হারিয়ে যাওয়ার মাঝে ছড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত আনন্দ। আমি তাই হারিয়ে যাই। একবার নয় দুবার নয়, আমি বারবার হারিয়ে যাই মানুষের ভিড়ে... বিকেলের রোদ এসে পড়ছে রায়ানের মুখে। তাকিয়ে রয়েছে জীবনের উৎসে দিকে। উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা।
সবুজের মাঝে লাল সূর্য আঁকা। সূর্য ডুবে যেতে পতাকাটা নামিয়ে দিল একজন সৈনিক। ফিরে কোয়ার্টারের দিকে রওনা হল রায়ান। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। ব্ল্যাক ফাইটারসের স্পেশাল ট্রেনিং ক্যাম্পে আছে ও।
শিখাতে নয়, শিখতে! শায়খের মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেছিল ও। এছাড়া হাতেও গুলি খেয়েছিল। ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছিল। বিশ্রামের নামে সরে গিয়েছিল রায়ান। নিজের খেয়াল রাখেনি বিন্দুমাত্র।
দু'মাস পরে অনেক খোঁজার পর ওকে মেক্সিকো থেকে উদ্ধার করে জেসন। ততদিনে ও ফিটনেস হারিয়ে ফেলেছে পুরোপুরি। মানসিকভাবেও আধপাগল। দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা সাথে থেকে, নিরলসভাবে খেটে, অনেকভাবে বুঝিয়ে রায়ানকে মানসিকভাবে সুস্থ করে তুলে জেসন। এরপর ওকে নিয়ে চলে আসে ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে।
একমাস যেতে না যেতেই আগের ফিটনেস ফিরে পেয়েছে রায়ান। আর পাবে নাই বা কেন? নিজের জন্মভূমিতে, বিশ্বের সেরা ট্রেইনারদের অধীনে এবং জেসনের কড়া তত্বাবধানে থেকে ও নিজেকে ফিরে না পেয়ে পারে?
আজই এবারের মত ওর ট্রেনিংএর শেষদিন । রাতে ফিরে যাবে হেডকোয়ার্টারে। নিজের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিল । শোল্ডার হোলস্টারে পিস্তলটা রাখতেই দরজায় আওয়াজ হল।
তিন বার টোকা পড়তেই ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে এল রায়ান। বাহিরের মাঠে অপেক্ষমান হেলিকপ্টারে উঠল দুজনে। কয়েকঘন্টা পর হঠাত্ এন্ঞ্জিন কেঁশে উঠল। ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারল না ওরা। জেসন পাইলট সীটে ছিল।
কন্ট্রোলের উপর উড়ে চলল ওর হাত। কিন্তু কোন ক্রুটি খুঁজে পেল না। এদিকে এন্ঞ্জিনের ফটফট শব্দ আরও জোড়ালো হয়েছে। কিছুতেই সমস্যার কোন সমাধান পেল না ওরা। ঠিক তখনই মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে এন্ঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল।
কন্ট্রোল কলাম নিয়ে টাঁনাহেচড়া করতে লাগল জেসন। হঠাত্ বাতাসের ধাক্কায় কপ্টাররা গোত্তা খেল। দরজার বাড়ি খেয়ে রায়ানের কপাল ফেটে গিয়েছে। নিজেকে সামলে ইমার্জেন্সী ব্যাকআপ ইন্ঞ্জিন চালু করার জন্য চেঁচাল জেসনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেখানে জেসনের নিথর দেহ পড়ে আছে।
দ্রুত ওকে চেক করে বুঝতে পারল রায়ান যে ও জ্ঞান হারিয়েছে। তাই জেসনের সিটবেল্টটা শক্ত করে বেঁধে দিয়ে কো-পাইলটের কন্ট্রোল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল ও। প্রথমেই ব্যাকআপ ইন্ঞ্জিন চালু করল। এরপর নির্দিস্ট ফ্রিকোয়েন্সীতে মেডে পাঠানোর চেষ্টা করল। তবে মেডে যাচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারল না।
হঠাত্ চোখের সামনে সব সাদা দেখল রায়ান। এরপর প্রচন্ড একটি ধাক্কা তারপর সব কালো। নিকষ কালো অন্ধকার।
জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে একটি সাজান গোছান ঘরে আবিষ্কার করল রায়ান। কিছুতেই বুঝতে পারল না যে কিভাবে ও এখানে এল।
অভ্যাসবসত বালিশের নিচে হাত দিয়েও কোন পিস্তল পেল না। তখন চুপচাপ ভাবতে বসল। ট্রেনিং সেন্টার, কপ্টার, এক্সিডেন্ট, আহত জেসন, ক্র্যাশ! এটুকু মনে করতে পারল, কিন্তু এরপরের ঘটনা কিছুতেই মেলাতে পারল না। আপাতত রহস্য অমিমাংসিত রেখেই বাথরুমে ঢুকে গেল। শাওয়ারের পানিতে শরীর ভিজিয়ে ঘরে ঢুকে আলমারিতে ওর মাপের সব স্যুট, জ্যাকেট, ব্লেজার ইত্যাদি পেল।
ধূসর একটি স্যুট বেছে নিল ও। এরপর ২দিনের না কামানো মুখ শেভ করল। হঠাত্ ঘরের দরজায় নক হল। দরজার দিকে না তাকিয়েই বলল,
-কাম ইন।
একজন মেইড ঢুকল।
টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রেখে বের হয়ে গেল দ্রুত। রায়ান কোন প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না। একটু পর খাওয়া শেষ হতেই ঐ মেইড ফিরে এসে প্লেট-বাটি গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। ঘরের একজায়গায় কিছু পুরনো খবরের কাগজ পেল রায়ান। সময় কাটানর জন্য সেগুলোই পড়া শুরু করল।
যেদিন এক্সিডেন্ট হল তার পরের দিনের পেপারের হেডলাইন দেখে চমকে উঠল রায়ান। সেখানে দুজন বাংলাদেশীর মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। একজন জেসন আরেকজন অন্য কেউ না, রায়ান নিজে।
সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল রায়ানের মাথায়। বের হওয়ার জন্য দরজার কাছে গেল রায়ান কিন্তু দরজাটি বন্ধ ।
এক মুহুর্ত দ্বিধা করে পিছিয়ে এসে দরজায় ঝাঁপিয়ে পড়ল রায়ান। দরজাটা খুলে গেল হঠাত্ করে এবং বাহিরের আগন্তুককে নিয়ে ভূপাতিত রায়ান। নিজেকে সামলে নিতেই আবিস্কার করল আগন্তুক একজন মেয়ে। লালচে কাল চুল, সাদা বর্ণের এক মেয়ে। রায়ানের মারমুখো ভঙ্গি দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
পিছন থেকে একজন প্রহরী রায়ানের পিঠে মেশিনগান তাক করতে যেতেই মেয়েটি হাতের ইশারায় নিষেধ করল। রায়ানকে নিয়ে ওর ঘরে প্রবেশ করার পর ওকে বলল,
-মারপিট করার জন্য মুখিয়ে থাকেন মনে হচ্ছে? আরেকটু হলেই তো আমাকেও খুন করে ফেলছিলেন সেই সাথে নিজেকেও।
-ইটস নাথিং। জাস্ট একটু এক্সারসাইজ করছিলাম। তবে মাঠে যে পাগলা কুকুর ছেড়ে রাখা তা জানতাম না।
ধন্যবাদ, মিস?
