আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের প্রচলিত ও একপেশে ইতিহাস বনাম প্রকৃত ও বাস্তব ইতিহাস: ইঞ্জিনিয়ার আবু রামিন কর্তৃক সম্পাদিত

মিথ্যার পতন সন্নিকটে.......... বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক কেন? পৃথিবীর বহু দেশ রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সে সকল দেশের স্বাধীনতা ও বিপ্লবের ইতিহাস নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ কারো মধ্যেই সাধারণত কোনো দ্বিমত দেখা যায়নি। কারণ, বাস্তবে যা ঘটেছে, মানুষ যা ঘটতে দেখেছে, সেটাই হয়েছে তাদের ইতিহাসের অন্তর্গত। কিন্তু, ব্যতিক্রম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস। স্বাধীনতার প্রায় ৪২ বছর পরও এদেশের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য ইতিহাস রচনা করা সম্ভবপর হয়নি।

তার কারণ,বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় নিরপেক্ষতা বজায় থাকেনি। বরং- বিভিন্ন কারণে প্রকৃত ইতিহাসের সত্য প্রায় সম্পূর্ণরূপে চাপা পড়ে যায়। ইতিহাস বিকৃতির কারণগুলো হলো: ১. মুক্তিযুদ্ধকালীন দুর্বলতাসমূহকে ঢাকার চেষ্টা ২. মুক্তিযুদ্ধের সকল কৃতিত্ব কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা ৩. গোষ্ঠী স্বার্থে দলীয় ও দলীয় নেতার কাল্পনিক মাহাত্ম্য প্রচার করা ৪. ক্ষমতা ও গোষ্ঠী স্বার্থকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা ইত্যাদি। ইতিহাস বিকৃতির সেই ভূমিকা আজও অব্যাহত আছে এবং বর্তমান প্রজন্মের কিছু অংশ হলেও এ অপতৎপরতার ফলে বিভ্রান্ত হচ্ছে। এই ইতিহাস বিকৃতিকারীরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করেনি,অথচ মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত কৃতিত্ব এককভাবে আত্মসাৎ করতে উদ্যত হয়েছে।

বাংলাদেশের বিশেষ এক বা একাধিক গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে সত্যিকার ইতিহাস হলো সেটিই- যেটা তাদের স্বার্থ, গোঁয়ার্তুমি ও অহংকারের অনুকূলে; তা আদৌ বাস্তব কি অবাস্তব তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। ইতিহাসকে বিকৃত করতে সচেষ্ট এই গোষ্ঠীগুলো যেটাকে ইতিহাস বলে চালাতে চাইছেন, দেশের অনেক মানুষের দৃষ্টিতে তা নিতান্তই “উদ্দেশ্যমূলক গল্প”। তাই প্রকৃত ইতিহাস আর উদ্দেশ্যমূলক গল্পের মধ্যে পার্থক্য সূচীত হওয়া জরুরী। মুক্তিযুদ্ধ কি পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ছিলো? নাকি ইসলামের বিরুদ্ধে? প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আদৌ ইসলামের বিরুদ্ধে ছিলো না। এই যুদ্ধ ছিলো পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠীর ২৪ বছরব্যাপী উপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে।

এ যুদ্ধ ছিলো জালিমের (বা অত্যাচারীর) বিরুদ্ধে মজলুমের (বা অত্যাচারিতের) মুক্তির সংগ্রাম; যা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ ন্যায় যুদ্ধ। এজন্যই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মসজিদে হানাদারদের ধ্বংস ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের জন্য দোয়া-মুনাজাত করা হয়েছিলো। অতএব, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে ইসলামের দ্বন্দ্বের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ,আওয়ামী লীগার আর বামপন্থীদের অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামকে পরস্পরবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করছেন। যদি মুক্তিযুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে না হয়ে থাকে তাহলে আজ যারা ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, তাদেরকে ঢালাওভাবে রাজাকার, আলবদর বলে উপহাস করার যুক্তি আছে কি? যারা উপহাস করেন বা করছেন তারা কি এটাই বুঝাতে চান যে- মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো ইসলামের বিরুদ্ধে? তা-ই যদি হয় তাহলে যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বলে দাবি করেন তারা প্রকাশ্যে ইসলাম ছেড়ে অমুসলিম হয়ে যাচ্ছেন না কেনো? দেশের মানুষের মূল সমস্যা কোনটি? শোষণ-বৈষম্যে? না ইসলামী দল? বাংলাদেশে আজ খুন, ডাকাতি, হাইজ্যাক, ঘুষ, দুর্নীতি, অশ্লীলতা, পতিতাবৃত্তি, শোষণ, বৈষম্য, শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য ইত্যাদি প্রায় সবগুলোই সর্বকালের সব রেকর্ড অতিক্রম করে গেছে।

