আমি চাই শক্তিশালী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ
কেন যূক্ত বাংলা স্বাধীন না হয়ে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান হল?
ভারত বিভাগের অব্যবহিত পূর্বে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে সোহরাওয়ার্দী জয়লাভ না করলে জিন্নাহ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা হতে পারতেন না। কিন্তু জিন্নাহ যখন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা হন, ঠিক ওই একই সময়ে সোহরাওয়ার্দীও এক স্বাধীন যুক্ত বাংলার প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। জিন্নাহ যুক্ত বাংলা পরিকল্পনা বাংলার মুসলমানদের জন্য মঙ্গলকর হবে মনে করে এর সমর্থন করেন। ১৯৪৭ সালের ২৬ এপ্রিল জিন্নাহর সাথে এক আলাপ-আলোচনায় লর্ড মাউন্টবেটেন তাকে জানান, সোহরাওয়ার্দী ‘মনে করেন যে তার পক্ষে যুক্ত বাংলাকে ধরে রাখতে সম্ভব হবে, যদি এটি পাকিস্তান অথবা হিন্দুস্তান কোনোটাতেই যোগদান না করে। ’ ‘টপ সিক্রেট’ এই আলাপ-আলোচনা এভাবে লিপিবদ্ধ হয়ঃ ‘আমি মি. জিন্নাহকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলাম পাকিস্তানের বহিভূêত থেকে যুক্ত বাংলার অবস্থান সম্পর্কে তার কী অভিমত?’ কোনো দ্বিধা না করে তিনি বললেনঃ ‘আমি আনন্দিত হব।
কলকাতা ব্যতীত বাংলার কী মর্যাদা রয়েছে? তাদের (বাঙালিদের) পক্ষে যুক্ত থাকা এবং স্বাধীন থাকাই ভালো হবে। আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ যে এরা আমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখবে। ’ আমি তখন বললাম, সোহরাওয়ার্দী বলেছেন¬ যদি বাংলা যুক্ত এবং স্বাধীন থাকে তাহলে বাংলা কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করবে। জিন্নাহ উত্তরে বলেনঃ ‘সেটাই তো ঠিক, যেমন আমি আপনার কাছে প্রকাশ করেছি, পাকিস্তান কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করবে। ’ (মাউন্টবেটেন পেপারস, লর্ড মাউন্টবেটেন ও জিন্নাহর মধ্যে ১৯৪৭ সালের ২৬ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ইন্টারভিউয়ের রেকর্ড, Nicholas Mansergh, The Transfer of Power, 1942-47, vol. X, পৃঃ ৪৫২-৪৫৩ দ্রঃ)
১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিলে লর্ড মাউন্টবেটেন নিশ্চিত হন, জিন্নাহ যুক্ত বাংলা পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না।
ওই তারিখে বাংলার গভর্নর বারোসের কাছে এক টেলিগ্রামে তিনি বলেনঃ ‘এটা ভুলবেন না যে আমার প্ল্যানে পাকিস্তান অথবা হিন্দুস্তানের অংশ নয় এমন একটি যুক্ত অথচ স্বাধীন বাংলার পথ খোলা রেখেছে। জিন্নাহ এই প্ল্যানের কোনো বিরোধিতা করবে না। ’ (‘টপ সিক্রেট’, Mansergh, vol. X,পৃঃ ৪৭২ দ্রঃ) মে মাসে অনুষ্ঠিত ভাইসরয়’স মিটিংয়ে ‘ভাইসরয় বলেন ... মি. জিন্নাহ পাকিস্তান থেকে পৃথক একটি স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা অনুমোদন করেন। ’ (মাউন্টবেটেন পেপারস, ১৯৪৭ সালের ১ মে, Mansergh, vol. X,পৃঃ ৫১২ দ্রঃ) এমনকি ১৯৪৭ সালের মে মাসের প্রথম দিকে একটি স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য জিন্নাহর সম্মতি সম্পর্কে সোহরাওয়ার্দী নিঃসংশয় ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৭ মে ‘টপ সিক্রেট’ মাউন্টবেটেন পেপারসে উল্লেখ রয়েছেঃ ‘মি. সোহরাওয়ার্দী তাকে (গভর্নর বারোসকে) বলেন, মি. জিন্নাহ বলেছেন যে তিনি একটি স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে রাজি হবেন।
’ Mansergh, vol. X,পৃঃ ৬৫৭ দ্রঃ)
