আমি নীল, আমি কালো, আমি মন্দ হয়েও ভালো
দেয়াল ঘড়িতে ভোর চারটা বেজে একত্রিশ মিনিট।
বসার ঘরের সিলিং ফ্যান থেকে ওড়না দিয়ে তৈরি ফাঁস ঝুলছে। তার ঠিক নিচে বরাবর চেয়ার রাখা।
চেয়ারের পিঠে হাত ভর দিয়ে মিতা দাঁড়িয়ে আছেন। চুল এলোমেলো, চোখের জল আর কাজল লেপ্টে আছে দুই গালে।
স্বামী নূর চৌধুরীর সাথে তাঁর বনিবনা হচ্ছে না অনেক দিন ধরে। কয়েকবার মায়ের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন তিনি, প্রতিবার সন্তানদের মুখ চেয়ে এবং মুরুব্বীদের সমঝোতায় আবার ফিরে এসেছেন।
আর নয়, এতো কলহ, আবার সব ঠিক করার চেষ্টা, আবার দু দিন পর কলহ, আর সহ্য করা যায় না।
থাকুক, নূর ওর মতো ভালো থাকুক, মিতাকে ওর জীবনে দরকার নেই।
মিতা কাঁপা কাঁপা পায়ে চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়ালেন।
দু হাতে ফাঁসটা ধরে তাকিয়ে রইলেন।
আর মাত্র কয়েকটা মিনিট, তারপর এই প্রতিদিনের যন্ত্রণা থেকে চিরমুক্তি !
খুট করে শব্দ হলো। বাচ্চাদের ঘরের আলো জ্বলে উঠলো।
নিশ্চয়ই বাবাই। বাবাইর রাত বিরেতে খিদে পাবার অভ্যেস আছে, ওর জন্য মিতা কে নানান পদের নাস্তা তৈরি করে ফ্রিজে রেখে দিতে হয়।
ছেলে মাইক্রোওয়েভে গরম করে খায়। এই বয়সী কিশোর ছেলেরা বাইরের খাবার খাওয়ার জন্য পাগল থাকে, অথচ বাবাইর সমস্ত আগ্রহ মায়ের হাতের রান্না খাবার জন্য।
বাবুনীও হতে পারে। বাবুনী মাঝে মাঝে রাতে স্বপ্ন দেখে ভয় পায়। তখন মিতাকে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হয়।
বাবুনীর চুলের ছোট্ট ঝুঁটি দুটো আলতো করে টেনে না দিলে তখন তার ঘুম আসে না। মেয়েটার মাথায় চুমু দেবার সময় বেবী শ্যাম্পুর ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
ছেলে-মেয়ের মুখ দুটো চোখের সামনে ঘুরতে লাগলো মিতা নূরের। হটাত নিজের দুহাতের দিকে তাকালেন তিনি। দু হাতে এখনো ধরে আছেন ফাঁসটা।
তাঁর দুই সন্তানের জীবন থেকে চিরতরে সমস্ত আনন্দ মুছে দিতে যাচ্ছে এই ফাঁস। বাচ্চা দুটো আর কখনো কাউকে মা বলে ডাকতে পারবে না। বাবাইকে কেউ আদর করে মুখে তুলে খাওয়াবে না ওর পছন্দের মায়ের হাতের রান্না। বাবুনীকে কেউ আদর করে গোসল করিয়ে পিচ্চি পিচ্চি কোঁকড়া চুলে পিচ্চি দুটা ঝুঁটি করে দেবে না।
মিতার গায়ে হটাত করে অপার্থিব শক্তি ভর করলো।
এক হ্যাঁচকা টানে তিনি ছিঁড়ে ফেললেন ফাঁসটা।
কাঁপা পায়ে চেয়ার থেকে নামলেন মিতা। কয়েকমুহূর্ত আগে কি সর্বনেশে পদক্ষেপ তিনি নিতে যাচ্ছিলেন তা ভেবে বুকটা হিম হয়ে যাচ্ছে তাঁর। কিন্তু মুখটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
আলতো পায়ে হেঁটে বাচ্চাদের রুমে ঢুকলেন তিনি।
যা ভেবেছিলেন তাই। বাবাই পড়ার টেবিলে বসে, সামনে থালায় মিতার বানানো পাস্তা। খেতে গিয়ে দু এক টুকরো এদিক সেদিক ফেলছে, এখনো গুছিয়ে খেতে শিখলো না ছেলেটা। বাবাইর মাথায় হাত রাখলেন তিনি।
ছেলে চমকালো না, জানে মা মাঝে মাঝে দেখতে আসেন ওরা ঠিক মতো ঘুমাচ্ছে কিনা।