দ্রব্যমূল্য আজ সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, হতাশা আজ গগণচুম্বি। বাংলাদেশের সবার উপর আজ চেপে বসেছে বিশাল বিদেশী ঋণের বোঝা। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের রাজত্ব। এদেশের অনেক মানুষের জীবনমান দারিদ্র্য সীমার নীচে, লক্ষ-কোটি শিক্ষিত যুবক আজ বেকার, এখনো অনেক মানুষ নিরক্ষর, দেশের অনেক মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত, মুষ্টিমেয় লোকের কাছে প্রায় সব সম্পদ আজ কুক্ষিগত।

আপামর জনগণের জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা আর কি হতে পারে? কিন্তু আওয়ামী লীগারদের কর্মকান্ড দেখে মনে হয়, এসব আসলে কোনো সমস্যাই নয়, দেশের একমাত্র সমস্যা হলো ইসলামী দল (যা সাধারণত সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণকারী)। তারা এরকম ঘোষণাও দিয়েছেন যে, “এবারের সংগ্রাম গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম”। কি আশ্চর্য! গোলাম আযম কি বাংলাদেশের সরকার, নাকি দখলদার পাকিস্তানী বা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে, তাদের এবারের সংগ্রাম তাঁরই বিরুদ্ধে? তবে হাঁ, তারা যদি এরকম নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে, অধ্যাপক গোলাম আযমের ফাঁসি হলে কিংবা তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে খুন, ডাকাতি, হাইজ্যাক, ঘুষ-দুর্নীতি, অশ্লীলতা ইত্যাদি নির্মূল হয়ে যাবে, দ্রব্যমূল্য কমে যাবে, বেকারত্ব দূর হবে, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস থাকবে না, গঙ্গা-তিস্তা- ব্রহ্মপূত্রের পানি অবারিত হবে, শান্তিবাহিনী-বঙ্গসেনার উৎপাত থাকবে না, ১৬ কোটি নিপীড়িত মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জিত হবে, তাহলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই গোলাম আযমের ফাঁসির দাবিতে তাদেরই নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু যদি তা না হয় তাহলে প্রশ্ন, ১৬ কোটি মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের বর্তমান মূল সমস্যা কোনটি? দুর্নীতি, শোষণ, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ইত্যাদি? নাকি অধ্যাপক গোলাম আযম? জনগণের বাঁচা-মরার সমস্যাকে ধামাচাপা দিয়ে কেনো তারা গোলাম আযমের মতো একটি নন-ইস্যুকে ইস্যু করে তুলেছেন? কেন তারা জনগণের দৃষ্টিকে মূল সমস্যাবলী থেকে অন্যদিকে ফিরিয়ে দিতে চাইছেন? কার স্বার্থে তারা এই মরণ খেলায় মেতে উঠেছেন? ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের আপামর জনগণ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এ চেতনাবোধ থেকে রুখে দাঁড়িয়েছিলো যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রাষ্ট্র পর্যায় থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত শোষণ ও বৈষম্যের অবসান ঘটবে। অথচ, আওয়ামী লীগাররা জনগণের দৃষ্টিকে মূল সমস্যা থেকে অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নন ইস্যুকে ইস্যু করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন।

তাদের মূল আন্দোলন শোষণ-বৈষম্যের অবসানের জন্য নয়, দ্রব্যমূল্য হ্রাস বা রেকারত্ব দূরীকরণের জন্য নয়, গঙ্গা- তিস্তা- ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণ কিংবা তালপট্টি দ্বীপ দখলের বিরুদ্ধে নয়; এমনকি বিশ্বব্যাঙ্ক- আইএমএফ এর কবল থেকে দেশের অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বকে মুক্ত করার লক্ষ্যেও নয়। বাংলাদেশের কথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’-দের আচরণ ও তাদের বক্তব্যের স্বরূপ: অশালীন উক্তি: মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি বেশ্যাদের খদ্দের আহ্বানের সমতুল্য (বলেছেন কবি শামসুর রাহমান), দীর্ঘক্ষণ যাবৎ আযান অসহ্য (বলেছেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী), মোহাম্মদ তুখোর বদমাশ- চোখেমুখে রাজনীতি (দাউদ হায়দারের কবিতা), আমাদের উচিত রবীন্দ্রনাথের এবাদৎ করা (বলেছেন কবি সুফিয়া কামাল), বেহেশত নারীদের কাঙ্খিত হওয়ার কথা নয়, বেহেশতে নারীদের শারীরিক ও মানসিক সুখের কোনো ব্যবস্থা নেই (তসলিমা নাসরীন, যায় যায় দিন, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সংখ্যা)। ইসলামকে সংকুচিত করার প্রচেষ্টা: কুরআন হাদীস এর যে সকল স্থানে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, আইনব্যবস্থা এবং জিহাদ (বা ন্যায়ের সংগ্রাম) এর কথা বলা হয়েছে, যেসব অংশ কোনো মসজিদে পড়া যাবে না। ইসলামী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা: মার্কস, লেলিন, মাও, হিটলার, মুসোলিনী, বুশ, ক্লিনটন,ওবামা, ইন্দিরাগান্ধী, নরসিমা রাও, আদভানী, বল থ্যাকারে প্রমুখ যে কারো আদর্শ ও মত-পথ অনুসরণে কোনো বাধা নেই। এদেশে শুধু একজনেরই জীবনাদর্শ ও মত-পথ অনুসরণ করা যাবে না, -তিনি হলেন মুহাম্মাদ (সা.)।