এসব বিষয় পর্যালোচনা করে গ্রন্থকার স্ট্যানলি ওয়ালপার্ট মন্তব্য করেন, ‘জিন্নাহ একটি স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠাকল্পে আগ্রহসহকারে স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি ছিলেন। কিন্তু নেহরু ও প্যাটেল এই পরিকল্পনাকে কংগ্রেস এবং ভারতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে অভিসম্পাত বলে মনে করেন এবং ভয় করেন যে মুসলিম প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি যুক্ত ‘বাংলাদেশ’ ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের সাথে নিবিড়তর সম্পর্ক স্থাপন করবে। ’ (জিন্নাহ অব পাকিস্তান, পৃঃ ৩২০) শীলা সেন তার গ্রন্থে প্রায় একই ধরনের মত প্রকাশ করেনঃ ‘জিন্নাহ এই [যুক্ত বাংলার] পরিকল্পনার বিরুদ্ধাচরণ করেননি। কিন্তু কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ প্রথম থেকেই এর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন। ’ ‘প্যাটেল ও নেহরুর বিরোধিতা ছিল জেদে পূর্ণ।
’ (মুসলিম পলিটিকস ইন বেঙ্গল, পৃঃ ২৪৩) ‘বাংলার কংগ্রেস নেতাদের কাছে লিখিত বেশ কিছু পত্রে প্যাটেল এই পরিকল্পনাকে নিন্দা করেন। (পৃঃ ১৩০)
জিন্নাহ জানতেন যে বাঙালি হিন্দুরা মন-প্রাণ দিয়ে যুক্ত বাংলার সমর্থন করে না। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে জিন্নাহ বলেন, ‘দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার বেশির ভাগ হিন্দু বাংলার বিভক্তি চায়। ’ Mansergh, vol. X, পৃঃ ৮৫২ দ্রঃ) ১৯৪৭ সালে জিন্নাহ বাংলায় রেফারেনডাম করার প্রস্তাব করলে ব্রিটিশ কেবিনেট ২০ মে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। Mansergh, vol. X, পৃঃ ৯২১-৯২২ দ্রঃ) ১৯৪৭ সালের ২৮ মে লর্ড মাউন্টবেটন লন্ডনে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ কেবিনেট মিটিংকে অবহিত করেন, জিন্নাহ তাকে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, তার পক্ষে বাংলার বিভক্তি মেনে নেয়া সম্ভব হবে না।
Mansergh, vol. X, পৃঃ ১০১৪)
পক্ষান্তরে হিন্দু মহাসভা যুক্ত বাংলা সম্পর্কে প্রথম থেকেই একটি নেতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করে। নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি যুক্ত বাংলা পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন এবং ভাইসরয় লর্ড মাউন্টবেটনের কাছে তিনি একটি তীব্র প্রতিবাদ পাঠান। ২ মে তারিখে লিখিত একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘একটি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা সম্বন্ধে কিছু এলোমেলো কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এর ভাবার্থ আমাদের কাছে একেবারেই বোধগম্য নয় এবং আমরা এর সমর্থন কোনোভাবেই করি না। আমরা হিন্দুদের কাছে এই পরিকল্পনা কোনো উপকারে আসবে না।
স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা প্রকৃতপক্ষে একটি পাকিস্তানের রূপ নেবে... আমরা কোনোভাবেই ভারতের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না। ’ (মাউন্টবেটেন পেপারস Mansergh, vol. X,পৃঃ ৫৫৭ দ্রঃ) সোহরাওয়ার্দী জানতেন, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ছাড়াও হিন্দু মহাসভা যুক্ত বাংলা পরিকল্পনার পরম বিপক্ষে ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ মে ভাইসরয়ের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ঝমড় ঊ. গমপংমললপ-এর কাছে এক পত্রে সোহরাওয়ার্দী লেখেন, ‘পার্টিশানের ব্যাপারে হিন্দু মহাসভা হিন্দুদের ধ্যান-ধারণাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ’ (Mansergh, vol. X, পৃঃ ৮৩০ দ্রঃ)
