কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! অনেক ক্ষণ ধরে বসে আছি। ও এখনও আসছে না। দুটো বাজলো প্রায়। অথচ ও বলেছিল দেড়টার দিকে আসবে।
দেড়টা কখন বেজে গেছে।
ও আগেও এরকম করেছে। দুটোর কথা বলে তিনটায় এসেছে। তিনটার কথা বলে চারটায়। চারটার কথা বলে পরেরদিন চারটায়।
ও আসলে এরকমই।
অনেকটা খামখেয়ালী। অন্যদেরও যে সময়ের দাম আছে এই বোধটাই ওর নেই।
আমি মুখ বুজে ওর অনেক কিছু সহ্য করেছি। ও যা ইচ্ছা বলেছে, যা ইচ্ছা করেছে,-আমি কিছুই বলিনি। ও আমাকে ইচ্ছামতো অপমান করেছে, কষে গালিগালাজ করেছে - থেকেছি মৃতের মত নিশ্চুপ।
ওর কথা শুনে অনেক কেঁদেছি, কখনও বুঝতে দেইনি।
পাঠক হয়তো ভাবছেন, কে ও?
সম্পর্কটা তিন বছরের।
শুরুটা ছিল স্বপ্নের মতো।
ও আর আমি এক ভার্সিটিতে এক ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। ও ছিল একজন দুর্বোধ্য মানুষ।
অজ্ঞাত কারণে নারী বিষয়ে সবসময় ওর মুখ থেকে বাজে কথা বেরোত।
নারী নাকি emotion এর বস্তা।
নারীর নাকি 50 kg ওজন আর 10 kg মেক আপ।
নারী নাকি অশ্রু দিয়ে ফুলানো বেলুন, একটু গুঁতা মারলেই সুড়সুড় করে পানি বেরিয়ে আসে...ইত্যাদি ইত্যাদি।
এসব শুনে আমরা মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই খুব খেপে গেলাম।
এত্ত বড় সাহস! মেয়েদের কি ও মানুষ মনে করে না?
মেয়েদের মধ্যে আমি একটু লিডার টাইপ ছিলাম। একদিন বান্ধবীদের বললাম, "ওই বান্দরটাকে একটু টাইট দেয়া দরকার। "
সবাই আমার সাথে একমত পোষণ করলো।
তো একদিন ছেলেটাকে ক্যান্টিনে আসতে বললাম।
ছেলেটা আসল।
বসল। কথা বললাম। দেখলাম, মানুষটা কোন বানানো কথা বলে না। সে যা বলে তা বিশ্বাস করে।
পাঠক বিশ্বাস করবেন কি না জানিনা, এই একটা বৈশিষ্ট্যেই আমি কুপোকাত হয়ে গেলাম।
মনে হল মেয়ে হিসেবে আমার যাকে পাওয়ার কথা ছিল সে এ-ই।
কিভাবে কিভাবে যেন কট্টর নারীবিদ্বেষী এই এই লোকটার সাথে আমি একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম। এবং বান্ধবীদের হাসির পাত্রে পরিণত হলাম।
ক্রমে এই মানুষটার আরও অনেক অন্ধকার দিকের সাথে আমার পরিচয় হল। যেমন, নিজে ঠিকই টাকা খরচ করে কল করবে, অথচ বলবে মেয়েদের সাথে মোবাইলে কথা বলা নাকি বাজে, রাস্তার ছেলেদের কাজ।
আউল ফাউল কথা বলে আর উল্টাপাল্টা দোষারোপ করে মেজাজ খারাপ করে দেবে, পরের দিন আবার ফোন করে বলবে, "একটু টেস্ট করলাম। " ঝগড়া করতে করতে বাপ মায়ের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে দেবে, আবার পরক্ষণেই বলবে যে "এরকম সিচুয়েশন ফেস করার প্র্যাকটিস থাকতে হবে। " তার জন্য দোয়া করতে বলবে, যেন যে বাজে ইতর মেয়ের খপ্পরে সে পড়েছে তার থেকে যেন সে নিস্তার পায়......বলা বাহুল্য, মেয়েটি আর কেউ নয়, আমিই।
কচকচানি দিয়ে পৃষ্ঠা ভরাবো না। বর্তমানের কথা বলি।
আমাদের সম্পর্কটা প্যাঁচ খেয়ে খেয়ে এতদূর গড়িয়েছিল যে আমার পরিবার জানার সাথে সাথে ওর সঙ্গে আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল। মেয়ে হিসেবে ঘর আমাকে করতেই হবে, তা নাহয় করলামই, কিন্তু একটা 'মানুষের চামড়া পরা' জন্তুর সাথে? এর সাথেই কাটাতে হবে সারাজীবন? এরই সাথে সব হাসি কান্না ভাগাভাগি করতে হবে? এ তো ভালোমতো কথাই বলে না, (অথবা বলতে পারে না,) এ-ই সে যে সারাজীবন ধরে মিষ্টি মিষ্টি ভালোবাসার কথা শোনাবে আমায়? প্রতি weekend এ কি এর হাত ধরেই হারিয়ে যাব অজানার উদ্দেশ্যে? আমার অসুখ বিসুখের খবর শুনে এ-ই কি অফিস থেকে ছুটে আসবে? মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে? দৌড়াদৌড়ি করে বাসা তোলপাড় করে দেবে? নাকি খবর পেয়ে মুখে চরম বিরক্তির ভাব এনে বলবে, "Don't mix family affairs with business."?