-রিনিস।
-হুম। তা আমি কোথায় আছি জানতে পারি?
-নিশ্চয়ই। আপনি এখন আছেন গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে। আগেও এদিকে এসেছেন নিশ্চয়ই।
-হ্যাঁ এসেছিলাম। তবে বেশী কিছু দেখার সময় পাইনি। তা আপনারা কারা? আর পাহাড়ী বনের মধ্যে এরকম হাইফাই দালান কবে তৈরি হল ঠিক বুঝতে পারছি না।
-আমরা বেশ কয়েক বছর ধরেই জায়গাটা ব্যবহার করছি। আর আমরা অতিথি তেমন পছন্দ করি না।
তাই আরকি মানুষ আমাদের কথা জানেও না। চলুন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি?
-আফটার ইউ।
দরজা খুলে সরে দাঁড়াল রায়ান।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটি খোলা ব্যলকনিতে এসে দাঁড়াল। নিচে একটি নদীর কালো পানি চিকচিক করছে।
যদিও অনেক নিচে। বিশাল প্রাসাদের মত বাড়িটা পাহাড়ের খাড়া ঢালের মাঝে তৈরি করা। বোঝাই যায় প্রচুর টাকা আর বুদ্ধি খরচ করতে হয়েছে এর পেছনে। পালানোর কোন পথ খুঁজে পেল না রায়ান। কথা বলা শুরু করল রিনিস,
-কি সুন্দর জায়গা তাই না?
-প্রেমালাপ করার জন্য এর চেয়ে ভাল আরও অনেক জায়গা আছে।
ক্ষণিকের জন্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল রিনিস। নিজেকে সামলে নিল দ্রুতই। বলল,
-নিয়তি বলেও তো একটা কথা আছে। কখন কোথায় কি হয় তার কোন হদিশ কি আমরা জানি?
-না জানাই ভাল। আমাকে একটু ক্ষমা করতে হয়।
আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।
-সিউর। আমি অপেক্ষা করছি।
নিজের ঘরে ফিরে এল রায়ান। সকালে ঘরের গোপন ক্যামেরাগুলোই শুধু খুঁজে বের করেনি।
সেই সাথে খেয়াল করে দেখেছে ওর পুরনো কাপড়, ব্যবহার্য সব জিনিস সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু ওর ঘড়িটা ছাড়া। কায়দা করে ক্যামেরার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘড়িটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকল ও। ঘড়িটা লুমিনক্স রিকন সিরিজের। এরমধ্যে ব্ল্যাক ফাইটারসের টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের এক্সপার্টরা অনেক কায়দা করে দুটো চোখের অপটিক্যাল লেন্স লুকিয়ে রেখেছে।
লেন্সগুলো তাঁদের আবিষ্কৃত অত্যাধুনিক সেন্সর স্ক্যানার ডিভাইস। এগুলো ব্ল্যাক ফাইটারসের সেন্ট্রাল ডাটাবেজের সাথে যুক্ত। বিভিন্ন ধরণের বিশ্লেষণ, এনকোয়্যারি, সার্চ ফর ম্যাচ, হিসেব করা যায় এ ডিভাইসগুলোর সাহায্যে। এগুলো কেউ ত্নীক্ষ দৃষ্টিতে তাকালেও চিহ্নিত করতে পারবে না। লেন্সগুলো সাবধানে পড়ে নিল রায়ান।
এরপর ঘড়িটা পরে স্বাভাবিকভাবে বের হয়ে এল। লেন্সের এনালাইসিস করা প্রতিটা রেজাল্ট চোখের সামনে ভাসছিল রায়ানের। মনে মনে টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টের প্রশংসা না করে থাকতে পারল না। ব্যালকনিতে ফিরে এল রায়ান। রিনিস ওকে দেখে একটু হাসল।
রায়ানের হাত ধরে ব্যালকনির এমাথা ওমাথা হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-তোমার আর আমার মধ্যে অনেক মিল। আসলে একই পেশার মানুষ তো। তাই মিল থাকা অস্বাভাবিক না।
-একই প্রফেশন?
-আমাকেও একজন এসপিওনাজ এজেন্ট বলতে পার। আমি একটি ছোটখাট তবে উপযুক্ত টিমের সাথে আছি।
-নাম?
-চিনবে না তুমি। কারণ তোমার ডাটাবেজে তো দূরের কথা দুনিয়ার অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাদের কোন রেকর্ড নেই। আমরা আড়ালে কাজ করতেই পছন্দ করি।
-এসব কথা আমাকে বলার কি প্রয়োজন?
-প্রয়োজন আছে। আমাদের টিমের তেমন কোন পরিচিতি নেই তা তোমাকে আগেই বলেছি।
আমরা তোমার মত কোথাও প্রভাব খাটাতেও পারি না। কিংবা বলা ভাল এখন পর্যন্ত পারি না। তাই তোমাকে আমাদের হয়ে একটা ছোট কাজ করে দিতে হবে।
সতর্ক হয়ে গেল রায়ান।
-কি কাজ?
