প্রারম্ভিক কথাঃ
''পুঁজিবাদের সবচেয়ে অনিষ্টকর ফল হল মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের সম্ভাবনাকে পঙ্গু করে দেওয়া। আমাদের সব শিক্ষা পদ্ধতিতে এই অমঙ্গল বিদ্যমান। বেশিরভাগ ছাত্রের মনে একটি তীব্র প্রতিযোগিতার ভাব জন্মায় এবং তাদের শিক্ষালাভের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো কী করে প্রতিযোগিতায় সিদ্ধিলাভ করে ভবিষ¨r জীবনে কর্মক্ষেত্রে উন্নতির শিখরে আরোহন করা যায়। এরা হল সব ক্যারিয়ারিস্ট, নিজেদের জীবনের উন্নতি করে সুখে ও সম্মানে থাকতে চায়। এদের মন সঙ্কীর্ণ ও স্বার্থপর ।
''
আইনস্টাইনের এ উক্তি ‘ফেইসবুকে’ পোস্ট করার পর , আমার স্নেহ ধন্য অনুজা মন্তব্য করে যে,
''ভাইয়া, নিজেকে আমি এই সংকীর্ণ দলে ফেলতে চাই। লজ্জা হয় শুধুই Career নিয়েই চিন্তা তাই। তবে নিজের কাজটা Honestly করি। আমরা সবাই যদি যার যার কাজ করি তাহলে দেশের মঙ্গল অবশ্যম্ভাবী। (........)|''
আমার এই অনুজাটি এই ভাবনার জগতে বা আত্মোপলদ্বির জায়গায় একা নয়।
নতুন প্রজন্মের অনেকের উপলদ্ধিটা এ রকম কাছাকাছি। এদের অন্তরটা এখনও কুলশিত হয়নি। এরা নিজের যোগ্যতায় দেশ মায়ের , মাটি ও মানুষে কল্যাণের ব্যবহার করবার প্রত্যায় এখনও বুকে ধারণ করে আছে। এদের অন্তরে এখনও রয়েছে মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের স্থান। তাই, এরা যখন কেউ 'দিন বদলের' কথা বলে কিংবা 'বদলে যাবার 'শ্লোগান তুলে, তখন সরল মনে, সরল বিশ্বাসে স্বপ্নবান হয়ে উঠে।
তাই তারা দলে দলে ‘দিন বদলের’ পক্ষে ভোট দেয় ( খোদ মার্কিন মুল্লুক থেকে বাংলাদেশে) কিংবা নিজে কে বদলা বার প্রকাশ্য শপথ নেয়। এ শুভ্র মনের অনুভুতিকে অবহেলা করা বা হেয় জ্হানের সুযোগ নেই।
একঃ
২০০২ সালের মে মাসে আমার প্রথম চাকুরী জুটে যায় সিলেটের এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চার্জ হিসাবে। চাকুরীতে যোগদানের প্রথম সপ্তাহেই আমাকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় ছাতক উপজেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে।
ছাতক উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে যে নদীটি চলে গেছে তার স্থানীয় নাম ‘চেলা’।
‘চেলা’ নদী এক বিচিত্র নদী। বিভিন্ন মৌসুমে তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। যে ব্যক্তি শুষ্ক মৌসুমে তার শীর্ণ শান্ত চেহারা দেখেছে , সে কখনও বর্ষার বর্ষণ মুখর দিনে তার হুংকার কল্পনাও করতে পারবে না। বর্ষার সময় উত্তরে সীমান্তবর্তী পাহাড় থেকে 'চেলা' নদীর বুক বেয়ে আকস্মাৎ আগুন রাঙ্গা পানির যে ঢল নেমে আসে তা যে কারও অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেবে।
চেলা নদীর অপর পারে ছাতক সিমেন্ট কারখানার পাশ দিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের যে মাটির রাস্তাটি উত্তর দিকে ভারত সীমান্তের পর্যন্ত চলে গেছে, সে সড়কে কতগুলো ‘সাবমার্জ বক্স কালভার্ট’ বসানোর কাজ তদারকি করাই ছিল আমার দায়িত্ব।