বাঙালি হিন্দুরা তাদের দৃষ্টিতে মনে করে, ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে একজন মুসলমান অভিষিক্ত হওয়ার পর বাংলায় রাজনৈতিক প্রাধান্য এরা চিরদিনের জন্য হারিয়েছে। বাংলার কংগ্রেস তাদের তরফ থেকে যুক্ত বাংলা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা চালানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে ভার দেয়নি অথবা কোনো সংস্থা স্থাপনা করেনি।
যুক্ত বাংলা পরিকল্পনা কার্যকর না হওয়ার কারণগুলোর বিশ্লেষণ করে শীলা সেন তার গ্রন্থে বলেন, ‘সম্পূর্ণ স্বাধীন বাংলা পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার’ প্রথম কারণটি হচ্ছে ‘কংগ্রেস নেতাদের পুরোপুরি বিরোধিতা’। (পৃঃ ২৪৩)
যুক্ত বাংলা পরিকল্পনাকে পুরোপুরি অকেজো করে দেয়ার জন্য বাঙালি হিন্দুরা বাংলার বিভক্তি দাবি করে। বাংলার বিভক্তি সম্পর্কে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের মিটিংয়ের আগে বাংলার কংগ্রেস এবং বাংলার হিন্দু মহাসভা বাংলার বিভক্তি দাবি করে। ১৯৪৭ সালের এপ্রিলের প্রথমভাগে প্রাদেশিক হিন্দু কনফারেন্স ঘোষণা করেঃ ‘বাংলার হিন্দুদেরকে একটি শক্তিশালী জাতীয় সরকারের অধীনে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করতে হবে। ’ (অমৃতবাজার পত্রিকা), ৫ এপ্রিল, ১৯৪৭) ১৩ মে সর্দার প্যাটেল বাঙালি হিন্দুদের একজন নেতা কে সি নিয়োগিকে চিঠিতে লেখেনঃ ‘সম্পূর্ণ স্বাধীন বাংলার দাবি একটি ফাঁদ, যাতে এমন কি কিরণ শংকরও শরৎ বাবুর সাথে পড়ে যেতে পারেন... বাংলার হিন্দুদের বাঁচানোর একমাত্র পথ বাংলার পার্টিশনের দাবি অব্যাহত রাখা এবং অন্য কিছুতে কর্ণপাত না করা... অমুসলমানদের বাঁচাতে হলে বাংলাকে ভাগ করতেই হবে।
’ (শীলা সেন, পৃঃ ২৪৪) নেহরু মনে করেন, যুক্ত বাংলা বাস্তবায়িত হলে তার দ্বারা বাঙালি মুসলমানরা বেশি উপকৃত হবে। তার নেতৃত্বাধীনে ভারতীয় কংগ্রেস এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করলে যুক্ত বাংলার জন্য সোহরাওয়ার্দীর স্বপ্নের যবনিকাপাত ঘটে। বাংলার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় বাঙালি মুসলমানরা কখনো বাংলার বিভক্তিকরণ চায়নি। পক্ষান্তরে বাংলাকে ভাগ করার দাবি সম্পর্কে বাঙালি হিন্দুদের মনোভাব অমৃতবাজার পত্রিকা (৫ এপ্রিল, ১৯৪৭ এভাবে প্রকাশ করেঃ ‘এটা শুধু পার্টিশনের প্রশ্ন নয়, এটা হিন্দুদের জীবন মরণের প্রশ্ন। ’
ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রায় শেষ পর্যন্ত বাংলাকে ভাগ করার প্রশ্নে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নেয়নি।
অবশেষে বাংলার বিভক্তি সম্পর্কে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১৯৪৭ সালের ১৭ মে সিদ্ধান্ত নেয়, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদকে দু’টি অংশে মিলিত হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হবে। মুসলিম সংখ্যাগুরু অধ্যুষিত জেলাগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করবে একটি অংশ এবং অপরটি করবে বাংলার অবশিষ্ট জেলাগুলো। বাংলাকে ভাগ করা হবে, কি হবে না এই মর্মে পরিষদের দু’অংশের সদস্যদের পৃথকভাবে বসে ভোট দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়। যেকোনো অংশের অধিকাংশ সদস্য যদি বাংলা বিভক্তির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়, সে ক্ষেত্রে বাংলা ভাগ হবে। (সংশোধিত খসড়া ঘোষণা, ১৭ মে, ১৯৪৭ সাল, Mansergh, vol. X,পৃঃ ৮৮৪ দ্রঃ) বাংলার পার্টিশনের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য পরিষদের সদস্যরা দু’টি ভাগে মিলিত হন।