-তেমন কিছুই না।
জর্ডান বার্কের নাম শুনেছো? সেই ডাবল এজেন্ট?
-সি.আই.এ এবং এম.আই.সিক্সটিন দুটোকেই নাকে দড়ি লাগিয়ে ঘুরিয়েছিল যে সে?
-ঠিক তাই। ইউ হ্যাভ এ শার্প মেমরী।
চুপ থাকল রায়ান।
-সেই জর্ডান বর্তমানে অবস্থান করছে মস্কোয়। কে জানে হয়ত আমেরিকান, ব্রিটিশদের লুঠ করার পর হয়ত রাশানদের ক্ষেতেও একটু আগুন দেয়ার প্ল্যান করেছিল।
রাশিয়ান ইন্টেলিজেন্সের হাতে ধরা পড়েছে এখন। আমি চাই তুমি তাকে তোমার পাওয়ার ব্যবহার করে ওদের কাছ থেকে এনে আমার হাতে তুলে দাও।
মনে মনে আঁতকে উঠল রায়ান।
-অসম্ভব। রাশিয়ানরা তাদের বন্দিদের ব্যাপারে এমনিতেই সেনসিটিভ।
আর জর্ডান বার্কতো রীতিমতো নিউক্লিয়ার বম্ব। সি.আই.এ এবং এম.আই.সিক্সটিনের বহু ক্লাসিফায়েড ইনফরমেশন আছে ওর কাছে। এছাড়াও রাশানদের কোন ইনফরমেশন চুরি করে থাকলে তো কিছুতেই ওকে জীবিত ছাড়বে না। আমি কেন, দুনিয়ার কারও কাছেই ছাড়বে না।
একমুহুর্ত ভাবল রিনিস।
এরপর মুখ খুলল,
-সেক্ষেত্রে যেভাবে পার ওকে আমার হাতে তুলে দেবে।
রায়ান আপত্তি করতে যাচ্ছিল কিন্তু ওকে কোন সুযোগ না দিয়ে বলে গেল রিনিস,
-দেখ আমরা তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছি। শুধু তোমার প্রাণ নয়, তোমার সঙ্গীর প্রাণও বাঁচিয়েছি।
ঠিক এই ভয়টাই করছিল রায়ান। এতক্ষণ মনে আশা ছিল হয়ত জেসন এদের হাতে পড়েনি।
এখন দেখা যাচ্ছে সবদিক দিয়েই রায়ান বিপদে পড়েছে। বলে চলল রিনিস,
-তার বিনিময়ে আমরা তোমার কাছ থেকে এই সামান্য একটা উপকার আশা করতেই পারি। আর অন্যভাবেও ব্যাপারটা দেখতে পার। ধর এ লাইফ পর এনাদার লাইফ। তুমি আমাকে জর্ডান দেবে আর আমি তোমাকে জেসন।
ডিল?
-ওকে। ডিল। আই নিড মাই গিয়ারস। আমাকে ফিরতে হবে।
-হোল্ড অন টাইগার।
তুমি কোথাও যাচ্ছ না। আগে আমার কথা পুরোপুরি শুনে নাও। এজেন্ট রায়ান এবং এজেন্ট জেসন এখন মৃত। তারা একটি এক্সিডেন্টে মারা যায়। তাদের লাশও পাওয়া গেছে।
দাফন কাফন সব শেষ।
-তারমানে তুমি আগেই জানতে যে আমি আমার পাওয়ার খাটিয়ে জর্ডানকে বের করতে পারব না?
-ঠিক তাই। এখন তোমার বর্তমান অবস্থা শুনো। তুমি তোমার দলের কারও সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পারবে না। গিয়ার যা প্রয়োজন সব আমাদের কাছ থেকেই পাবে।
টিম বলতে আমাদের দুইজন এজেন্ট দেব আমি। ওরা যে কোন কাজের জন্য উপযুক্ত। তোমার উপর ওরা নজরও রাখবে। তবে আমার মন হয় না তার প্রয়োজন আছে। কারণ ইন্স্যুরেন্স হিসেবে মেজর রায়ান তো আছেই আমার কাছে।
তুমি একসপ্তাহ সময় পাচ্ছ। এরমধ্যে তোমাকে আমরা জর্ডানের পজিশনসহ অন্যান্য তথ্য জানাব। তোমাকে একসপ্তাহের মধ্যে খেলাটা জিততে হবে। গুপ্তধন আমার হাতে দিবে আর আমি তোমাকে প্রাইজ। টাইম ওভার অথবা কোন রুলস ব্রেক করলে কোন প্রাইজ পাবে না।
জাস্ট গেম ওভার হয়ে যাবে। ক্লিয়ার?