একটা টেকনিকাল বিষয় পাঠক কে জানিয়ে রাখ প্রয়োজন যে , আমাদের মত বর্ষা প্রধান দেশে অধিকাংশ সড়কে কিছু দূর পর পর কালভার্ট স্থাপন করতে হয় , যাতে একপাশের বর্ষার পানির চাপে সড়ক ভেঙ্গে না যায়। আমাকে এ কাজে প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ; পূর্ণ বর্ষা মৌসুমের পূর্বেই সংক্ষিপ্ত সময়ে কাজ শেষ করা ও চুরিজনিত অপচয় রোধ করা।
সড়কটির দুপাশের নৈসর্গিক দৃশ্যও মনোরম। জন বসতি তেমন ঘন নয়। সড়কের এক পাশ্বে বিস্তৃর্ণ ফসলের ক্ষেতে, ক্ষেতে পরে কালো পাহাড়ে সারি আর সে কারো পাহাড়ের বুকে রৌদ্র উজ্জ্বল দিনে চকচক করে ছোট ছোট ঝরনা।
সড়কের ওপর পাশ্বে দেড় -দুশত গজ দূরত্ব রক্ষা করে বয়ে চলেছে চেলা নদী।
আমার কাজের দ্বিতীয় দিন স্থানীয় ক’জন কৃষক সালাম প্রদান করে সামনে এস দাড়ালো। “স্যার; সড়কে কালভার্ট বসিয়ে তো আমাদের সর্বনাশ করছেন”। উত্তরের আমি বললাম,“ তা কেন? কালভার্ট হওয়াতে তো আপনাদের উপকারই হবে। জমিতে জলাবদ্ধতা হবে না , কালভার্ট দিয়ে অতি বর্ষণের পানি তাড়াতাড়ি নদীতে চলে যাবে।
” প্রতিত্তোরে তারা যা জানালো তা শুনে আমি শিউরে উঠলাম। উত্তরের পাহাড় হতে যখন বন্য হাতির মত পানি ঢল নামবে, তখন ‘চেলা’ নদীর বুক বেয়ে মোটা বালু পূর্ন ঘোলা পানি হুড়হুড় করে ঢুকে পরবে কালভার্টে মধ্য দিয়ে আর সে পানি নদীতে ফিরে যাবার সময় ফসলী জমির উপর ফেলে যাবে পুরু মোটা বালির স্তর।
যাবার কালে কৃষকরা আমার কাছে একটা মৌসুম সময় ভিক্ষা চাইলো যেন সে মৌসুমের ক্ষেতের ফসলটা তারা ঘরে তুলে নিতে পারে।
স্থানীয় কৃষকদের সমস্যাটা সে দিন সন্ধ্যায় চায়ের টেবিলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশীর কাছে উত্থাপন করতেই তিনি অতি সরল উক্তি করলেন , “সড়ক ও জনপথের প্রকৌশলী হিসাবে তার একান্ত কর্তব্য হচ্ছে পানির চাপে সড়কটি ভেঙ্গে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা। কৃষকদের উচিৎ পানি উন্নয়ন বোর্ডে প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলা, নদী সংক্রান্ত বিষয়াদি উক্ত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ভূক্ত।
”
স ও জ প্রকৌশলী তাঁর উপর অর্পিত কর্তব্য (সড়ক রক্ষা) যথার্থ (Honestly) পালন করলেন। আমিও আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব সংক্ষিপ্ত সময়ে যথাযথ ভাবে (Honestly) পালন করে ' চেলা' নদীর বুক বেয়ে পাহাড়ী ঢল নামবার পূর্বেই পালিয়ে এলাম।
দুইঃ
ঢাকা শহরের সড়কগুলো প্রায় সারা বছর খোড়া খুড়ি চলতেই থাকে। আজ হয়তো ওয়াসা কতৃপক্ষ রাস্তা খুড়ে পানি লাইন বসালো ; আগামী মাসে আবার একই রাস্তা 'তিতাস' গ্যাস লাইন বসাতে খুরে বসলো। তরাপর হয়তো আরেক জন ·········তার পর।
এ নিয়ে নগরবাসী ক্ষোভের শেষ নেই। এসব প্রতিস্ঠান আর তাদের প্রকৌশলীদের মনে মনে গালমন্দ কম করে না। । কিন্তু সরল চোখে দেখলে, বিভিন্ন দপ্তরের এ নিরন্তন খোড়াখুড়ি তো নগরবাসীর কল্যাণ চিন্তা করেই করছে। সুতরাং নগরবাসীর এ খোড়াখুড়িতে তো অতিষ্ঠ না হয়ে সহনশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়, নয় কি? আমার এ কথা শুনে , সচেতন পাঠক মাত্রই বলে উঠবেন , সকল দপ্ত মিলে একত্রে সম্বন্বিত দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিলে ক্ষতি কি?