আর ‘ইতর’ লোকেরা যদি নিতান্তই কুরআন সুন্নাহর চর্চা করতেই চায়, তবে তা করতে হবে, ‘প্রগতিশীল’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ’ ও দলীয় বুদ্ধিজীবীদের নির্দেশ ও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী। ইসলামী শক্তিকে দেশবিরোধীরূপে প্রমাণ করার প্রচেষ্টা: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অনুসরণে যারা টুপি-দাঁড়ি রাখবে কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার কথা বলবে অথবা ভারত বা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো কথা উচ্চারণ করবে তারা সব রাজাকার, আলবদর; এমনকি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে থাকলেও। ধর্মবিরোধিতাকে অধিকার হিসেবে উপস্থাপন: রাসূলুল্লাহ (সা.) কে হেয় প্রতিপন্ন করে ‘‘স্যাটানিক ভার্সেস’’ লেখা সলমন রুশদীর গণতান্ত্রিক অধিকার। গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তার দুশমনরূপে ইসলামকে উপস্থাপনের চেষ্টা: এক কথায়, নাস্তিকতা, ইসলাম-বিরোধিতা ও ভারত-ভক্তি গণতান্ত্রিক; এর বিপরীত সব কিছু অগণতান্ত্রিক ও রাজাকারী। কুরআন-সুন্নাহর প্রতি যার ঘৃণা যতো বেশি, তিনিই ততো বড়ো দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনার ধারক।

ইসলামপন্থীদের স্বাধীনতাবিরোধীরূপে প্রমাণের প্রচেষ্টা: ১৯৭১ –এর ঘটনাবলীর জন্য ইয়াহিয়া কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের দলীয় নেতাদের নিশ্চেষ্টতা ও পরিকল্পনাহীনতা ইত্যাদি আদৌ দায়ী নয়। ৭১ -এর যাবতীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ইসলামপন্থীরা- বিশেষ করে ইসলামী দলসমূহ ও এগুলোর নেতারা। আসল সমস্যা এড়িয়ে ইসলামকে সমস্যারূপে উপস্থাপন: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ঘুষ-দুর্নীতি, খুন-হাইজ্যাক-রাহাজানি, আইন-শৃঙ্খলার ক্রমবিলুপ্তি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, আকাশচুম্বি শোষণ-বৈষম্য ইত্যাদি আসলে কোনো সমস্যাই নয়। বাংলাদেশের একমাত্র (বা মূল) সমস্যা হলো কুরআন-সুন্নাহর চর্চা ও ইসলামী দল। ভারত বিরোধিতাকে বাংলাদেশের বিরোধিতারূপে প্রমাণ করার চেষ্টা: ৭১-৭২ সালে ভারত যুদ্ধবিধ্বস্ত দরিদ্র বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়েছে, পাটের আন্তর্জাতিক বাজার দখল করেছে, বাবরী মসজিদ ধ্বংস করে তার বুকের উপর রাম মন্দির নির্মাণ করেছে, তালপট্টি দ্বীপ দখল করেছে, গঙ্গা-তিস্তায় বাঁধ দিয়েছে।

তারপরও বাংলাদেশের প্রতিটি সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক মানুষের পবিত্র কর্তব্য হলো ভারত ও ভারতীয়দের এরূপ যাবতীয় কর্মকান্ডের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন প্রদান করা। আর যারা ভারত ও ভারতীয়দের উপরোক্ত ‘প্রগতিশীল’ কাজসমূহের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবে, তারা নিঃসন্দেহে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’, মৌলবাদী, রাজাকার ও আলবদর। ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত সময়কে বাংলাদেশের স্বর্ণযুগরূপে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা: একথাও সবাইকে মানতে হবে যে, বিজয় দিবস থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত সময়টিই ছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ, এ সময়ে জনগণের সুখ-সমৃদ্ধির কোনো সীমা-পরিসীমা ছিলো না এবং গণতন্ত্রও ছিলো সম্পূর্ণ উন্মুক্ত ও অবাধ। বলা বাহুল্য, এটা যারা মানবে না, তারা অবশ্যই ঘৃণ্য রাজাকার- আলবদর। এদেশে দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত বুর্জোয়া গণতন্ত্র, জনগণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সুবিধাতন্ত্র, নৈরাজ্যবাদ ইত্যাদি আপামর জনগণকে ক্রমবর্ধমান শোষণ, দুর্নীতি, দারিদ্র, বৈষম্য, প্রবঞ্চনা, হতাশা ও অশ্লীলতা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি।