-ক্লিয়ার।
-ওকে। এখন আজকের দিনটা তাহলে তুমি এদিকওদিক ঘুরেফিরে কাটাও। পালানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।
একটাই বের হবার পথ এখানে। সেটাও সিকিউর করা। তাছাড়া তোমার প্রাইজ এখানে নেই। ওকে না নিয়ে তুমি যেতেও পারবে না। আর প্রাইজের চেহারা চাইলেও তোমাকে দেখান হচ্ছে না।
আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে।
জবাবে তাচ্ছিল্যে ভরা একটি হাসি দিল রায়ান। এরপর রিনিস ভদ্রতার সাথে ওর কাজ আছে বলে চলে গেল। রায়ান প্রাসাদের ভিতরে কিছুক্ষণ ঘুরল। কয়েকজনের সাথে আলাপ করার চেষ্টা করল কিন্তু কেউই কোন তথ্য দিল না ওকে।
ঐ ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে যাওয়ার অনুমুতিও পেল না রায়ান। কিছুক্ষণ পর রিনিসকে দেখতে পেল। রাতে ডিনারের প্রস্তাব দিল মেয়েটি। ডিনারে হালকা সেজেগুজে এল সে। রায়ানের কাছে বেশ লাগছিল ওকে।
তবে সভাবসুলভ নির্লিপ্ত ভাবটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারল না মেয়েটির কারণে। নানান রকমের ব্যাপার নিয়ে ওর সাথে আলাপ হল রায়ানের। তবে প্রফেশনাল কোন ব্যাপারে প্রায় কোন কথাই হল না। ব্যক্তিগত ব্যাপারে বিভিন্ন কথা হল, কথা হল পরষ্পরের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে। দুজনের দুরত্ব অনেক কমে এল।
সুন্দর একটি সম্পর্ক তৈরি হল ওদের। হঠাত্ হেঁটে গিয়ে গিয়ে সাউন্ড সিস্টেমে একটি ভায়োলিন মিউজিক প্লে করল রায়ান। রিনিসকে অফার করল নাচার জন্য। লাজুক হেসে রাজি হয়ে গেল রিনিস। কিছুক্ষণ নাচার পর আবার সোফাতে বসে গল্প শুরু করল।
এরিমধ্যে রায়ানকে সৌরভ ডাকতে শুরু করল রিনিস। তবে ওর পুরো নামটি কিছুতেই বের করতে পারল না রায়ান। একসময় গল্প করতে করতে দু'জনেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যেই রায়ানের কাঁধে ঠাই হল রিনিসের মাথার।
সকালে আগে ঘুম ভাঙল রায়নের।
নিজের কাঁধে রিনিসের মাথা দেখে মৃদু হাসল। সাবধানে ওকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। রিনিসের ব্যপারে সেন্ট্রাল কম্পিউটার কিছুই বলতে পারেনি। সময় নিয়ে শাওয়ার নিল রায়ান। বের হয়ে ড্রেসআপ করে ব্রেকফাস্ট করে নিল।
টাইয়ের নট বাঁধছিল এমন সময় রিনিস এল। ওর টাইয়ের নটটা বেঁধে দিল। তারপর ওকে নিয়ে সোজা এসে উঠল এলিভেটরে। এলিভেটর এত দ্রুত মুভ করল যে প্রত্যক্ষভাবে কোন ফ্লোরে পৌঁছল তা বুঝা গেল না। তবে রায়ানের সেন্সর ডিভাইসকে ফাকি দিতে পারল না।
ওরা ৭ ফ্লোর নিচে নেমেছে। লিফটের দরজা খুলে যেতে নিজেকে একটি টেকনিক্যাল ল্যাবে আবিস্কার করল রায়ান। ল্যাবটি সবধরণের আধুনিক ফ্যাসিলিটিতে সাজানো। রিনিস ওকে পুরো ল্যাব ঘুরিয়ে দেখাল। এরপর ওকে নিয়ে এল ল্যাব হেডের কাছে।
তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ভদ্রলোকের নাম জুলিয়াস শেফার্ড। দেখে কাজের প্রতি নিবেদিত লোক বলেই মনে হল রায়ানের। রায়ানকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল ওর দুই টিমমেটের সাথে। দুজনেরই রায়ানের মত গড়ন, শক্তিশালী, ট্রেইনড।
ওরা দুইভাই। নেড এবং ফ্রেড উইলিয়াম। ওরা রায়ানের নেতৃত্বে কাজ করবে। এবার সংগৃহীত তথ্যগুলো রায়ানকে জানান শুরু করল রিনিস,
-জর্ডান বার্ককে ব্ল্যাক ডলফিন প্রিজনে রাখা হয়েছে।
রায়ানের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য এক মুহুর্ত অপেক্ষা করল রিনিস।
তবে রায়ান অনড় থেকে তাকে হতাশ করল। এবার জুলিয়াস শেফার্ড ওকে বিস্তারিত জানাল,
-সল আইলেতস্ক নামে একটি ছোট শহর আছে রাশিয়ার অরেনবারগে। রাশিয়ান ইন্টেলিজেন্সের কিছু টপ সিক্রেট ফাইল চুরি করার দু'দিনের মধ্যে টের পেয়ে যায় ওরা। সাথে সাথে ওকে হন্যে হয়ে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিল। ৩দিন পর ওকে মস্কোয় গ্রেফতার করে একজন অফিসার।
তবে আমাদের জানামতে ওর কাছ থেকে কোন ইনফরমেশন পায়নি রাশানরা। তাই তারা জর্ডানের উপর কিছু সত্য-মিথ্যে কেস সাজিয়ে ওকে আজীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে ব্ল্যাক ডলফিন প্রিজনে পাঠিয়ে দিয়েছে।
রায়ান প্রশ্ন করল,
-ব্ল্যাক ডলফিন সম্পর্কে কি জানেন আপনি?
-আজীবন কারাদন্ডে দন্ডিত আসামীদের জন্য রাশিয়ার ৫টি প্রিজনের একটি ব্ল্যাক ডলফিন। এই টাইপের আসামীদের যখন তখন পালাতে ইচ্ছে হয়। তাই সিকিউরিটির কথা আর ব্যাখ্যা করতে হবে না আশা করি।
অরেনবারগ থেকে বেশী দূরে না শহরটা। ব্ল্যাক ডলফিনের সিকিউরিটি ভীষণ কড়া। আমার মতামত চাইলে বলতে পারি ইমপসিবল। দ্যাটস অল।
এবার প্রশ্ন করল রিনিস,
-কি ঠিক করলে?