তিনঃ
প্রথম আলো পত্রিকা একটি কর্ম সূচী গ্রহণ করেছে ‘ বদলে যাও , বদলে দাও।
’ শ্লোগান নিয়ে। কর্মসূচী টি ব্যাপক সারা সৃষ্টি করেছে সারা দেশব্যাপী। বিশেষ করে যেখানের আমাদের অপরাপর কর্মসূচী গুলো দিন দিন একান্তই রাজধানী কেন্দ্রিক হয়ে পরেছে, সেখানে ‘ বদলে যাও , বদলে দাও। ’ শ্লোগান নিয়ে উদ্যোগতারা যে ভাবে সারা দেশব্যাপী ঘুরে বেড় হচ্ছে , তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। মফস্বলের নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুটা হলেও নতুনত্বে স্বাদ, বৈচিত্রের আনন্দ আনছে।
প্রথম আলোর পাতায় প্রত্যহ দেখছি কি উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে মানুষ নিজে কে বদলে ফেলার অঙ্গিকার করছে। একজন আশাবাদি মানুষ হিসাবে , আমি বিশ্বাস করি প্রতি টি মানুষ একান্ত সততার সাথেই এ অঙ্গিকার করছে এবং অঙ্গিকারে সাথে সাথে নিবেদিত প্রাণ ভাবে নিজেকে বদলে ফেলায় সচেষ্ট হয়ে উঠেছে।
কিন্তু , প্রশ্ন হচ্ছে এক একজন মানুষের বিছিন্ন একটি একটি শপথ সত্যই কি একদিন দেশটাকে প্লাটে দিবে আমাদের দীর্ঘদিনের লালায়িত স্বপ্নে মত করে?
চারঃ
আমরা যে বিশ্ব ব্যবস্থায় বাস করছি তা হচ্ছে পুজিবাদ। পুজিবাদের উন্মেষকালে ইউরোপের রেঁনেসার যুগে এ পুজিবাদী ব্যবস্থা সামান্তীয় সমাজ ব্যবস্থার আগলে বন্দী মানবতার মুক্তির পতাকাকে ঊর্দ্ধে তুলে শ্লোগান তুলে ছিল ‘ব্যক্তিস্বাধীনতার’। বিংশ-একবিংশ শতাব্দিতে এ পুজিবাদী ব্যবস্থা নিজেই যখন ক্ষয়ীসঞ্চু হযে পরেছে , তখন ব্যক্তিস্বাধনিতা কে এমন এক স্তরে নিয়ে গেছে , তার নাম ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা’।
একই সমাজে বাস করেও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি আজ যোজন যোজন দূরে অবস্থান করে। এক এক ব্যক্তি আজ একজন বিছিন্ন একটা দ্বীপের বাসিন্দার। নতুন প্রজন্ম বড় হয়ে উঠছে এমনি একটি বিছিন্ন দ্বীপে; একান্ত নিজেস্ব চিন্তার জগতে। সে জগতের ভাষা অপরে থেকে আলাদা। এক অপরে ভাষা বুঝে না।
বুঝতেও চায না। কারণ সে শিক্ষা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা তাকে দেয় না। তাদের শুভ্র মন বদলে যাবার যে স্বপ্ন দেখে তাও ছিন্ন ছিন্ন। এ ছিন্ন ছিন্ন স্বপ্নগুলো কখনই একটি সামগ্রিক রূপে বিমুর্ত হয়ে উঠতে পারে না।
ব্যক্তির এ নিঃসঙ্গতা একান্ত আমাদের দেশের চিত্র নয়।
বরং , শক্তিশালী পুজিবাদী ব্যবস্থায় সংকটটি আরও প্রকটতর। আমাদের দেশে পুজিবাদ তার শোষন আরও যত শক্ত করবে, তার নিজ অস্তিত্তেব প্রয়োজনের মানুষ থেকে মানুষ কে আরও দূরে ঠেলে দিবে; যেন মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে পুজিবাদী শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠতে না পারে।
সাম্পতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিরোধী বা গ্লোবালাইজেশন বিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশগুলো দিকে যদি গভীর ভাবে তাকাই ; তবে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে অংশ গ্রহণকারীর সংখ্যা কিংবা বৈচিত্রময়তার দিক থেকে আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রতিবাদ প্রতিরোধের তুলনায় অনেক বেশি কলোবর পূণৃ হলেও ,পুজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থায় তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। কেন না, বিক্ষোভগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা আসে একান্ত ব্যক্তিগত শুভবুদ্ধির স্থান থেকে। কিন্তু শুভবুদ্ধিগুলোর মাঝে কোন আন্তঃসংঘাত না থাকায় কোন বন্ধন তৈরি হয় না।
গড়ে উঠে না কোন কার্যকর নিরবিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ সংগ্রাম কিংবা বদলে যাবার সম্মিলিত প্রয়াসের সংস্কৃতি ।
সব কথার সারকথাঃ
‘একটি একটি শপথে একদিন বদলে যাবে দেশ’- এ প্রত্যাশা না করে, আসুন হাতে হাত ধরে সকলে সম্মিলিত কণ্ঠ শ্লোগান তুলি ,“ সম্মিলিত শপথে একদিন বদলে দিবো দেশ। ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।