তবে তাই হোক, ক্লান্তিহীন তিল তিল আরোহনে সত্য হোক বিক্খুব্ধ এই জীবন _____ আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি—সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের এক অগ্নিঝরা দিন। ১৯৮৩ সালের এই দিনে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে সূচিত হয়েছিল প্রথম বড় ধরনের আন্দোলন, যা মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলন হিসেবে পরিচিত। সেই থেকে দিনটি স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ দিবস হিসেবে নানান আয়োজনে পালিত হয়ে আসছে । কিন্তু ৯২-এর পর থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে’ প্রভাবে নতুন প্রজন্মের চেতনায় দিবসটি নাড়া দিতে পারছে না। পশ্চিম থেকে আগত এই ভ্যালেন্টাইনের জোয়ারে ভেসে যেতে শুরু করেছে রক্তের অক্ষরে লেখা এক গৌরবময় সংগ্রামের ঐতিহাসিক দিন।
দিনটি এখন পরিণত হয়েছে ভালোবাসা দিবস বহুজাতিক এবং বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য বিক্রির দিন হিসেবে। নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারছে না ফাগুনের এই আগুনঝরা দিনের সঙ্গে মিশে আছে ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের শহীদ জাফর জয়নাল, দিপালী সাহার লাল টকটকে রক্ত—আত্মত্যাগের এক সংগ্রামী ইতিহাস। রক্তের অক্ষরে যারা আমাদের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন, তাদের জন্য অবহেলা ছাড়া আমরা কিছুই দিতে পারিনি। ১৯৮৩ সালের এই দিন মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
(২) সভা, শোভাযাত্রা, সমাবেশ ও ধর্মঘট নিষিদ্ধ ঘোষণা সংক্রান্ত বিধিসমূহ কঠোরভাবে প্রয়োগ হইবে।
(৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ধ্যা ৬টা হইতে ভোর ৫টা পর্যন্ত এবং মেট্রোপলিটন ঢাকার অবশিষ্ট এলাকায় রাত্রি ১০টা হইতে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বলবত্ থাকিবে।
ঘোষণায় বাংলাদেশ সচিবালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় গোলযোগে পর্যবসিত ঘটনাবলীর উল্লেখ করা হয়। ১৪টি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনসমূহের মোর্চা তথাকথিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা কয়িয়াছিল যে, তাহারা সরকারি নীতির প্রতিবাদে সচিবালয় অবরোধ করিবে।
সকাল ১১টায় তাহারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং বক্তারা সামরিক আইন ভঙ্গ করিয়া ছাত্রদেরকে আইন নিজের হাতে তুলিয়া লওয়ার আহ্বান জানাইয়া উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দেয়। ছাত্রনেতা নামধারী এই সকল পেশাদার উসকানিদাতাদের উসকানিতে ছাত্ররা একটি শোভাযাত্রা বাহির করে, যা কিনা সামরিক আইনে নিষিদ্ধ। সরকারের বিরুদ্ধে ধ্বনি দিতে দিতে তাহারা একযোগে সচিবালয়ের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে এবং পুলিশ পুরাতন হাইকোর্টের কার্জন হল সংযোগস্থলে তাহাদিগকে থামাইয়া দেয়।
অতঃপর উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিরা কর্তব্যরত পুলিশের প্রতি ব্যাপকভাবে ইট নিক্ষেপ করিতে শুরু করে এবং পুলিশ কর্ডন ভাঙার চেষ্টা করে। সংখ্যাগত কারণে কোণঠাসা হইয়া শুধু লাঠি ও বেতের ঢাল সজ্জিত পুলিশ বিপদগ্রস্ত হয় এবং জনতাকে ছত্রভঙ্গ করিবার জন্য হোসপাইপের সাহায্যে পানি নিক্ষেপ করে। উহা ব্যর্থ হইলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করিয়া ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়। ’... (দৈনিক ইত্তেফাক : ১৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ১৯৮৩)।