উচ্চবর্ণের হিন্দু সদস্যরা পার্টিশনের পক্ষে ভোট দেন, পক্ষান্তরে মুসলিম সদস্যরা ও তফসিলি সম্প্রদায়ের অনেকে পার্টিশন বিপক্ষে ভোট দেন।
১৯৪৭ সালের ২০ জুন লর্ড মাউন্টবেটনের কাছে গভর্নর বারোস এক টেলিগ্রাম প্রেরণ করে বাংলার বিভক্তি সম্পর্কে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটের ফলাফল জানিয়ে বলেনঃ ‘অদ্য অপরাহ্নে পশ্চিম বঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্যদের পৃথক মিটিংয়ে [পার্টিশনের] পক্ষে ৫৮ ভোট এবং বিপক্ষে ২১ ভোটে সাব্যস্ত হয় যে [বঙ্গ] প্রদেশকে বিভক্ত করতে হবে... অদ্য অপরাহ্নে পূর্ব বঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্যদের পৃথক মিটিংয়ে [পার্টিশনের] বিপক্ষে ১০৬ ভোট এবং পক্ষে ৩৫ ভোটে সাব্যস্ত হয় যে [বঙ্গ] প্রদেশকে বিভক্ত না করা হয়। ’ Mansergh, vol. XI,পৃঃ ৫৩৬ দ্রঃ) এভাবে বাঙালি হিন্দুদের ভোটে বাংলা দু’টি অংশে বিভক্ত হয়। একটি অংশ অর্থাৎ পশ্চিম বঙ্গ ভারতের সাথে যুক্ত হয় এবং অপর অংশটি অর্থাৎ পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানে যোগদান করে। ফলে যুক্ত বাংলার বাস্তবায়ন ইতিহাসে পর্যবসিত হয় এবং এ ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দীর আপ্রাণ উদ্যম ও আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নেই থেকে যায়।
সময়ের স্রোতে পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়।
ব্যারিস্টার সালাহউদদীন আহমদ
লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারেলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অতিথি অধ্যাপক।
দৈনিক নয়াদিগন্ত ৮ই অক্টোবর ২০০৭ইং
*************************************
বস্তুত পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সহ কিছু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য, নির্যাতন-জুলুম ও অবহেলার জন্যই ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে বাধ্য হই। কিন্তু তাই বলে ১৯৪৭ সালে যে পরিবেশ ও আবহ ছিল তা মিথ্যা হয়ে যায় না। ৭১ সালে পাকিস্তানীদের তাড়িয়ে অখন্ড ভারত মাতায় প্রবেশ করিনি এবং ৯০% জনগণ তাদের ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেনি।
ইসলাম জামাত ও পাকিস্তানের বাপের জমিদারী নয়। আমাদের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানাকেই বাংলাদেশের সীমান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যা ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের ফসল। এর ভিত্তিই হচ্ছে দ্বি-জাতিতত্ত্ব। ভারত ৭১ সম্পূর্ণ নিজ বদ মতলবে আমাদের স্বাধীন করেছিল যা তাজউদ্দিন কতৃক স্বাক্ষরিত ৭ দফা চুক্তি ও ২০০৭ সালে রাহুল গান্ধীর মন্তব্য হতেই প্রমাণিত হয়।
আজকে যদি ১৯৪৭ সালে আমরা আলাদা না হতাম সমগ্র উপমহাদেশের মুসলমানরা শরণার্থীর মত অবহেলিত, নিগৃহিত ও করুণ জীবন যাপন করত। এর প্রমাণ ২০০৬ সালে ভারতীয় শেখর কমিশনের রিপোর্ট;
http://en.wikipedia.org/wiki/Sachar_Committee
ভারতের প্রাক্তন বিচারপতি রাজবিন্দর শেখর ২০০৬ সালে মনমোহন সিং এর কাছে রিপোর্ট দেন যে অতীতে ভারতের বিভিন্ন সরকারের চরম অবহেলার জন্যই সে দেশের মুসলমানদের করুণ অবস্থা। তাও যে টুকু মুসলমানদের অবস্থা ভাল আছে তারা সব সময় পাকিস্তান ও বাংলাদেশের উদাহরণ টানে। বস্তুত এই চাপেই ভারত নামকা ওয়াস্তে হলেও উদ্যোগ মুসলমানদের জন্য নিয়েছে। যা যথেষ্ঠতো নয়ই চরম বৈষম্য মূলক আচরণ।
উদাহরণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ২৩% মুসলমান হলেও সরকারী ও বেসরকারী চাকুরীতে মাত্র ২-৩%। ভারতের মুসলমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে বেশী হলেও ডাক্তার, প্রকৌশলী সহ স্কলার তথা ভাল শিক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে অনেক অনেক কম। উপরন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় জীবন যাপনে প্রায়ই খড়গ নেমে আসে। বাবরী মসজিদ সহ বহু মসজিদ ভাঙা, ১৯৯২ সালে বোম্বে ও ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালানো। আমরা ৭১ সালে স্বাধীন হলেও আলীগ-বাকশালীদের ব্যাপক র্দূনীতি ও ভারতের তাবেদারীর জন্য দেশ ছিল তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ।
ভারতকে বেরুবাড়ী দিয়ে ৩বিঘা পেয়েছি ৩০ বছর পর, ফারাক্কা চালু এবং নৌ-করিডোর দিলেও বিনিময়ে কিছুই পাই নি। আর শহীদ জিয়ার জন্যই ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘে ফারাক্কার বিরুদ্ধে নালিশ করে পানি আনা, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে আজকে পেট্রডলারের দেশ গুলিতে ৪০ লক্ষ বাংলাদেশীর কর্মসংস্থান হয়। ১৯৭৪ সালে দেশ দূর্ভিক্ষে পরলেও জিয়ার ও এরশাদের সময় নাকি আরো খারাপ। রাজনৈতিক প্রতারণারও একটা সীমা আছে, যা তাদের নেই। ২৪ হাজার কিমির নদী পথ এখন মাত্র ৬ হাজার কিমি।
তার উপর হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ হতে(যদিও ষড়যন্ত্র সেই ২০০১ হতেই) এ পর্যন্ত ভারতকে সব একতরফা সুবিধা দিয়ে আসা ছাড়া আর কোন প্রাপ্তিই বাংলাদেশের নাই। উপরন্ত তিতাস নদীর স্বাভাবিক পথ কয়েক মাসের জন্য রুদ্ধ করে ভারতকে করিডোর দিয়েছি। ৭১এ পাকিপন্থী জামাতীদের কিছু এবং অন্যদের দেশবিরোধী আচরণের মানে এই নয় যে ১৯৪৭ সাল ভুল এবং আমাদের এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রাপ্তি ভুল। ভারত হতে শক্ত দেন দরবার করাকে যারা বলে জামাতী ও পাকিপন্থী তারা আসলে ভারতের জারজ সন্তান। তা তারা যতই এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলে জন্ম নিক না কেন! নিজেরা ভারত হতে সময়মত ন্যায্য প্রাপ্তি আনতেতো পারবেই না অন্যকে আনতেও দিবে না।
শুধু শুধু তাদের বলদের মত একতরফা ও মিথ্যা অপবাদ দিবে। ক্যানেইডিয়ান বুদ্ধির ঢেকী যে টরোন্টোতে হরে কৃষ্ণা দল তথা শ্রীকৃষ্ণের দলে ও আড্ডাখানায় প্রায়ই যাওয়ার অভিযোগ আছে তার পক্ষে ১৯৪৭ সালের বিভাজনকে নিয়ে গত্রদাহ, প্রচন্ড দুঃখ থাকতেই পারে। আমার কাছে হল
১৯৪৭ এবং ১৯৭১ = বাংলাদেশ
এর একটি না হলে বাংলাদেশ কখনই হত না। বিশেষ করে ৪৭ সালে ভারত বিভক্ত না হলে কোনদিনও ১৯৭১ আসত না। উপরন্তু আমরা ৭ই নভেম্বর শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে সার্বভৌমত্ব অর্জন করি।
এই সার্বভৌমত্ব ও ভারতের সাথে শক্ত দেনদরবার ক্যানেইডিয়ান বুদ্ধির ঢেকী ও বলদ মানতে নারাজ। শেখর কমিশনের রিপোর্টকে বলে "শেখর কেঠা?"। পাকিস্তান বাদ দিলেও শ্রীলংকাও যে তামিল ভুত তথা বিচ্ছিন্নতাবাদকে দমন করেছে এতেও তার খুব গত্রদাহ। অর্থ দাড়াল ভারত মাতার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই সে শত্রু! কিন্তু ক্যানেইডিয়ান বুদ্ধির ঢেকীর মনে রাখা উচিত অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।