এমতাবস্থায়, মানুষ যে ক্রমশঃ একমাত্র বিকল্প ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকতে থাকবে, এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। সম্ভবত, এ ইসলাম আতংক থেকেই তথাকথিত প্রগতিবাদী ও ধর্মরিপেক্ষতাবাদীরা (অর্থাৎ ধর্মহীনবাদীরা) যত্রতত্র ইসলামী দলের প্রতিচ্ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। প্রগতিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা হয়তো এটাও বিশ্বাস করেন যে, ছলে-বলে-কৌশলে প্রধান ইসলামী দল (বা দলসমূহ) কে একবার হীনবল করে দিতে পারলেই দেশের বাদবাকী অসংগঠিত বা কম সংগঠিত ইসলামী শক্তিসমূহকে নির্মূল করে দিতে তাদের তেমন একটা বেগ পেতে হবে না। এজন্যই তারা গোয়েবলসীয় পদ্ধতিতে বর্তমান প্রজন্মের মন-মগজে একথা ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন যে, যারাই টুপি-দাঁড়ি রাখেন, নামায-কালেমা পড়েন, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন- তারা সব ঢালাওভাবে রাজাকার-আলবদর। এটাও ক্রমশঃই সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, প্রগতিবাদী-ধর্মনিরপেক্ষতা-বাদীদের মূল লক্ষ্য আসলে কোনো ইসলামী ব্যক্তিত্ব নয়; মূল লক্ষ্য হলো ইসলাম।

একদিকে মুসলিম চিহ্ন অপরদিকে ইসলামবিরোধিতা: এটা কি আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের স্ববিরোধিতা নয়? আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী মুসলিমদের (?) পিতৃপ্রদত্ত নামসমূহও (সাধারণত) তো আরবি ও ইসলামী, যা তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী ঘোরতর ‘মৌলবাদী’ ও ‘সাম্প্রদায়িক’। সুতরাং, এ সমস্ত মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক নাম ঘৃণার সঙ্গে ত্যাগ করে তারা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘প্রগতিশীল’ নাম গ্রহণ করছেন না কেনো? তাদের পিতামাতা নিশ্চয়ই তাদের (মধ্যকার পুরুষদের) মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক ‘খৎনা’-ও করিয়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারেই বা তারা এখন কি করবেন? তাদের পরবর্তী বংশধরদের কি আর সাম্প্রদায়িক ‘খৎনা’ করানো হবে না? বিয়ের সময় তাদের কোনো মৌলবাদী ‘আকদ’ ‘কাবিন’ ‘দেনমোহর’ ইত্যাদি হয়নি তো? হয়ে থাকলে এ ব্যাপারেই বা এখন তারা কি সিদ্ধান্ত নেবেন? এখন কি ঐ বিয়েকে নাকচ করে দিয়ে তারা ও তাদের বংশধররা “লিভ টুগেদার” করবেন? তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার পর তাদের কোনো মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক কাফন, জানাজা, দাফন ইত্যাদি হবে না তো? তাদের মধ্যে এ ন্যাক্কারজনক স্ববিরোধিতা কেনো? মৌলবাদের বিরুদ্ধে তারা যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু করেছেন, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রকাশ্য ও পূর্ণভাবে ইসলামবিরোধিতার বলিষ্ঠ ঘোষণা তারা দিতে পারছে না কেনো? মেরুদন্ডহীনতার জন্য? ভন্ডামীর জন্য? নাকি কাপুরুষতার জন্য? ইসলাম কি প্রতিক্রিয়াশীল? আর প্রগতির দাবিদাররাও কি সর্বক্ষেত্রে প্রগতিশীল? যে মতবাদ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিকাশ এবং সে কারণে সমাজ ও বিশ্বব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে খাপ খেয়ে চলতে সক্ষম, সেটাকেই বলা যায় প্রগতিশীল। আর যে মতবাদ এ ব্যাপারে অক্ষম, সে মতবাদই হলো প্রতিক্রিয়াশীল। সমাজবাদী- সাম্রাজ্যবাদীরা আজ গলাগলি করে আওয়াজ তুলছেন যে, তারাই প্রগতিশীল এবং মূলতঃ ইসলামই হলো মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল।

কি আশ্চর্য! যে মতবাদ ৭০ বছরও টিকলো না, সে মতবাদ হলো প্রগতিশীল; আর যে মতবাদ ১৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবিকৃতভাবে টিকে থাকলো সেটা হলো প্রতিক্রিয়াশীল? আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের অনেকেই জানেন না বা স্বীকার করতে চান না যে- ইসলামই হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র যথার্থ প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও শোষণমুক্ত ব্যবস্থা। এই শোষণমুক্ত ইসলামী সমাজের মডেল হলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও খুলাফায়ে রাশেদার আমলের সমাজব্যবস্থা। তাছাড়া, অমুসলিমের উপর কোনো প্রকার নিপীড়ণ, শোষণ বা হয়রানি সম্পূর্ণরূপে ইসলামবিরুদ্ধ। অথচ, আওয়ামী লীগার ও বামপন্থীরা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই না জেনে বা জানার কোনো তোয়াক্কা না করে, কুরআন-হাদীসে বিধৃত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক দর্শন এবং তার সঙ্গে পুঁজিবাদী-সমাজবাদী ব্যবস্থার তুলনামূলক বিচার না করে এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে অন্ধ-একগুঁয়েমীর সঙ্গে ইসলামের ওপর আঘাত হেনে চলেছেন এবং অন্ধভাবে ভারত ও ভারতীয়দের যাবতীয় কর্মকান্ডের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের এই অন্ধতাকে কি প্রতিক্রিয়াশীলতা বলা যায় না? মৌলবাদ ও সংকীর্ণতার রোগে রোগী কারা? বস্তুত: কুরআন-সুন্নাহর সত্যিকার অনুসারীরা কখনোই ‘মৌলবাদ’ শব্দের উৎপত্তিগত অর্থে মৌলবাদী নন।