-আমার ঠিক করার কি আছে? সব তো তোমরাই ঠিক করে রেখেছো।
-ওকে। তুমি, নেড আর ফ্রেডকে অরেনবারগ পর্যন্ত লিফট দিচ্ছি আমি বিকেলে। এর মধ্যে তোমার যা যা দরকার নিয়ে তৈরি হয়ে নাও। সি ইউ ইন আফটারনুন। বাই।
উইলিয়াম ব্রাদারসদের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় অস্ত্রপাতি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বাছাই করে নিল রায়ান। এরপর ওদেরকে ঘুমোতে বলে নিজেও ঘরে ফিরে এসে বিকেল পর্যন্ত টানা ঘুম দিল। বিকেলে রেডী হয়ে ল্যাবে চলে এল। সেখানে নেড আর ফ্রেড রায়ানের চোখ বেঁধে অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বনের মাঝে একটি খোলা জায়গায় নিয়ে এল। সেখানে একটি জাম্প জেট টাইপের ছোট বিমান নিয়ে অপেক্ষা করছিল রিনিস।
রায়ানের টিম উঠতেই টেক অফ করল বিমান। অরেনবারগের এক অক্ষ্যাত গ্রামে নামল জেট। রায়ানদের নামিয়ে দিয়েই জেট নিয়ে চলে গেল রিনিস। প্লেন দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কাছাকাছি একটি গোলাঘরের দিকে রওনা হল ওরা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ক্ল্যামোফেজ ড্রেস পড়ে রাতের আধাঁরে ওরা বের হল।
৮ঘন্টা হাঁটার পর গভীর রাতে পৌঁছুল ওরা ব্ল্যাক ডলফিন প্রিজনের কাছাকাছি। নাইটভিশন গ্লাস দিয়ে এলাকাটা এবং প্রিজনের সিকিউরিটি ভালমত দেখে নিয়ে ভোরের দিকে সেই গোলাঘরে ফিরে এল ওরা।
সকাল ১০টার দিকে শহর থেকে রিনিসের একজন লোক এসে একটি প্রিজনার ট্রাক দিয়ে গেল। এরপর রায়ান সাজল বন্দীর বেশে আর দুই ভাই সাজল প্রিজন গার্ডের অফিসারের বেশে। প্ল্যানটা আপাতদৃষ্টিতে খুব সোজা।
ওখানে যারা দায়িত্বে আছে তাদের মধ্যে সবাই অফিসার। নেড-ফ্রেডের সাথে আছে জুলিয়াস শেফার্ডের তৈরি করে দেওয়া পরিচয়পত্র। তাই প্রিজনের ভেতরে বা বাহিরে যেখানে খুশি যাতায়াত করতে পারবে ওরা। আর রায়ান বন্দিবেশে জর্ডানের সাথে আলাপের চেষ্টা করবে। কারণ এত জটিল একটা কাজ জর্ডানকে আগে না জানালে শেষ মুহুর্তে ও ঝামেলা করে বসতে পারে।
শেষবারের মত পরষ্পরের মধ্যে প্ল্যানটা আলোচনা করে বেরিয়ে পড়ল ওরা। রায়ানকে ভ্যানের পিছনের প্রিজনারস ক্যাবে হান্ডকাফে আটকে রেখে ওর সাথে বসল নেড। আর সামনের ড্রাইভিং সিটে বসল ফ্রেড। গুনগুন করে একটি রাশান গান গাইতে শুরু করল ফ্রেড। এই সময়ে ওর গান গাওয়া অদ্ভুত হলেও শুনতে খারাপ লাগল না অন্যদের।
দেড় ঘন্টা পর সল ইলেতস্কে প্রবেশ করল ওরা। প্রিজন ভ্যান দেখে কেউ অবাক হল না। প্রতি মাসেই একবার আসে প্রিজন ভ্যান। তবে এবার ভ্যান একটু আগেই এসেছে। প্রিজনের মেইনগেটে আটকানো হল ওদের।
গাড়ি থামাল ফ্রেড। রাশান ভাষায় ওদের কাগজপত্র চাইল গেটকিপার। ফ্রেড কাগজ দেখাল। এরপর গার্ড পিছনের প্রিজনারস ক্যাবে উঠে রায়ানকে দেখে এল। অন্য একজন গার্ড কুকুর নিয়ে গাড়িটাকে সার্চ করল।
এরপর ওদের ভিতরে যাওয়ার পারমিশন মিলল। ভিতরে সোজা অফিসার ইনচার্জের অফিসের সামনে গাড়ি থামাল ফ্রেড। রায়ানকে নিয়ে নেমে আসতেই তিনজনে রওনা হল অফিসার ইনচার্জের রুমে। ঘরের বাহিরে দুজন সেন্ট্রির দায়িত্বে রায়ানকে রেখে ভেতরে প্রবেশ করল ওরা। অফিসারের পদবী হল লেফটেন্যান্ট।
আর নেড ও ফ্রেডের কাছে যে কাগজ আছে তাতে প্রমান হয় যে ওরাও লেফটেন্যান্ট। সূতরাং জবাবদিহি বা সম্মানের ধারে কাছে গেলনা কেউ। শুধু নিজেদের আসার কারণ জানাল নেড। এছাড়াও জানাল যে প্রিজনের দুজন অফিসারকে ওদের প্রিজন ভ্যান নিয়ে হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই দুজনের জায়গায় ওরা দুজন কাজ করবে এবং নতুন বন্দী ওদের তত্ত্বাবধানে থাকবে।
শুনে কোন আপত্তি করল না জেলার। এরকম ভিআইপি প্রিজনারের সাথে দু-চারজন অফিসার আগেও এসেছে। ওদের সাথে কথা শেষ করে রায়ানকে দেখল জেলার। এরপর কাগজপত্র চেক করে রায়ানের জন্য সেল বরাদ্ধ করল আর নেড-ফ্রেডকে কোয়ার্টারে দু'টো রুম দিল। একজন সেন্ট্রিকে বলল রায়ানকে সেলে রেখে আসতে।
আর নিজে গিয়ে নেড-ফ্রেডের রুম দেখিয়ে দিল। বিকেলে দু'জন অফিসারকে ভ্যানসহ হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিল জেলার। তবে তাদের নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই আগন্তুকদের। কারণ ঐ ভ্যান হেডকোয়ার্টারে পৌঁছার অনেক আগেই ওরা কাজ সেরে চলে যাবে। কয়েকঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে নেড চলে এল রায়ানের কাছে।