এরশাদের ক্ষমতা দখল : ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।
রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের এভাবে ক্ষমতা দখলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে অনেকটাই নীরবে মিলিটারি স্বৈরশাসন মেনে নিতে বাধ্য হয়। রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নিলেও ছাত্ররা মেনে নেননি এই সামরিক অভ্যুত্থান। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় ছিল আট বছর ২৫৬ দিন। এ সময় দেশের হাজার হাজার মানুষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবরণ করেছে।
হত্যা-গুমের শিকার হয়েছে অসংখ্য নারী-পুরুষ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশেষত ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিছিলে পুলিশের গুলিতে ছাত্র নিহত হওয়ার পর থেকেই দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে।
রক্তাক্ত ১৪ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট : এরশাদের সামরিক শাসন জারির প্রথম দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ করেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে পোস্টার লাগাতে গিয়ে বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর তিন সদস্য গ্রেফতার হন।
এই ছাত্রনেতারা হলেন শিবলী কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান ও আবদুল আলী। পরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাদের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। সেই থেকে শুুরু হয় সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আপসহীন লড়াইয়ের দিনগুলো।
বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসে সাভারের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে গিয়ে শহীদ বেদিতেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। মিছিলের খবর শুনে সাভার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনী চলে আসে, স্মৃতিসৌধে ছাত্রদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন।
সরকারি ফরমান ও তত্পরতার কারণে সে সময় সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে লাল-কালো অক্ষরে এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দেয়াল লিখন অব্যাহত থাকে। ছাত্রদের দেয়াল লিখন সমানে মুছতে থাকে সামরিক সরকারের তল্পিবাহক পুলিশ বাহিনী। পুলিশ যত দেয়াল সাদা চুন টেনে মুছে ফেলে, ছাত্ররা ততই দেয়াল লিখন চালিয়ে যেতে থাকে। এভাবেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে চলছিল দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের প্রাথমিক প্রস্তুতি।
এ সময় ছাত্রনেতারা একটি সর্বাত্মক গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করা হয়। সেটাই ছিল সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম লিখিত প্রতিবাদ।
১৪ ফেব্রুয়ারি ঘটনার প্রতিবাদে ফরহাদ মজহারের লেখা দুটি কবিতার একটি তুলে ধরা হলো :