মিতা পাশে বসে ছেলের হাত থেকে কাঁটা চামচটা নিলেন, মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন বাকি খাবার টা।
মিতার এক পাশে বাবুনী, আরেক পাশে বাবাই। বাবাই প্রায়ই মা কে কাঁদতে দেখে, আব্বুর সাথে ঝগড়া হলেই মা কাঁদেন। কিন্তু এই প্রথম মায়ের কান্না ভেজা চোখের সাথে মুখে হাসি দেখতে পাচ্ছে সে। কি করবে বুঝতে না পেরে সে মাকে জড়িয়ে ধরল।
ঘুমন্ত বাবুনীর মাথা হেলে মিতার কাঁধে ঠেকলো।
দুটো কচি শরীরের স্পর্শ লাগছে মিতা নূরের দেহে। আরেকবার বিবেকের দংশনে বিদ্ধ হলেন তিনি। এটা কি করতে যাচ্ছিলেন??? এই দুটো বাচ্চা এতিম হয়ে গেলে কি ভাবে এই দুনিয়ায় চলতো মা ছাড়া??
নূর এর সাথে মানিয়ে নেবার আরেকটা চেষ্টা করতে হবে। এটাই শেষ চেষ্টা।
যদি এবার ঠিক না হয়, তাহলে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু নিজেকে শেষ করে দেয়া না। মিতার জীবন তাঁর একার না, এই কচি মুখ দুটোর অধিকার আছে তাঁর উপরে।
মিতা নূর তাঁর দুই সন্তানকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে বাবাই আর বাবুনীকে নিয়ে ঘুরে আসবেন দূরে কোথাও।
মা আর তাঁর দুই ছানা মিলে কিছুক্ষণের জন্য সব ঝামেলা থেকে দূরে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, তার পর একটু সুস্থির হয়ে ঝামেলা মোকাবেলা করবে শক্ত হাতে।
লেখকের কথাঃ পাঠক বুঝতেই পারছেন এই গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আমাদের প্রিয় অভিনেত্রী মিতা নূর জীবনের উপর অসম্ভব বিতৃষ্ণা নিয়ে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। তাঁর বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবনের অসংখ্য অর্জন পেছনে ফেলেছেন, পেছনে ফেলেছেন তাঁর দুটি জীবন্ত অর্জন, তাঁর দুই সন্তান। এই ছেলে মেয়ে দুটো অতি অল্প বয়সে যেই ভয়ঙ্কর নির্মম জীবনের সামনে এসে দাঁড়ালো, এরা কি সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে বেড়ে উঠতে পারবে??
আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়।
কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাওয়ার জন্য আপনাদের বাবা মা কষ্ট করে মানুষ করেন নাই। সমস্যা হলে সেটা ফেইস করুন, যদি সমাধান না করতে পারেন তাহলে নিজের আত্মসম্মানটুকু নিয়ে দূরে সরে যান। আত্মহত্যা শুধু একটা মানুষকে শেষ করে না, একটা পরিবারকেও শেষ করে দেয়।
মিতা নূর মারা গেছেন আজ পয়লা জুলাই দিবাগত রাতে। প্রাথমিক ভাবে তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং প্রাথমিক ভাবে দাম্পত্যকলহ থেকে অবসাদগ্রস্থতা এই নির্মম পরিনতির কারণ হতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
আমার লেখার উদ্দেশ্য মিতা বা তাঁর স্বামীকে হেয় করা নয়। শুধু মাত্র কয়েকমুহূর্তের উপলব্ধি এবং জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাবার ইচ্ছা থেকে কত বড়ো একটা দুর্ঘটনা এড়ানো যেতো, এটাই দেখাতে চেয়েছি মাত্র।
বিডিনিউজ২৪ এ মিতার মৃত্যু সংবাদ দেখুন এখানে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।