আর যদি মৌলবাদের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় এবং কোনো জীবনদর্শনের মূলধারা বা মূলনীতির অনুসরণকেই “মৌলবাদ” বলে অভিহিত করা হয়, তাহলে সকল ইসলামপন্থী বা মুসলিমই মৌলবাদী। একই বিচারে, কার্লমার্ক্সের মূল মন্ত্রের অনুসারীরাও মার্কসীয় মৌলবাদী, মুক্ত অর্থনীতি বা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অনুসারীরাও পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী মৌলবাদী এবং ভারত-ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্ধ ভক্তরা ভারতপন্থী বা ব্রাহ্মণ্যবাদী মৌলবাদী। অন্ধ মৌলবাদী কারা? যারা কুরআন হাদীসে বিধৃত জীবনদর্শন সম্পর্কে কিছুই জানার তোয়াক্কা না করে অন্ধভাবে ইসলামকে গালাগাল করছেন এবং বস্তুবাদী অগ্রগতির স্তর, বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি, বাংলাদেশ প্রেক্ষিত, আর্থসামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামোর ম্যাট্রিক্স ইত্যাদি বুঝার ধার না ধেরে বিভিন্ন মুখরোচক ইজম বা মতবাদ অন্ধভাবে ১৬ কোটি মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছেন- সেই অন্ধ একগুঁয়ে লোকেরাই কি মৌলবাদী ও সংকীর্ণ চিন্তার অধিকারী নয়? ইসলাম আংশিক, না পূর্ণাঙ্গ? কুরআন ও হাদীসে রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, আইনব্যবস্থা, যুদ্ধনীতি, বাণিজ্যনীতি, সম্পদের বন্টননীতি ইত্যাদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দেওয়া আছে এবং সেগুলো পুংখানুপুংখরূপে মেনে চলা সকল কালের সকল মুসলিমের জন্যই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম বা জিহাদকে। সচেতন মুসলিমরা এটা ভালো করেই জানেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) শুধু শ্রেষ্ঠ নবীমাত্রই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান, সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনবিদ, বিচারক, সমরবিদ ও সেনাপতি।

আর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সকল দিকের অনুসরণও প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক। কোনো মুসলিম যদি বলে, ইসলামের এই (ফরয) নির্দেশ স্বীকার করবো, কিন্তু ওই ফরয নির্দেশ স্বীকার করবো না; তাহলে সংজ্ঞানুযায়ী সেই ব্যক্তি আর মুসলিম (বা আত্মসমর্পনকারী) হতে পারে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কি ভুল ছিলো? শেখ মুজিবুর রহমান (ও নেতা-সহযোগীরা) ১৯৪৭ সালে যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন, তারই ভৌগলিক কাঠামো থেকে ১৯৭১ সালে বেরিয়ে আসে বর্তমান বাংলাদেশের কাঠামো। অথচ, অনেকে বলেন, পাকিস্তানের জন্মটিই ভুল ছিলো। তাহলে তারা কি বলতে চান- পাকিস্তান আন্দোলন করে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর নেতা-সহযোগীরা ভুল করেছিলেন? লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তানেরও তো মূলে ছিলো ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্ব।

সেদিন যদি নেতারা অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না করতেন, তাহলে বর্তমান বাংলাদেশ আজ বঙ্গ প্রদেশের অংশ হিসেবে ভারতেরই অন্তর্ভুক্ত থাকতো। সেক্ষেত্রে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা কি আদৌ সম্ভবপর হতো? তাই, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে ভুল বলার দ্বারা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকেই কি অস্বীকার করা হয় না? ঐতিহাসিক ৬ দফায় কি স্বাধীনতার বিষয় ছিলো? ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার উপর অবিচল ছিলেন। কিন্তু ৬ দফায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয় তো দূরের কথা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণ কিংবা দরিদ্র জনগণের শোষণ ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির ব্যাপারেও একটি শব্দমাত্র ছিলো না। বস্তুতঃ ৬ দফা ছিলো পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই অবাঙ্গালী পুঁজিপতি ও আমলাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পারা পূর্ব পাকিস্তানী উঠতি পুঁজিপতি ও আমলাদেরই শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার দলিল। স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা প্রথম কারা করেন? প্রকৃত প্রস্তাবে, ১৯৬৩-৬৪ সালের দিকে যিনি সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তা-ভাবনা করেন, তাঁর নাম বিচারপতি ইবরাহীম (১৯৬২ তে আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী সংবিধানে আইনমন্ত্রী হিসেবে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে বরখাস্তকৃত)।

