লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ।
বিকট চিৎকার শোনা গেল। মনির! পেছনে, ব্যাকে!
অর্থাৎ ব্যাকে পাস দিতে বলা হচ্ছে।
সাথে সাথে ততোধিক জোরে চিৎকার শোনা গেল, মনির! সামনে! সোজা বাড়া!
মনির, যার পায়ে বল, সে দিশেহারা, সামনে দেবে না “মাইনাস” করবে বুঝতে পারছে না। কাজেই তার কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার সুযোগ নিয়ে একজন ছোঁ মেরে তার পা থেকে বল কেড়ে নিলো এবং দৌড় শুরু করলো গোলমুখে।
সমানে সমানে দুটো দলে খেলা হলে যা হয়; তাই হচ্ছে। খেলায় উত্তেজনা এসেছে, কিন্তু গোল হচ্ছে না। বল একবার এদিকে যাচ্ছে, আরেকবার ওদিকে।
এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি, দুই দলের গোলকিপারই গালে হাত দিয়ে বসে আছে। একজন হাই তুলল, আড়মোড়া ভাঙল। তারা বেশীরভাগ সময়ই বেকার কাটায়, শুধু কাছাকাছি বল এলে সতর্ক হয়।
রোজ বিকেলে এই মাঠে খেলা হয়। পাড়ার ছেলেপুলেরা এখানে খেলতে আসে; দুই দলে ভাগ হয়, “বাটাবাটি” করে ঠিক করে কে কোন দলে খেলবে।
বিশ মিনিট করে দুই হাফে খেলা হয়, তারপর একটা গোল অফসাইড হয়েছে – জাতীয় কিছুকে কেন্দ্র করে ঝগড়াঝাঁটি করে খেলার সমাপ্তি হয়। পরদিন বিকেলে কিছুই হয়নি এই ভঙ্গীতে আবার নতুন করে খেলা শুরু। যেন তাদের এই খেলা কোনদিনই শেষ হবে না এবং কেউই পরাজয় মেনে নেবে না। বাটাবাটির কল্যাণে আজ যে পরম বন্ধু, কালই হয়তো তার নাকে ঝামা ঘষে দেয়ার “দৃঢ় সংকল্প” নিয়ে খেলতে হচ্ছে। এই করে করেই হয়তো এখান থেকে একদিন দেশী ক্যালিবারের মেসি-রোনালদো-ভিয়া-রুনিরা বেরুবে (বেরুবে না, ত্রিশ পেরুবার আগেই এদের মধ্যে শতকরা আশি ভাগ ছেলে খেলাধুলার কথা ভুলে যাবে, বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে চাকরিবাকরি-ব্যবসাবাণিজ্য দেখা শুরু করবে এবং বিয়ে-থা করে সংসারী হবে; ছেলেপুলেকে স্কুলে আনা-নেয়া করা এবং বউয়ের লিস্টি অনুযায়ী কাঁচাবাজার থেকে দরদাম করে আলু-পটল কেনার দায়িত্ব ঘাড়ে নেবে।
তবে আশা করতে দোষ কী?)।
আমার মতোই আরও কয়েকজন বিকেলে সময় কাটাতে আসে এই মাঠটাতে। ঘাসের ওপর বসে খেলা দেখে, কাছেপিঠে বল এসে পড়লে ওদেরকে ফেরত পাঠায়। ভালোই লাগে, প্রাণচঞ্চল কয়েকটা ছেলের খেলা দেখতে দেখতে পেছনের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালানো যায়। পালাপর্বে ছোটখাটো টুর্নামেন্ট করা হয়, তাতে অন্য পাড়ার ছেলেপুলেরাও খেলতে আসে।
“হোমগ্রাউন্ডের সুবিধে” পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে আর রেফারিকে হাত করে (হালকা হুমকিধামকি দিয়ে) ছেলেরা ট্রফি নিজেদের এলাকাতেই ধরে রাখার ব্যবস্থা করে! অনেকদিন ধরে ওদের খেলা দেখছি, কাজেই প্রায় সবার নামই জানা হয়ে গেছে, বল পাস দেয়ার সময় সবাই একসাথে বল দাবী করে বসে, কাজেই কার পায়ে বল সেটা জানা কঠিন নয়।