অপর দিকে ফ্রেড প্রিজনের চারপাশে টহল দিতে লাগল। জেলার সাহেব নেড-ফ্রেডকে রায়ানের সেলের চাবি দিয়ে রেখেছেন। তারই একটা রায়ানকে দিল গেল নেড। রায়ান কিছু না বলে দরজাটা খুলে বাহিরে চলে এল। নেডের অবাক দৃষ্টি লক্ষ করে পকেট থেকে তামার একটি তার বের করে দেখাল রায়ান।
বলল,
-ব্যাটারা সার্চ করেনি।
নেড হেসে বলল,
-এত সহজ আশা করবেন না। প্রতি পনের মিনিট পর পর গার্ড এসে টহল দিয়ে যাবে। আর ডেইলি সকল কয়েদীকে ৯০মিনিটের জন্য এক্সারসাইজের নামে একটি রুমে ঢুকিয়ে দিবে। এরপর সেল সার্চ করা হবে।
এছাড়াও বিনা নোটিশে যে কোন সময় আপনাকে অথবা আপনার সেলেও সার্চ করতে পারে।
-হুম। বুঝলাম। সমস্যা নেই এই পাত পাবে না ওরা। এছাড়া আমার কাছে তেমন কিছুই নেই যা খুঁজে পাওয়া যাবে।
জবাবে একটু বাঁকা চোখে তাকাল নেড তবে আর কিছু বলল না। হঠাত্ পায়ের শব্দ শোনা যেতেই সেলে ঢুকে গেল রায়ান। একজন সেন্ট্রি টহল দিতে এসেছে। নেডের ইউনিফর্ম দেখে স্যালুট দিল। এরপর এই কর্ণারে একবার সব কিছু চেক করে চলে গেল।
রায়ান বুঝতে পারল যে ওর পক্ষে খোঁজাখুজি করা সম্ভব হবে না। যা করার নেড-ফ্রেডকেই করতে হবে। কিছুক্ষণ পর ফ্রেড এসে জানাল যে সে জর্ডানকে খুঁজে পায়নি। বিরক্ত হলেও কিছু বলল না রায়ান। সারারাত পালা করে নেড-ফ্রেড খুঁজল জর্ডানকে।
কিন্তু কোথাও পেল না। পরদিন সকালে কর্মতত্পর হলে উঠল প্রিজন। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে দুজন সেন্ট্রি রায়ানের সেলে ঢুকে ওকে নিয়ে ঢুকাল এক হলঘরে। সেখানে নিজের মত আরও অনেক প্রিজনারকে দেখল ও। একজন অফিসার নামকাওয়াস্তে কয়েকজন সেন্ট্রি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এছাড়া কোন বালাই নেই। সবার মাঝে ঘুরেফিরে হাঁটতে লাগল রায়ান। ওর চোখ জর্ডান বার্ককে খুঁজছে। সেন্সর স্ক্যানার ডিভাইসটা তখনও চোখে ফিট করা ওর। চোরছ্যাঁচোড় ছাড়া প্রায় সব ধরণের বন্দিদের আইডেন্টিফাই করতে পারল ও।
তাদের মধ্যে খুনী,সিরিয়াল কিলার, পলাতক সৈন্য, ডাকাত, ড্রাগ স্মাগলার সহ আরও কিছু অপরাধী ছিল। কিন্তু জর্ডান বার্ককে কোথাও পেল না। এছাড়াও এই প্রিজনে রায়ানের জানামতে আরও উচ্চমানের কিছু অপরাধী থাকার কথা। তাদেরকেও দেখতে পেল না। রায়ান বুঝতে পারল ঐসব অপরাধীর জন্য আলাদা ব্যাবস্থা আছে।
৯০মিনিট পর ওদেরকে নামকাওয়াস্তে খাবার দেওয়া হল। এরপর পাঠান হল বিভিন্ন কাজে। রায়ানকে কয়েকজন প্রিজনারের সাথে একটি কাঠ কাটার মিলে কাজ করতে পাঠানো হল। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে যখন ভাবছিল আর পারবে না তখনই সেদিনের মত কাজ বন্ধ করার নির্দেশ পাওয়া গেল। এরপর সবাইকে শিকল পড়িয়ে প্রিজনের পথে নিয়ে চলল সৈন্যরা।
সৈন্যদের সাথে দু'টো কুকুরও ছিল। রায়ানের সামনে এক বৃদ্ধ লোক হাঁটছিল। কোন কাজ না পেয়ে লোকটার ফাইল রিড করতে করতে হাঁটছিল রায়ান। লোকটা পাঁচজন পুলিশকে খুন করেছিল। কেন করেছিল তার কোন মোটিভ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে লোকটা নিজের মুখে খুন করার কথা শিকার করেছিল তারপর আজীবন কারাদন্ড পেয়েছে। আজ ২৫ বছর বছর ধরে সে জেল খাটছে। হঠাত্ সে হোঁচট খেয়ে সামনের বন্দিসহ পড়ে গেল। দ্রুত হাত বাড়িয়ে তাকে তুলে দিল রায়ান। ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই এক অফিসার এসে ধাই করে তার পিঠে হাতের ব্যাটন দিয়ে বাড়ি মারল।
ব্যাথায় ককিয়ে উঠে সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত বৃদ্ধ লোকটা আবার পড়ে গেল। অফিসার আবার ব্যাটন তুলতেই মাথায় রক্ত উঠে গেল রায়ানের। ব্যাটন ধরা হাতটা খপ করে ধরে ফেলে এক মোচড় দিল রায়ান। হাতের ব্যাথা এড়াতে রায়ানের দিকে পিছন ঘুরে গেল সে। রায়ান কোন দয়া না দেখিয়ে অফিসারের দিকে পিছন ফিরে ডান হাতে ইউনিফর্মের কলার ধরে মাথার উপর দিয়ে থ্রো করল।
ওদের থেকে ১০ফুট দূরের শক্ত মাটিতে পিঠ পড়ল তার। ওভাবেই পড়ে রইল। হইহই করে অন্য গার্ডেরা রায়ানকে মারতে ছুটে এল। রায়ানও ঠিক করল একটাকেও না পিটিয়ে ছাড়বে না। হঠাত্ একটা বাঁজখাই গলা গর্জে উঠতেই থেমে গেল গার্ডেরা।
জেলার হাজির হয়ে গেছে। গার্ডদের বন্দিদের এবং অজ্ঞান অফিসারকে নিয়ে যেতে বলল। আর নিজে রায়ানের চেহারাটা ভালমত দেখে নিল। লোকটার আইডি খুঁজে পেল রায়ান। জেনাফ স্লানিকভ, সাবেক কেজিবি অফিসার।
একজন ইন্টারোগেটর। পাশবিক লোক। রায়ান স্পষ্ট বুঝতে পারল এই ঘটনা এত সহজে মিটবে না। ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াবে! বন্দীদের যার যার সেলে ঢুকিয়ে দিল গার্ডেরা। নেড-ফ্রেডের কোন খোঁজ মিলল না।
সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত রায়ান। তাই একটু দ্রুত শুয়ে পড়ল। কিন্তু হঠাত্ উদয় হল সেই বাঁজখাই গলার অধীকারি। পিছনের দুজন সেন্ট্রিকে ইশারা করতেই সেলের তালা খুলে রায়ানকে প্রায় ঘাড়ে ধরে বের করে আনা হল। নিজ হাতে একটা কাল কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল রায়ানের চোখ।
সেন্সর স্ক্যানার ডিভাইস এখন আর কোন কাজেই আসবে না। বেশকিছুক্ষণ এদিকওদিক ঘোরানোর পর ওকে একটা সেলে এনে ঢুকানো হল। দুহাত সিলিংয়ের দড়ির সাথে বাঁধা হতেই বুঝতে পারল রায়ান, এটা টর্চার রুম। এরপর এলোপাথাড়ি মার শুরু হল লাঠি দিয়ে। মারতে মারতে একসময় ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল গার্ডেরা।
তখন কানের কাছে স্লানিকভের গলার আওয়াজ পেল রায়ান।
-এরপরের বার কাউকে মারার আগে এই মারটা মনে রাখার জন্য দেওয়া হল। এরপরের মারগুলো দেব আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার জন্য।
পায়ের আওয়াজ শুনে স্লানিকভের চলে যাওয়া বুঝতে পারল রায়ান। নিজের অজান্তেই জিভ কাটল।
ঐ বেয়াদপ ছোকড়া অফিসার তাহলে স্লানিকভের ছেলে ছিল! ধ্যাত! মনে মনে চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করতে লাগল নেড-ফ্রেডের। গায়েব হওয়ার আর সময় পেল না।
ওদিকে নবাগত দুই অফিসারকে একটা কাজে শহরে পাঠিয়েছে জেলার। অন্য সবারই কাজ আছে, তাছাড়া রায়ানকেও অন্য প্রিজনারদের সাথে পাহারায় রাখা হচ্ছে তাই আপত্তি করেনি ওরা। সন্ধায় ফিরে এসে রায়ানের সেল খালি দেখে জেলারের ঘরে ছুটল ওরা।
ওখানেই রায়ানের বেয়াড়াপনার কথা শুনল। বেশ কিছুক্ষণ পর জেলারকে বুঝাতে সক্ষম হল যে রায়ান খুবই মূল্যবান প্রিজনার। ওর গায়ে হাতও তুলা যাবে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন ওকে সেলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় ওরা। স্লানিকভ এসিস্ট্যান্ট জেলার হলেও এক অর্থে স্লানিকভই এই প্রিজনের ইনচার্জ।
জেলার বেশ দোটানায় পড়ে গেল। কিন্তু উপরের লেভেলের অফিসারের ধমকানির কথা ভেবে নিমরাজি হয়ে গেল। একজন সেন্ট্রিকে ডেকে ওদেরকে টর্চার রুমে দিয়ে আসতে বলল। বেশ কিছু গলিঘুপচি ঘুরে পাতালের টর্চাররুমে ওদের পৌঁছে দিয়ে চলে গেল সেন্ট্রি।
কিছুক্ষণ ঝুলে থেকে বিশ্রাম নিল রায়ান।
টেনেটুনে দড়ির অবস্থা বুঝার ট্রাই করল। হঠাত্ একটা কন্ঠ শোনা গেল,
-ফার্স্ট টাইম?
-এক অর্থে। আপনি তো মনে হচ্ছে পুরনো পাপী।
-তা ঠিক। তবে আমার উপর যে ট্রিটমেন্ট দেয় তার সিকিভাগও আপনাকে দেয়নি।
তবে ঐ স্লানিকভের বাচ্চার মতিগতি সম্পর্কে কোন ঠিক নেই। কখন কাকে কি করে কে জানে? তা আপনাকে কেন ধরেছে? কিছু করেছিলেন? নাকি কারণ ছাড়াই?
-তেমন কিছু না। ওর পেয়ারের ছেলেটাকে একটু আকাশে উড়া শেখাচ্ছিলাম। অভ্যেস নেই তো। তাই ভয় পেয়ে সংজ্ঞা হারিয়েছে।
-বলেন কি মশাই! আপনি তো নমস্য ব্যক্তি! ওর ছেলেটা অত্যাচারে ওর চেয়ে এক কাঠি বাড়া। খাসা কাজ করেছেন!
-বলছি আপনারও কি হাত-চোখ বাঁধা?
-না মশাই। তবে ভালমত চেয়ারের সাথে বডিটা বেঁধে রেখেছে। হে হে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রায়ান।
অবশ্য ওর কাছে চোখ বন্ধ করে থাকাটা ব্যাপার নয়। ব্যাপার হল সেন্সর স্ক্যানারটা বাঁধা পেয়ে বন্ধ হয়ে আছে সেটা। হঠাত্ সেলের দরজা খুলে গেল। নেডের হাসিহাসি গলা শোনা গেল।
-গুড গড।
এত সুন্দর মেকআপ কিভাবে করলেন মি. রায়ান?
-ফাজলামি করছ? করে নাও। পরে সময় পাবে না। তার আগে আমাকে খুলে নিয়ে যাও।
-কি দরকার? আগে একজন ফটোগ্রাফার ডাকি।
-চুপ! খোলো আমায়।
-আচ্ছা।
বাঁধন খোলার জন্য এগিয়ে এল ফ্রেড। হাতের বাঁধন খুলতেই সেলে ঢুকল স্লানিকভ। প্রশ্ন করল,
-আমার বন্দীকে নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে জানতে পারি?
ফ্রেড জবাব দিল,
-একই প্রশ্ন তো আপনাকেও করতে পারি। আপনি আমাদের বন্দীকে নিতে আসেন কোন সাহসে?
-ও একজন অফিসারকে পিটিয়ে বেঁহুশ করেছে।
এটা ঘোরতর অন্যায়। শাস্তি পাওয়া উচিত ওর। ভাল কথা, আপনাদেরকে তো আগে এখানে দেখিনি! কে তোমরা? র্যাঙ্ক কি তোমাদের?
-আমরা নতুন এসেছি এই প্রিজনারের সাথে। আমরা লেফটেন্যান্ট। আমাদের যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে কথা বলুন।
তাচ্ছিল্লের হাসি হেসে স্লানিকভ বলল,
-তাই? তা কোন এরিয়ায় ছিলে তোমরা এর আগে?