এরপর সশস্ত্র উপায়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রথম উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন পাকিস্তান নেভীর কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন এবং তার দুঃসাহসী সহযোদ্ধারা। রাজনীতির মঞ্চ থেকে স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কিন্তু এসব উদ্যোগকে স্বীকার করলে স্বাধীন বাংলাদেশ এর কৃতিত্বের সিংহভাগই বিচারপতি ইব্রাহীম, কমান্ডার মোয়াজ্জেম, মাওলানা ভাসানী প্রমুখকে দিতে হয় বিধায় বর্তমান আওয়ামীলীগপন্থীরা এ ব্যাপারে কোনোদিনই উচ্চবাচ্য করেননি, আজও করেন না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা কি আওয়ামী লীগের পূর্ব-পরিকল্পিত? পরিকল্পনাহীনতার জন্য দায়ী কে? আওয়ামী লীগের কোন প্রকাশ্য বা গোপন বৈঠকে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলো? কারা উপস্থিত ছিলেন সেই বৈঠকে? বাস্তবতা হলো এই যে, এরকম কোনো সিদ্ধান্তই কখনো গ্রহণ করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা যদি আওয়ামী লীগের পূর্ব পরিকল্পিত হয়েই থাকে, তাহলে তো পাকিস্তানী হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ুক আর নাই পড়ুক আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতোই।

প্রশ্ন হলো, হানাদাররা ঝাঁপিয়ে না পড়লে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করবে বলে আওয়ামী লীগ সাব্যস্ত করেছিলো? এ প্রশ্নের সদুত্তর আওয়ামী লীগাররা দিতে পারবেন কি? ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পেছনে সিরাজুল আলম খান- আ.স.ম. আবদুর রব- শাজাহান সিরাজ প্রমুখের জঙ্গী আবেগ ছাড়া অপর কোনো পরিকল্পনাই ছিলো না। যুদ্ধের কোনো প্রকার স্ট্র্যাটেজী, ট্যাকটিকস, চেইন অব কমান্ড, মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি কিংবা পশ্চাদপসরণের কোনো পরিকল্পনা ইত্যাদির সার্বিক অনুপস্থিতিই তার প্রমাণ। এই পরিকল্পনাহীনতার জন্যই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দিশেহারা হয়ে সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে কোনো রকমে ভারতে পাড়ি দিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যে কোনো যুদ্ধ শুরুরই অবশ্যম্ভাবী ও অপরিহার্য পূর্ব কাজ হলো যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজী, ট্যাকটিকস, স্ট্রাইকিং ফোর্স, সাপোর্টিং ফোর্স, কমান্ড স্ট্রাকচার, চেইন অব কমান্ড এবং গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্রে মুক্তাঞ্চল, পশ্চাৎভূমি ইত্যাদি নির্ধারণ করা। এগুলোকে বলা হয় পরিকল্পনা।

কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান বা তাঁর দল কি আদৌ কোনো স্ট্র্যাটেজী বা কমান্ড স্ট্রাকচার নির্ধারণ করেছিলেন? এর বিস্তারিত বিবরণ কি আওয়ামী লীগারদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যদি পূর্ব পরিকল্পিত হয়েই থাকে, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি, মুদ্রানীতি, শিল্পনীতি, কৃষিনীতি, বাণিজ্যনীতি, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদির রূপ কি হবে তার আদৌ কোনো নীলনক্সা করা হয়েছিলো কি? হয়নি। আবদুল মালেক উকিল আগরতলায় পৌঁছেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন যে, গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু তাঁদের নির্দেশ দিয়ে যাননি (জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৬-১৯৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৫০০)। তাজউদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামও ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, মুজিবের আসল পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানতেন না। (শেখ মুজিবর রহমানের শাসনকাল, মওদুদ আহমদ, পৃষ্ঠা-৩৫৪) আওয়ামী লীগের অতি ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ-কূটনীতিবিদ কামরুদ্দীন আহমদ তাঁর ‘‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় ও অতঃপর’’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগের নেতারা এমনিভাবে দেশ ত্যাগ করায় এটাই পরিষ্কার হয়েছিলো যে, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য শেখ সাহেব বা আওয়ামী লীগের কোন প্রস্তুতি বা পরিকল্পনাই ছিলো না। ’’ (পৃষ্ঠা-১২১)? শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং বিশ্ববরেণ্য সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের কাছে স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাঁর কোনোই প্রস্তুতি ছিলো না (Bangladesh Documenys, Vol II, Page 615) স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানের এই সরল স্বীকারোক্তির পর এ ব্যাপারে আর কোনো কথাই থাকতে পারে না; থাকা উচিত নয়।