বিশ মিনিট বিশ মিনিট করে চল্লিশ মিনিটের খেলা শেষ হয়েছে। বাকবিতণ্ডারত ছেলের দল এখন গোল হয়ে বসে জিরিয়ে নিচ্ছে, অন্ধকার হয়ে গেলে বাসার পথ ধরবে। সেই সাথে আমরাও।
আমার পাশে বসে ছিল একটা ছেলে, ওদেরই বয়সী।
খেলা শেষ হওয়াতে উঠে দাঁড়ালো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একদিকে হাঁটা শুরু করলো। বগলের নিচে চেপে রাখা ক্রাচটা দুঃখী শব্দ তুলছে পাকা ফুটপাতে, ঠক ঠক, ঠক ঠক।
আমার বুক ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
ছেলেটার দর্শক সারিতে বসে থাকার কথা নয়।
এই তো, একমাস আগেও সে সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলত। ছেলেটার নাম রায়হান। কলেজ থেকে ফেরার পথে একটা বাস ওর সামনে ব্রেক করতে ভুলে গেছিল। ডান পা-টা চলে গেছিল চাকার নিচে।
ক্ষতি হয়েছে কমই বলা চলে।
ছেলেটা তো মারাও পড়তে পারতো। তবে ভারী বাসের চাকা একেবারে কিছু না নিয়ে ছেড়ে দেবে, তা তো হয় না। কাজেই ওর ডান পা-টা অচল হয়ে গেল।
একে-ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হয়েছে ছেলেটার, সে আর সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলছে না কেন। জবাব পেয়েছি, ওর পা আর কখনো ফুটবলে লাথি মারার মতো শক্ত হয়ে উঠবে না, এবং বাকি জীবনটা ওকে বগলে ক্রাচ নামক অসহনীয় ভারটা বহন করে চলতে হবে।
ওর বন্ধু খেলোয়াড়েরা প্রথম কয়েকদিন ওকে সান্ত্বনা দিয়েছে। তারপর আবার ফিরে গেছে ওদের খেলায়। কারো জন্য কিছু থেমে থাকে না, এ ব্যাপারটা মানুষ ওদের বয়স থেকেই বুঝতে শেখে। বুঝতে শেখে, সবাই সবদিন আসতে পারবে না। কেউ অসুখে পড়বে, কারো আসতে মন চাইবে না, আবার কারো বা ডান পা-টা বাসের চাকার নিচে চলে যাবে।
তাই বলে তো আর খেলা থেমে থাকতে পারে না।
তাই ওদের খেলায় ছন্দপতন ঘটে নি। রোজ বিকেলে খেলা আগের মতোই জমে উঠছে।
শুধু দর্শকের সারিতে একজন বেড়েছে, খেলোয়াড় একজন কমে গেছে, এই যা। এমন কিছু কমবেশি হয় নি।
আমি উঠে পড়লাম। সন্ধ্যার বাতাসে গা জুড়োতে জুড়োতে বাড়ির পথ ধরলাম। ছেলেটা বেশ খানিকটা দূরে এগিয়ে গেছে, এখন আর ওর ক্রাচের ঠকঠক শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
কাল আবার খেলা হবে, আমিও দেখতে আসবো। জানি, রায়হান নামের ছেলেটাও দেখতে আসবে।
হয়তো মনে মনে আশা করে, একদিন আবার খেলতে পারবে। হয়তো ছোটাছুটি করা ছেলেগুলোর মধ্যে কোন একজনের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে চল্লিশটা মিনিট সে কাটিয়ে দেয়।
এত আশাও মানুষ করতে পারে?
(১৮ জুলাই, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।