রায়ান প্রমাদ গুনল। দক্ষ ইন্টারোগেটর স্লানিকভ। এই আলোচনা বেশিক্ষণ চললে ধরা পড়ে যাবে নেড-ফ্রেড। হঠাত্ দরজা দিয়ে স্লানিকভের ছেলে ঢুকে সমস্যার সমাধান করে দিল। রায়ানের চোখ বাঁধাই ছিল।
আন্দাজে ঝাঁপ দিল স্লানিকভের ছেলে কথা বলে উঠতেই। এলোপাথাড়ি কয়েকটা মার দিতেই সবাই মিলে ছুটে এল রায়ানকে ধরতে। নেডকে এক ঘুসিতে চিত করে দিল রায়ান। এরপর সবাই মিলে ওকে চেপে ধরে আমার সিলিঙের দড়ির সাথে ঝুলিয়ে দিল। এবার পাদুটোও বেঁধে দেওয়া হল মেঝের আঙটার সাথে।
নেড বলল,
-আপনারা একে নিয়ে যা খুশি করতে পারেন। আপত্তি নেই আমাদের। আমরা চললাম।
এই বলে ফ্রেডকে নিয়ে সেল থেকে বেরিয়ে গেল ও। রায়ানকে নিজের ছেলের হাতে ছেড়ে দিয়ে বেড়িয়ে গেল স্লানিকভও।
একটা ডান্ডা নিয়ে রায়ানের সামনে এল ছোকড়া। বলল,
-এবার সব মারের প্রতিশোধের পালা।
দমাদম পিটিয়ে গেল সে একনাগাড়ে একঘন্টা। জিরানোর ফাঁকে বলল,
-তোর মত এরকম কত ঘাগু লোককে পেঁদিয়ে সোজা করেছি তার হিসেব নেই।
হঠাত্ মুখ বিকৃত করে বেড়িয়ে গেল সে।
রায়ানের মনে হল বাথরুমে গিয়েছে। অপরিচিত সেই প্রতিবেশী কথা বলে উঠল,
-মারের হাত থেকে বাঁচতে হলে আমার মত জ্ঞান হারিয়ে থাকার ভান করুন।
-পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। আপনার পরিচয়টা কিন্তু জানা হল না। কি নাম?
পায়ের আওয়াজ ফিরে আসতে শুনল রায়ান।
এরই মাঝে প্রতিবেশী বলল,
-জর্ডান বার্ক!
সচেতন হয়ে গেল রায়ানের প্রতিটি ইন্দ্রিয়। বার্কের গলার আওয়াজ পেয়ে ওর সেলের দিকে আগাল অফিসার। কিন্তু পিছন থেকে বলে উঠল রায়ান,
-হেই রাশান বিচ! ইজ দ্যাট অল ইউ গট ইন ইউর অ্যাস?
পাগলা ষাঁড়ের মত ওর সেলে ঢুকে ওকে মারতে এল ছোকড়া। কিন্তু ঐ ছোকড়া তো আর জানে না যে সে কার পাল্লায় পড়েছে। ওর প্রতিটা মুভমেন্ট ফিল করতে পারছিল রায়ান।
আর রাশানরা খেয়াল করেনি যে ওর হাত-পায়ের বাঁধন দিয়েছিল ফ্রেড।
কাছে আসতেই একটানে পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে ছোঁকড়ার কোমরে লাথি লাগাল রায়ান। প্রচন্ড ব্যাথায় বাঁকা হয়ে গেল সে। আরেকটা পা ছুটিয়ে আরেকটা লাথি দিয়ে ওকে মাটিতে শুইয়ে দিল। এরপর দুই হাতের বাঁধন খুলে নিল।
অপর সেল থেকে ভয়ার্ত কন্ঠে জানতে চাইল বার্ক,
-আপনার নাম কি হে মিস্টার?
ফুটবলে কিক দেওয়ার মত একটা কিক করল রায়ান ছোঁকড়া অফিসারকে। সেলের লোহার শিকে বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারাল সে। বার্কের দিকে ফিরে চোখের বাঁধন খুলতে খুলতে জবাব দিল,
-রায়ান। এজেন্ট রায়ান।
দ্রুত অফিসারের ইউনিফর্ম পরে নিল রায়ান।
এরপর ঐ ছোঁকড়াকে ছাদের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল। তবে এর আগে মুখে কাপড় ঢুকিয়ে বেঁধে দিতে ভুলেনি। দ্রুত সামনের সেলে ঢুকে বার্ককে বাঁধনমুক্ত করল। বার্কের আপাদমস্তক স্ক্যান করে এর আগেই আইডেন্টিটি কনফার্ম করতে ভুলেনি। এরপর বলল,
-চল।
তোমার এখানে প্রয়োজন ফুরিয়ছে।
দুজনে দরজার দিকে রওয়া দিতেই ঘরে ঢুকল নেড। দুঃসংবাদ জানাল সে,
-সর্বনাশ হয়েছে। স্লানিকভ ফোনে খোঁজ নিচ্ছে আমাদের ব্যাপারে। দুই মিনিটও লাগবে না আমরা যে ভুয়া সেটা বুঝতে।
পালাতে হবে। মিশন বাতিল।
-ধীরে বন্ধু, ধীরে। একে চেন কিনা দেখ তো?
বার্কের দিকে ইঙ্গিত করল রায়ান। এতক্ষণ ব্যস্ততার কারণে খেয়াল করেনি নেড।
এখন ওকে দেখে চমকে উঠল। রায়ানের অফিসার ইউনিফর্ম দেখে প্রশ্নের মেশিনগান ফায়ার করতে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে থামাল পরেও প্রশ্ন করা যাবে ভেবে। রায়ান প্রশ্ন করল,
-ফ্রেড কই?
-উপরে। সিঁড়িমুখে পাহারা দিচ্ছে।
-ঠিক আছে। চল।
তড়তড় করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল তিনজন। ওদেরকে ২০ মিনিট পর আস্তে আস্তে গ্যারেজের দিকে রওয়া হতে বলে বেরিয়ে গেল র।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।