লাশসকল প্রতিশোধ নেবে
গুম হয়ে যাওয়া লাশসকল প্রতিশোধ নেবে—
বীভত্স কফিনহীন মৃতদেহ রাস্তায় রাস্তায়
মোড়ে মোড়ে
অলিতে গলিতে
অন্ধিতে সন্ধিতে
তোমাদের শান্তিশৃঙ্খলা স্থিতিশীলতার গালে
থাপ্পড় মেরে
অট্টহাসি হেসে উঠবে।
ভোরবেলা
দাঁতের মাজন হাতে ঢুকবে বাথরুমে—
সেখানে লাশ
তোমাদের প্রাতঃরাশে রুটি-মাখনের মধ্যে লাশের দুর্গন্ধ
তোমাদের ভোর সাড়ে সাতটার ডিমের অমলেটে লাশের দুর্গন্ধ
তোমাদের পানির গ্লাসে লাশের দুর্গন্ধ
তোমাদের চায়ের কাপে গলিতে নষ্ট মৃতদেহের রক্ত;
লাশসকল প্রতিশোধ নেবে
লাশসকল হত্যার বদলা চায়।
রিকশায় তোমাদের পাশে যে বসে থাকবে
দেখবে সে একজন লাশ
টেম্পোবাসে তোমাদের গা ঘেঁষে যে বসে পড়বে
দেখবে সে একজন লাশ
ফুটপাতে তোমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে হাঁটছে
দেখবে সে একজন লাশ
অলিতে গলিতে
অন্ধিতে সন্ধিতে
চড়াও হয়ে
লাশসকল প্রতিশোধ নেবে।
প্রতিটি লাশের গায়ে ৩৬৫টি গুলির দাগ
(দিনে একবার করে বাংলাদেশকে বছরে ৩৬৫ বার হত্যা করা হয়)
জবাই করে দেওয়ার ফলে অনেক লাশের কণ্ঠনালী ছেঁড়া
অনেকের চোখ হাত পা বাঁধা
অনেককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে—
অনেককে হাড়মাংসশুদ্ধ কিমা বানানো হয়েছে প্রথমে
পরে থেঁতলে থেঁতলে পিণ্ডাকার দলা থেকে
তৈরি করা হয়েছে কাতারবদ্ধ সেনাবাহিনী
ওদের মধ্যে অনেককে দেওয়া হয়েছে মেজর জেনারেল পদ
একজনকে নিয়োগ করা হয়েছে
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে
তাদের সবার চেহারাসুরত বরফের মতোই ঠাণ্ডা ও নিষ্পলক
এই হচ্ছে লাশসকলের সুরতহাল রিপোর্ট
তারা সামরিক কায়দায় উঠে দাঁড়ায়
অভিবাদন দেয়
অভিবাদন নেয়
অভিবাদন গ্রহণ করে
এবং সর্বক্ষণ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের
পরবর্তী বিক্ষোভ মিছিলকে
মেশিনগান মেরে উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা আঁটতে থাকে—
তোমরা আতঙ্কিত হলে লাশসকল অট্টহাস্য করে ওঠে
তারা তোমাদের সেনাবাহিনীর মতোই
নিজেদের সেনাবাহিনী গঠন করে নিয়েছে—
কারণ
লাশসকল প্রতিশোধ চায়।
লাশসকল তোমাদের অফিস করিডোরে ফাইলপত্রে
হাজির থাকবে
তারা সংবাদপত্র অফিসে নিখোঁজ সংবাদের রিপোর্টার হয়ে
বসে থাকবে
তারা রেস্তোরাঁয় হোটেলে হোটেলে
মরা মানুষের কঙ্কাল হয়ে ঝুলে থাকবে।
বিকেলে পার্কে সিনেমাহলে ঘরের সামনে
ফুলবাগানে লাশ
লাশসকল অভিনয় জানে
তারা মহিলা সমিতি মঞ্চে অভিনয় করতে চায়
তারা জীবিতদের মতো কথা বলবে
সংলাপ উচ্চারিত হবে নির্ভুল
সর্বত্র
সবখানে
সবজায়গায়
লাশসকল তোমাদের অনুসরণ করবে।
লাশসকল মনে করিয়ে দিতে চায়—
বুট ও খাকির নিচে বাংলাদেশের মৃতদেহ থেকে
পচনের আওয়াজ বেরুচ্ছে
তারা বুঝিয়ে দিতে চায়—
পাছায় রাইফেলের বাঁট মেরে শুয়োরের বাচ্চার মতো
তোমাদের খোঁয়াড়ে রাখা হয়েছে।
রাত্রিবেলা তোমাদের স্ত্রীদের ওপর
তোমাদের মেয়ে মানুষদের ওপর
চড়াও হয়ে
লাশসকল ঝুলিয়ে দেবে
তোমরা
নিবীর্য
নপুংসক
লিঙ্গহীন
উত্থানরহিত।
একদিন
জেনারেলদের মাথার খুলি লক্ষ্য করে
সমস্ত লাশ একযোগে
দ্রিম দ্রিম
ক্রাট ক্রাট
সাব-মেশিনগান
৩৬৫ বার
প্রতিদিন একবার করে বাংলাদেশকে হত্যার প্রতিশোধে
লাশসকল অট্টহাস্য করে উঠবে—
লা শ স ক ল প্র তি শো ধ চা য়
গু ম হ য়ে যা ও য়া লা শ স ক ল
প্র তি শো ধ নে বে।
সুত্র ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।