তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা
মানুষের স্বভাবপ্রকৃতি দু ধরণের। কেউ সাহসী কেউ ভীতু। কেউ বেশী বুঝে কেউ কম বুঝে। আমাদের চিরশত্র“ শয়তান তাই প্রথমেই আমাদের মানসিক প্রকৃতির খোঁজ নিয়ে সেভাবেই আমাদেরকে ধোকা দিতে চায়।
আপনি হয়তো মনমানসিকতায় সাধারণ মানের।
আর আট দশজনের মতোই আপনি ধর্মকে সহজভাবে ভালোবাসেন। আপনার এ অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে শয়তান আপনাকে প্ররোচিত করবে, ‘ইসলাম তো আপনি মানবেন ই। কিন্তু ধীরে ধীরে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে নয়। কী দরকার এত তাড়াতাড়ির? আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হবেন। যাক না কয়েকটা দিন।
’
আপনিও নিজের অজান্তে এ ভাবনাকে সায় দিয়ে ধীরে ধীরে একসময় দূরে সটকে যাবেন। প্রথমে সুন্নত ছেড়ে দিয়ে, তারপর ওয়াজিব, তারপর ফরয নামাজগুলো, তারপর জুমার নামাজ, তারপর ঈদের নামাজ, এভাবে বাদ দিতে দিতে চলে আসবে আপনার নিজের জানাযার সময়।
আবার আরেকজন মনমানসিকতায় দৃঢ়। তাকে সহজে ঘায়েল করা যাবেনা। শয়তান তখন অন্য পথে হাঁটে।
এ পথের নাম- অতি ধার্মিকতার পথ। ভেতরে ভেতরে তাকে উসকে দিবে, ‘তোমার অযু হয়নি, কোন অঙ্গ হয়তো শুকনো রয়ে গেছে, যাও আবার অযু করো। নামাজ মাত্র এ কয়েক রাকাত, আরে আরও বেশী করে আদায় করো, রোজা শুধু রমজান কেন, সারা বছর জুড়ে রাখো, রাতে ঘুম কেন, সারা রাত নামাজ পড়ো, তুমি পারবেই!!’
বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত, তিনজন যুবক একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ঘরে এসে তার ইবাদত সম্পর্কে খোঁজ নিলো। কিন্তু রাসূলের ইবাদতের বর্ণনা শুনে তারা অবাক হয়ে গেল। তারা বলতে লাগলো, ও তিনি তো নবী! আমরা তো আর নবীর মতো না।
ইবাদত আমাদেরই করতে হবে অনেক বেশী। একজন বললো, আমি আজ থেকে অনবরত রোজা রাখবো, আরেকজন- আমি আজ থেকে আর রাতে ঘুমাবো না। আরেকজন তো আর বিয়েই করবেনা বলে শপথ নিলো। রাসূল এসে এসব শুনে বললেন, আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে অনেক বেশী ভয় করি। তবুও আমি রোজা রাখি, আবার রোজা ছাড়াও থাকি, আমি নামাজও পড়ি আবার বিশ্রামের জন্য ঘুমাই।
আমি বিয়েও করি... আমার এ আদর্শ থেকে যারা বিরত থাকবে, তারা আমার উম্মত নয়।
এ শ্রেণীর মতো আমাদের সমাজেও কিছু লোক রয়েছেন, যারা নির্ধারিত ফরয ইবাদতগুলোকে অল্প মনে করে এবং ভাবে, এ সামান্য ইবাদত দিয়ে কিছূ হবে না। তারা নিজেদের ইবাদতে আরও বেশী মগ্ন হয়ে এর সাথে অনেক কিছূ বাড়াতে চায়। ওদিকে অন্যদের অধিকারের কথা বেমালুম ভুলে যায়। আর এখানেই গোলমাল বাঁধে।
ইবাদতে অতি মগ্ন হতে গিয়ে তারা বিচ্যুত হয় সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে, আর এর সাথে বাড়াতে গিয়ে ছিটকে পড়ে যায় ইবাদতের সীমানা ছাড়িয়ে। তার ইবাদত তখন উল্টো তার জন্য অশুভ পরিণাম বয়ে আনে।
এজন্যই মনিষীরা বলেন, আল্লাহ পাকের প্রতিটি হুকুম নিয়ে শয়তান দু রকমের ফন্দি আঁটে। হয়তো বাড়াবাড়ি করিয়ে তা নষ্ট করা নয়তো ছাড়াছাড়ি ঘটিয়ে তা মূলোৎপাটন করা। আর মানুষের স্বভাব বুঝে শয়তান সেভাবেই তাকে ঘায়েল করে।
অতিমাত্রার বন্দেগী কিংবা অতিমাত্রার অবহেলা- এ দুটি বিপদজনক সীমার মাঝামাঝি হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম।
ইবনুল কাইয়্যিম লিখেছেন, কেউ অবহেলা করতে গিয়ে অযু নামাজ সব ছেড়ে দিল, আর কেউ বুযুর্গী হাসিল করতে গিয়ে ওয়াসওয়াসার রোগে আক্রান্ত হল। (ওয়াসওয়াসা বলতে উদ্দেশ হলো- যারা সন্দেহবাতিক হয়ে তিনবার এর জায়গায় সাতবার করে। এক নামাজকে দোহরায়ে বারবার আদায় করে। )