এককথায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পেছনে কোনো দল বা ব্যক্তির কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাই ছিলো না। বস্তুত: মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিলো ২৮ বছরব্যাপী পাকিস্তানী শাসক-শোষক গোষ্ঠীর নির্মম উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, ৭১ এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি, নিরস্ত্র-অপ্রস্তুত জনগণের ওপর হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলা, বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য নরহত্যা-ধর্ষণ-ধ্বংসযজ্ঞ, তরুণ-ছাত্র-যুবক ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের তুলনাবিহীন বীরত্ব, হানাদারদের বর্বরতার পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র জনগণের প্রতিরোধ সৃষ্টি, ভারতের স্বার্থ ও ভূমিকা ইত্যাদি ঘটনা প্রবাহেরই অনিবার্য ফলশ্রুতি। বস্তুত হানাদার বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তৎকালীন মেজর জিয়া, মেজর রফিক, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর এম এ জলিল, মেজর নুরুজ্জামান, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী প্রমুখ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী বাঙ্গালী অফিসার ও জওয়ানরা। এছাড়া সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী টগবগে তরুণরাও গড়ে তুলেছিলো দুর্বার প্রতিরোধ। এর মধ্যে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলো কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম- এর নেতৃত্বাধীন বাহিনী।

দলীয় নেতৃবৃন্দ ও আজকের উচ্চকন্ঠ বুদ্ধিজীবীরা প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আদৌ সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাঁদের কেউ কেউ ভারতের নিরাপদ মাটিতে অর্থ, নেতৃত্ব ও ভারত সরকারের আনুকূল্য লাভের ধান্ধায় ব্যস্ত ছিলেন, আর কেউবা এখানে সেখানে চাকরী করেছিলেন মাত্র। স্বাধীনতা যুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার একাংশ: ২৮.০২.১৯৭১ তারিখে গভর্নমেন্ট হাউজে আলোচনা শেষে শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীণ গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে বলেছিলেন, ‘‘আমার অবস্থা হলো- দু’পাশে আগুন, মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে। হয় সেনাবাহিনী আমাকে মেরে ফেলবে, নয় আমার দলের চরমপন্থীরা আমাকে হত্যা করবে। কেনো আপনারা আমাকে গ্রেফতার করছেন না? টেলিফোন করলেই আমি চলে আসবো’’ (নিয়াজীর আত্মসমর্পনের দলীল, মেজর সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা:৫৬)।

১৯৭১ সালের ৬ মার্চ আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, ‘‘বিচ্ছিন্নতা থেকে পূর্ব পাকিস্তান কিছুই পাবে না, রক্তপাত ও উৎপীড়ন ছাড়া। ..আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেট স্বাধীনতার জন্য নয়, স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য’’ (পাকিস্তান ক্রাইসিস, ডেভিড লোসাক, পৃষ্ঠা ৭১-৭২) এটা সুস্পষ্ট যে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যেই এ অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্বশাসন চাইছিলেন (এবং ইয়াহিয়া-ভূট্টো চক্রই হঠকারিতা ও ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিলো। ) ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন বলেই যদি শেখ মুজিবুর রহমান সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে ঐ দিন সন্ধ্যায় তিনি তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে সমবেত শত শত দেশীবিদেশী সাংবাদিকদের সামনে কেনো ঘোষণা করলেন যে, পরবর্তী কমসূচী হলো ২৭ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল? এর অর্থ কি? কেনো রাত সাড়ে দশটার সময় শেখ মুজিবুর রহমান ডঃ কামাল হোসেনের কাছে ব্যগ্রতা প্রকাশ করলেন পরদিন (২৬ মার্চ) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠকে বসার জন্য (ডঃ কামাল হোসেন লিখিত প্রবন্ধ, ‘দি ডেইলী নিউজ, ২৬ মার্চ, ১৯৮৭ সংখ্যা)? এই ব্যগ্রতা কি একথাই প্রমাণ করে না যে, মাত্র ৬০ মিনিট পরে কি ঘটতে যাচ্ছে এ ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ধারণাই ছিলো না? শেখ মুজিবুর রহমান-ই যদি স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি ওই কালরাতে বাড়িতে বসে থাকলেন কোন যুক্তিতে? পৃথিবীর কোনো দেশের, কোনো কালের কোনো বিপ্লব বা মুক্তিযুদ্ধের নেতা কি এভাবে বীভৎস শত্রুর হাতে ধরা দেওয়ার জন্য আপন শোয়ার করে বসে ছিলেন? কেনো ইন্দিরা গান্ধী তিক্ত ক্ষোভের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে বলেছিলেন, ‘‘ভূ-ভারতে কে কবে শুনেছে যে, যুদ্ধ আরম্ভ করে সেনাপতি শত্রুপক্ষের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়?” আসলে, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার কথা বলতে আদৌ রাজী ছিলেন না। সিরাজুল আলম খান ও তাঁর সহযোগিরা শেখ মুজিবুর রহমান-এর উপর এ ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করলে, তিনি ৬ মার্চ দিবাগত রাত ২ টার সময় তৎকালীন জি.ও.সি. মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার কাছে বিশেষ দূত মারফত এই বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি চরমপন্থীদের পক্ষ থেকে চাপের মধ্যে রয়েছেন, তারা তাঁকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ দিচ্ছে। তাদেরকে উপেক্ষা করার শক্তি তাঁর নেই।