ভালবাসা এক জিনিস, বিয়ে আরেক জিনিস। ভালবাসা ফুরিয়ে গেলে দায়িত্বও ফুরিয়ে যায়, কিন্তু বিয়ে যতক্ষণ টিকে আছে ততক্ষণ নিজের দায়িত্ব পালন করেই যেতে হয়, ভালোবাসার নদী শুকাক আর না শুকাক, ইচ্ছা করুক আর না করুক।
ধুত্তেরি!! এত দিন ধরে প্রেম করলাম, আর এখন যদি তীরে এসে তরী ডোবাই, তবে কি আমি চিরদিনের জন্য নিজের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলব না? বিয়েই যদি না করব, তবে আর সম্পর্ক করলাম কেন? গায়ের পোশাক চেঞ্জ করার মতো বয়ফ্রেন্ড চেঞ্জ করার মানসিকতার মেয়ে তো আর আমি নই। নিজের বিচারবুদ্ধি ও রুচির ওপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে।
তাছাড়া, জেনেশুনেই তো তিন বছর আগে নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছিলাম। আমার কর্মফল ভোগ তো করতে হবে আমাকেই।
যাহোক, বিয়ের কথা শোনার পর দেখি ও অন্য জগতের মানুষ হয়ে গেছে। আমি যে বেঁচে আছি এবং নিয়মিত ওর সাথে ক্লাস করছি - এ বোধটুকুও বোধহয় ও পরিত্যাগ করেছে। আমি ছেলেদের সাইকোলজি ভালো বুঝি না, কিন্তু তিন বছরের পরিচয়ের পর কাউকে বুঝতে অধ্যাপক হওয়া লাগে না।
আমি অনুমান করলাম, আমার সম্বন্ধে ওর তখনকার মনোভাবটা হল এমন, -"মেয়েটাকে যত কষ্ট দেব, মেয়েটা তত নিজেকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করবে। খুঁজবে তার ভুল কোথায়, বের করার চেষ্টা করবে কেন তাকে কষ্ট দিচ্ছি। এভাবে আস্তে আস্তে সে আরও পরিশুদ্ধ হবে। অথচ যদি প্রশ্রয় দিই, সাথে সাথে মাথায় চড়ে বসবে। হাবিজাবি মেয়েলি কাজ করবে।
ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠে অর্থহীন মেয়েলী আবদার ধরবে। আর আমি হয়ে পড়ব তার পা চাঁটা কুত্তা। "...
আম্মু বলেছেন দুই মাসের মধ্যে বিয়ে হবে। এখন যেন খুব বেশি মেলামেশা না করি।
একদিন ওর সাথে বিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে চাইলাম।
ওর দেখলাম কোন আগ্রহই নেই। হঠাৎ করে অর্থহীন রাগে জ্বলে উঠলাম। আমি জানি আমি ছাড়া অন্য কোন মেয়ে ওকে পছন্দ করবে না। কখনই করতো না। কখনও করার কথাও ছিল না।
এমনকি আমিও তেমন একটা পছন্দ করি না। আমি ইচ্ছা করলেই ওকে একটা চরম শিক্ষা দিতে পারি। স্ট্রেট বলে দিতে পারি, আমি বিয়ে করব না। ওর বদলে অমুক তমুককে বিয়ে করে ফেলতে পারি অচিরেই। তাতে ও প্রথমে অবাক হবে, তারপর সব মেনে নেয়ার ভান করে কয়েকদিন খুব শান্তিতে থাকার অভিনয় করবে!
