওদের কাছে হয়তো দেশের খনিজ সম্পদ, অর্থাৎ তেল-গ্যাস সংক্রান্ত এমন কোনো তথ্য চলে আসে যা ওদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়? তেল-গ্যাস নিয়ে যারা মাথা ঘামান, অর্থাৎ এসব নিয়ে যারা টাকা-পয়সা কামানোর ধান্দা করেন সে দলে কিন্তু ক্ষমতার কাছাকাছি লোকজন্রাই থাকেন।
বছরের-পর-বছর ধরেই এই সেক্টর থেকে হাজার-হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে, যা এখনো থেমে যায়নি! সাগর-রুনিরা যদি এমন কোনো লুটেরা চক্রের গোপন খবর পেয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলেতো ওদের প্রাণ কেড়ে নেয়ার পেছনে ওই চক্রের যে হাত থাকতে পারে তা সহকেই অনুমান করা যায়। আমি বলছিনা, ঠিক এই কারণেই সাগর-রুনির মৃত্যু হয়েছে, তবে পারিপার্শিক ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ করলে আমার এই ধারনাটাকেও উড়িয়ে দিতে পারছিনা।
অনেকেই ইদানিং প্রশ্ন করছেন, সাগর-রুনির হত্যাকারীরা ধরা পড়বেতো? আমার কাছে সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। আমার মনে একটা সন্দেহ, শেষতক কোনো একজন 'জজ মিয়া'কে বলির পাঠা বানিয়ে পুরো ঘটনাটাকেই আসলে চিরতরে সমাহিত করা হবেনাতো?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাগর-রুনি'র একমাত্র সন্তান মেঘ-এর পড়াশোনার পুরো দায়িত্ব নিয়েছেন, যা নিশ্চই প্রশংসার দাবি রাখে। তবু, প্রধানমন্ত্রী'র এই মহানুভবতাকে একদম খাটো না করেও বিনয়ের সাথেই বলছি, মেঘের জীবনের এই পরিনতি নিঃসন্দেহে কারো কাম্য ছিলোনা।
কোনো একজন প্রধানমন্ত্রীর দয়ার পাত্র হয়ে মেঘ বড় হবে, এটাতো কারোরই কাম্য হওয়ার কথাও নয়। তবু, মেঘের সামনে আজ আর কোনোই পথ খোলা নেই। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁকে এখন বড় হতে হবে, কোনো এক বড় মানুষের দয়ার ছায়াতলে। খুব কষ্ট লাগে নিস্পাপ এই শিশুটির কথা ভাবলেই! মেঘের যাবতীয় দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যতটা নন্দিত হয়েছিলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি নিন্দিত হয়ে গেলেন তাঁর এক সাম্প্রতিক বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, কারও বেডরুম পাহারা দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।
সাংবাদিকদের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবীর বালু হত্যাকাণ্ডের পর যদি সাংবাদিকরা এভাবে আন্দোলনে নামতো তাহলে হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তাই সকলে মিলে নামেনি। আমরা ক্ষমতায় তাই সকলে মিলে নেমেছে। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর কর্মসূচির সমালোচনাও করেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে নিহত সাংবাদিক দম্পতির বেঁচে যাওয়া শিশু সন্তান মাহিন সরওয়ার মেঘের কাছে ঘটনা জানতে চেয়ে কিছু সাংবাদিকের তৎপরতা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বুঝলাম না প্রধানমন্ত্রীর এই "নাখোশ" হওয়ার কারনটা! তিনি বলতে চেয়েছেন, সাগর-রুনি হত্যাকান্ডকে ইস্যু করে বাংলাদেশের গোটা সাংবাদিক সমাজ এখন আওয়ামিলীগ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে! প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, কোনো ঘটনার পর জিজ্ঞাসাবাদের অধিকার নাকি সাংবাদিকদের নেই! এটা নাকি স্রেফ পুলিশের কাজ! বিনয়ের সাথেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, আপনি যদি মনে করেন বাংলাদেশের গোটা সাংবাদিক সমাজ আজ আপনার সরকারের বিপক্ষে, তাহলে বুঝে নিতে কি খুব কষ্ট হচ্ছে যে আপনাদের উপর এখন জনগনের আর কোনো আস্থা নেই? সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ! এটা আপনি যখন বিরোধী দলে থাকেন তখন বেশ জোর গলায়ই বলেন। আর এখন সমাজের সেই দর্পণ সাংবাদিকরাই হয়ে গেলো আপনার চক্ষুশুল! বাহ! সাবাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী!
আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, আপনার নিজের এই বক্তব্যের মধ্যেই কতো বিশাল স্ববিরোধিতা আছে? আপনিই বললেন, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালু হত্যার পর সাংবাদিকরা সোচ্চার হলে নাকি আর সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটতোনা। তাহলে এখন সাংবাদিকরা যদি দেরী করে হলেও সোচ্চার হয়ে থাকেন তখন আপনার গাত্রদাহ কেনো হয়? আপনাকে এটাও বলছি, যে কোনো ঘটনা জানার এবং তদন্ত করার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের আছে - সাংবাদিকদের তো আছেই! আপনি বলেছেন কারও বেডরুম পাহারা দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মেনে নিলাম আপনার যুক্তি! তাহলে বিনয়ের সাথে বলি, দেশের সীমান্তে বিএসএফ তো প্রকাশ্যেই বাংলাদেশীদের হত্যা করছে এবং এসব হত্যাকান্ড কোনো 'বেডরুমে' হচ্ছেনা। কই, আপনার সরকার তো এবিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে একটা কড়া প্রতিবাদও করেনি! দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি কি পারতেননা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে এসবের প্রতিবাদ জানাতে? ভারতের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সাথেও তো আপনার খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক।
কই, শুনলামনাতো আপনি ওনাকেই ফোন করে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছেন!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের পর আমরা সাংবাদিক সমাজ আজ চরমভাবে ব্যথিত। স্বজন হারানোর ব্যথার পরিধি কতটুকু তা আপনার চেয়ে ভালো অনেকেই জানেনা! আমাদের এই শোককে আপনি যদি সরকার বিরোধী কার্যকলাপ ভেবে থাকেন, তাহলে আপনি আমাদের প্রতি অবিচার করবেন! স্বজন হারানোর কষ্টে আমরা সাংবাদিকরা যখন নীরবে চোখের জ্বল ফেলছি এবং খুবই শান্তিপূর্ণ পন্থায় এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করছি, তখন যদি আপনার মতো মানবিক গুনসম্পন্ন একজন নেত্রীর কাছে আমরা অযাচিত কথা-বার্তা শুনি তাহলে আমাদের শোক কিন্তু দ্রোহে রূপ নিয়ে বিস্ফোরিতও হতে পারে। আপনি যদি স্বজন হারানোর ব্যথায় ব্যথিত হয়ে খুনিদের বিচার করতে পারেন, একজন 'সামান্য' মেঘ অথবা সাগর-রুনি'র সহকর্মী এবং সতীর্থরা কি অন্তত বিচারও চাইতে পারবেনা?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একমাত্র স্রষ্টা এবং শয়তানের ভুল হয়না। বাকি সবারই ভুল হয়। আপনি নিজেও তাই ভুলের উর্ধে নন! আপনার ওই বক্তব্যে আমরা সাংবাদিক সমাজ কষ্ট পেয়েছি - বিক্ষুব্ধ হয়েছি! আপনি একবার কোনো এক বক্তৃতায় বলেছিলেন আপনার সরকার হলো, 'Government for the people, by the people and of the people'।
এই কথাই যদি সত্যি হয় তাহলে নিশ্চই সেই জনগনকে আপনার কোনো কথার মাধ্যমে কষ্ট দিয়ে থাকলে তাদের কাছে ক্ষমা চাইলে আপনার ইমেজ অথবা উচ্চতা একটুও কমবেনা। পেশাগত কারণেই আপনাকে অনেক কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আপনার মধ্যে চমত্কার একটা মন আর বিশাল মানবিক গুনাবলী আছে, যা আমি দেখেছি বহুবার! কিন্তু আপনার সেইসব মানবিক গুনাবলী আজ আর দেখছিনা কেনো? আপনার আচরণ হওয়া উচিত স্নেহশীল সেই মায়ের মতো, যাঁকে সবাই শ্রদ্ধা করবে। আপনি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। এটা ভুলে গেলে কি চলবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? আপনার এবারের শাসনকালে শত-শত ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, যা আগেরবারের চেয়ে ঢের বেশি! আপনার দলের অনেক নেতা-নেত্রীর আচরণেই এখন জনসেবকের বদলে 'গণ প্রভুর' রূপ ফুটে উঠছে! আমরা কিন্তু ভোট দিয়ে কোনো প্রভু নির্বাচন করিনা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
এটা আপনার মনে থাকা দরকার! জানি আমার লেখা পড়ে আপনি যার-পর-নাই ক্ষুব্ধ হবেন! হয়তো আপনার পুলিশ অথবা অন্য কোনো বাহিনী এমনকি ছাত্র-যুবলীগ লেলিয়ে দিয়ে আমাকে গুমও করতে পারেন। তারপরও বলছি, ক্ষমতা কখনই চিরস্থায়ী নয়! এটা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছেন মিশরের হুসনি মুবারক থেকে শুরু করে, তিউনিশিয়ার বেন আলী অথবা লিবিয়ার গাদ্দাফি। এই পরিবর্তনের হাওয়া কিন্তু থেমে যায়নি এখনো!
সবশেষে বলবো, আর কোনো আলটিমেটাম নয়, আর কোনো কান্ডজ্ঞানহীন বক্তৃতাও নয়! সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেফতার করুন, অবিলম্বে! প্লিজ, আমাদের মতো সাধারণ জনগনের সেন্টিমেন্ট অথবা ইমোশন নিয়ে খেলবেননা! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।