অতএব তাঁকে যেনো সেই রাতেই সেনাবাহিনীর হাতে নিয়ে যাওয়া হয় (নিয়াজীর আত্মসমর্পনের দলীল, মেজর সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা:৬৪) জি.ও.সি. শেখ মুজিবুর রহমান-এর এই আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় অনন্যোপায় শেখ মুজিবুর রহমান-কে পরদিন (৭ মার্চ) তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উগ্রপন্থী তরুণদের শান্ত করার জন্য এটুকু বলতেই হয় যে, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এটাই কি প্রকৃত সত্য নয়? ইয়াহিয়া-ভূট্টো চক্র যদি বাস্তবিকই মনে করতো যে, শেখ মুজিবুর রহমান-ই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক-রূপকার এবং (তাদের দৃষ্টিতে) পাকিস্তান ভাঙার মূল হোতা, তাহলে তারা কি সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও শেখ মুজিবুর রহমান-কে হত্যা না করে ছাড়তো? যখন পাকিস্তানী হানাদাররা মুটে-মজুর-রিক্সাওয়ালা নির্বিশেষে যে কোনো বাঙালীকে দেখামাত্রই হত্যা করছিলো, ঠিক তখনই তারা শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে ধানমন্ডির অপর একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে পরম যত্নে সমাদরে রাখলো কেনো? কেনো রাজনীতিবিদদের প্রায় কেউই শহীদ হলেন না? মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের শ্রেণীবিভাগ নিম্নরূপঃ ছাত্র ৮%, কৃষক ২০%, শ্রমিক ১৪%, চাকুরীজীবী ১৩%, ব্যবসায়ী ১০%, গৃহবধূ ১৪%, শিক্ষক ৩%, অন্যান্য ১৭% (একাত্তুরের বধ্যভূমির সন্ধানে, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা-৯৩, পৃষ্ঠা-২১) লক্ষ্যণীয় এখানে শহীদ রাজনীতিবিদদের সংখ্যা শূণ্য। এর কারণ কি? এদের সকলেই কি অতুলনীয় অপরাজেয় দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন? নাকি আসলে এঁরা যুদ্ধের ময়দানের ধারে কাছেও কখনো যাননি? তখন এসমস্ত নেতা-এমএনএ-এমসিএ-রা প্রকৃত যুদ্ধের ময়দান থেকে অনেক দূরে, কোলকাতা-আগরতলা-দেরাদুন-দিল্লীতে বসে যৌবন উপভোগ করছিলেন, -এটাই কি কঠোর সত্য নয়? বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কতজন মুক্তিযোদ্ধা? ১৯৭১ সালে, বিশেষতঃ ১৪ ডিসেম্বর তারিখে যেসব বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছিলেন, তারা কি মুক্তিযুদ্ধে আদৌ অংশগ্রহণ করেছিলেন? মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের কার কি অবদান ছিলো? নাকি তারা মুক্তিযুদ্ধে আদৌ অংশগ্রহণ করেননি? বরং এই ঢাকা শহরেই নিজ নিজ বাসাবাড়িতেই পরম নিশ্চিন্ত মনে বসে ছিলেন? এসব বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই কি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছিলেন না? স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে যোগসাজস না থাকলে এইসব বুদ্ধিজীবীরা ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা শহরেই নিজ নিজ বাসাবাড়িতে বসবাস করছিলেন কিভাবে? কি ভরসায়? পরাজয়ের মুহূর্তে এইসব বুদ্ধিজীবীরা প্রাণ দিয়ে ন্যাক্কারজনক হানাদার- নির্ভরতার পায়শ্চিত্তই করে গিয়েছিলেন, এটাই কি মর্মান্তিক সত্যি নয়? জহির রায়হান কেনো নিহত হলেন? জহির রায়হান নিখোঁজ হন ৩০ জানুয়ারী ১৯৭২ তারিখে। কোলকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে, তিনি স্বাধীনতার একচ্ছত্র কৃতিত্বের দাবীদার দলটির নেতা-এমএনএ-এমসিএ-দের তাস-জুয়া-মদপান- নারীসম্ভোগ অধ্যুষিত জীবনধারার প্রামাণ্য চিত্র তুলে এনেছিলেন। এই জহির রায়হানকে কারা হত্যা করলো? তখনতো দেশে রাজাকার আলবদরের নাম-গন্ধও ছিলো না।

মুক্তিযুদ্ধে কর্তৃত্ব কার ছিলো? আওয়ামী লীগের, না ভারতের? একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ যদি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলের উদ্যোগ ও নেতৃত্বেই হয়ে থাকে, তাহলে প।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.