অথচ আমি জানি, এরপর আস্তে আস্তে ওর অন্তর জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।
কিন্তু বাইরে বাইরে ভাব দেখাবে যেন কিছুই হয় নি!
আর ওর মুখের সদা বিরক্ত, নিঃস্পৃহ ভাবটা ধরেই রাখবে। এমন ভাব করবে যেন খুব মজায় আছে। খুব মজা, খুব।
আমি তো জানি, ও এরকমই।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ও মাঝে একবার বলেছিল, বিয়ে নিয়ে নাকি ও চিন্তাভাবনা করবে (!) তারপর আমাকে জানাবে সামনাসামনি।
এজন্যই ও দেখা করতে বলেছিল আজ দেড়টায়।
অথচ এখন বাজে...
একটা মানুষ খুব দুর্বোধ্য। খুবই। তাও কি তিন তিনটি বছর সেই দুর্বোধ্য সত্ত্বাকে কাঁচের মতো পরিষ্কার করে উপস্থাপন করতে সক্ষম নয়? তার উপর যদি সম্পর্কটা প্রেমের হয়? বোধহয় সক্ষম।
ঠিক এই বিশ্বাসেই রোদে ঘামতে ঘামতে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, আমি যদি ওর জায়গায় হতাম, তাহলে কী ভাবতাম।
কী ভাবতাম আমি?
"আমি চেষ্টা করব যাতে বিয়েটা ভেঙ্গে যায় (কিন্তু এমন ভাব করব যেন বিয়ে করার জন্য আমি লাফাচ্ছি)। যেহেতু ও মেয়ে, তাই ওর ফ্যামিলি ওকে তাড়াতাড়ি অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেবে। তারপর বাকি জীবন ওকে হিংস্র ভাবে খোঁচা দিয়ে কাটাতে পারব, অনবরত বলতে পারব যে "তোমার জন্যই আমাদের বিয়েটা হল না, তুমি আমাকে এতদিন টয়লেট পেপারের মত ইউজ করেছ, আর এখন সুযোগ মত ফেলে দিয়েছ, তোমার কখনই বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না, সবই তোমার প্রতারণা, মেয়েরা আসলে এরকমই...... ইত্যাদি ইত্যাদি। " এভাবে দিনের পর দিন ওকে কষ্ট দেয়া যাবে..."
বাস্তব থেকে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কে যেন চোখ মুছিয়ে দিতেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
দেখি হাসি হাসি মুখে ও দাঁড়িয়ে আছে।
"হাই, ...(কোন ভালোবাসার সম্বোধন, যা কিনা ও জীবনে প্রথমবারের মতো উচ্চারণ করল), একটু দেরী করে ফেললাম, সরি সরি সরি সরি......(অসংখ্যবার, সারাজীবনেও এতবার বলেছে কিনা সন্দেহ)... ... ..." ... ... ...
তারপরই উদাত্ত কণ্ঠে এক সাগর লোকের সামনে রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে ও শুরু করল আবৃত্তি,
কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন। ...
ভয়ে উত্তেজনায় লজ্জায় আনন্দে আমি তখন আর সামনে তাকাতে পারছিলাম না। ও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ওর ট্রেডমার্ক হাসিটা ঠোঁটের কোণে ধরে রেখে বলে চলল,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।
কখন যে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছি নিজেও জানি না।
ও আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। বলল, দেবী, এ জীবন উৎসর্গ করলাম তোমারই চরণতলে।
শুধু তোমারই চরণতলে।
ভেজা দু চোখে রাজ্যের অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইলাম।
(সমাপ্ত)
(লেখকের কথাঃ এই গল্পটা আসলে পুরুষ হৃদয়ের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে লেখা। এটাকে একটা চরম সাইকো লেখা বলা যায়, কারণ এখানে খুব খারাপ খারাপ কিছু কথা উপস্থাপন করা হয়েছে যা কোন সুস্থ মানুষ কখনও কল্পনা করবে না। আমি সকল পাঠক পাঠিকার কাছ থেকে সাইকো গল্প লেখার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এবং এ গল্পের কোন বাজে আইডিয়া বাস্তব জীবনে প্রয়োগ না করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
কবিতাংশ নির্মলেন্দু গুণের) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।