কেউ তার উপর ফরয হওয়া যাকাতটুকুও আদায় করে না, আবার অনেকে বেশী দান করতে গিয়ে সব সম্পদ আল্লাহর জন্য সদকা করে দিয়ে ফকির হয়ে না খেয়ে মরে।
কেউ হয়তো ইবাদতের বিঘœতার আশংকায় বিয়েই করলো না আবার অনেকে খাহেশ মিটাতে গিয়ে হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়লো।
কেউ পরিবারকে উপোস রেখে মসজিদে আর দরগায় পড়ে থাকে, আবার কেউ পরিবারের জন্য উপার্জনের দোহাই দিয়ে রোজা নামাজ ছেড়ে দেয়।
এজন্যই আল্লাহর রাসূল হযরত হানজালাকে বলেছেন, ধীরে..ধীরে.. ধাপে..ধাপে..।
কিন্তু এর অর্থ এই নয়- কখনো কুরআন পড়েন আবার মাঝে মাঝে সিনেমা ছবিও দেখেন। যিকিরও বসুন আবার অবসরে একটু গান বাজনাও শুনুন।
বরং তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, আল্লাহর জন্য ইবাদতের পাশাপাশি তুমি তোমার স্ত্রী ও সন্তানকেও সময় দাও। তাদের সাথে খেলাধুলা ও হাসি গল্প করো। হালাল সীমানার ভেতরে থেকে আনন্দ হাসিতে বিনোদন করো। আবার নামাজের সময় হলে তুমি আল্লাহর জন্য সমর্পিত হও। এভাবে ধীরে ধীরে তুমি অভ্যস্ত হবে জীবন যাপনের সর্বক্ষেত্রে তাকে স্মরণ রাখতে।
এক সাথে এক দমকায় কেউ কখনো আল্লাহ ওয়ালা হতে পারেনি।
ইসলাম মানতে গিয়ে যে সত্যটি আমরা অহরহ ভুলে বসে থাকি, তা হচ্ছে- আল্লাহ আমাদেরকে যে দ্বীন দিয়েছেন তা ঠিক সেভাবেই মানতে হবে যেভাবে তিনি মানতে বলেছেন। এতে যে কিছু সংযোজন করলো তার অপরাধ ঠিক ঐ ব্যক্তির মতোই যে তা ছেড়ে দিল।
তো এই বাড়াবাড়ি কিংবা নিজের জন্য কঠোরতা এবং ছাড়াছাড়ির বা শিথিলতার কী কারণ?
এর একমাত্র কারণ হচ্ছে প্রবৃত্তির অনুসরণ। মনের চাহিদা মতো দ্বীন মানার প্রবণতা এবং এটাই শয়তানের মোক্ষম সুযোগ।
মানুষ তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে করতে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়- যখন তার শিরা উপশিরা এবং নাড়ি নক্ষত্রের চলনগতি প্রবৃত্তির চাহিদামতো হয়ে পড়ে। এভাবে চলতে থাকলে কখনোই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব নয়।
তবে এর সমাধান কী?
এর একমাত্র সমাধান এবং এসব থেকে পরিত্রাণের একটিই উপায়- তা হচ্ছে সঠিক জ্ঞান। সঠিক জ্ঞান এবং এর প্রকৃত চর্চা না থাকলে কারোর জন্য সঠিক বৃত্তে অবস্থান সম্ভব নয়। আমলবিহীন ইলম এর কারণে অনেকেই শেষ পর্যন্ত মুনাফিক হয়ে যায়, আবার ইলমবিহীন আমল করতে গিয়ে মানুষ জড়িয়ে যাচ্ছে বিদআত ও ভ্রান্তির বেড়াজালে।
সূরা নামলের ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, শয়তান তাদের কাজকর্মগুলোকে তাদের কাছে সুন্দর করে উপস্থাপন করে, এভাবেই সে তাদেরকে সঠিক পথ থেকে সরিয়ে দেয় আর কখনোই তারা পথপ্রাপ্ত হয় না। ’
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ পাক সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আমি কি বলে দিব কারা ক্ষতিগ্রস্ত আমলকারী? যাদের সব প্রচেষ্টা (আমল ও ইবাদত) দুনিয়াতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা ভাবছে- তারা খুব পূণ্যের কাজ করে যাচ্ছে। ’
ইসলামের এ উদার ও সরল এবং মধ্যমপন্থার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন ও আদর্শের অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। আর তাই, কোনো অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ নয়, একমাত্র কুরআন ও হাদীসের নিদের্শনার সঠিক মর্ম অনুধাবন ও আমল ই এর সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম সমাধান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।