আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঐক্য ও বাম সংকীর্ণতা -২

বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্বে বিভিন্ন ধরনের সংগ্রামে ঐক্যের বিষয়টি ঘুরে ফিরে আসবেই। বুর্জোয়ার সঙ্গে ঐক্য, বুর্জোয়ার কোন অংশের সঙ্গে ঐক্য, কতটুকু ও কি মাত্রায় ঐক্য, ঐক্য ও সংগ্রামের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন- হায়দার আকবর খান ঐক্য ও বাম সংকীর্ণতা -১ Click This Link দুই. (পূর্ব প্রকাশের পর) আমাদের দেশে, অবিভক্ত ভারতবর্ষে এবং বলা যায় সারা দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনে যত বিচ্যুতি ঘটেছে, সেই ডানই হোক বা বামই হোক, তার একটা বড় অংশ হল বুর্জোয়ার সঙ্গে ঐক্য প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে। বুর্জোয়ার উপর নির্ভরশীলতা, বুর্জোয়ার সঙ্গে সংগ্রামের দিককে বাতিল করে অথবা যতটা দরকার তার চেয়ে কম করে দেখে, বুর্জোয়ার সঙ্গে ঐক্যের নামে বিলোপবাদী, আত্নসমার্পণকারী ইত্যাদি যে প্রবণতা, তা হল দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদ বা ডান বিচ্যুতির একটি দিক। (এইসব সংশোধনবাদ ছাড়াও বিচ্যুতির আরো দিক আছে। যা আমরা এখানে আলোচনা করছি না।

) অন্যদিকে একলা চলো নীতি, বুর্জোয়ার সঙ্গে যতটুকু ঐক্য দরকার সেটাকেও অস্বীকার করা, যারা সম্ভাব্য মিত্র হতে পারে তাদেরকেও শত্রুর কাতারে কাতারে ফেলে দেয়া ইত্যাদি হচ্ছে সংকীর্ণতা, যা বাম সংশোধনবাদ বা বাম বিচ্যুতিরই বৈশিষ্ট্য। (একইভাবে বাম হঠকারিতা, বাম বিচ্যুতি, বাম সংশোধবাদেরও আরও অনেক দিক আছে, যা আমরা এখানে আলোচনা করছি না)। যেটা বলছিলাম তাহলো, কমিউনিস্ট আন্দোলনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছে বুর্জোয়ার সঙ্গে ঐক্যের প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের ডান ও বাম বিচ্যুতি। যদি কোনো কারণে ঐক্যের প্রসঙ্গটি একেবারেই না থাকত, তাহলে সেই কাল্পনিক বিপ্লবের পথ যত কঠিনই হোক না কেন তাতে তাত্ত্বিক জটিলতা নিশ্চয় অনেক কমে যেত। কিন্তু আমরাতো কল্পনার জগতে বাস করি না।

বাস্তব জগতে, সত্যিকারের বিপ্লবে অথবা বিপ্লবের প্রস্তুতি পর্বে বিভিন্ন ধরনের সংগ্রামে ঘুরে ফিরে আসবেই। বুর্জোয়ার সঙ্গে ঐক্য, বুর্জোয়ার কোন কোন অংশের সঙ্গে ঐক্য, কেন ঐক্য, কতটুকু ঐক্য ও কি মাত্রায় ঐক্য, ঐক্য ও সংগ্রামের মধ্যকার দ্বান্দিক সম্পর্ক কেমন হবে ইত্যাদি সকল প্রশ্নই হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক নেতৃত্বের বিষয়। বুর্জোয়ার সঙ্গে ঐক্যের বিষয়টি কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারেও আছে। ইশতেহারটি হচ্ছে প্রলেতারিয়েতর মতার্দশগত দলিল ও মূলত তাত্ত্বিক রচনা। কিন্তু সেখানেও মার্ক্স-এঙ্গেলস ঐক্যের প্রসঙ্গটি এনেছিলেন।

বিষয়টি এমন যে, কোনো ধরনের তাত্ত্বিক বিবেচনায় বা বাস্তব প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও তাকে বাদ দেয়া যায় না। আমরা দেখি যে, কমিউনিস্ট ইশতেহারের মত রচনাতেও মার্ক্স-এঙ্গেলস, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ইউরোপের কয়েকটি দেশে শ্রমিক শ্রেণী কোন বুর্জোয়া দলের সাথে ঐক্য করবে, তাও উল্লেখ করেছেন। কমিউনিস্ট নীতি বোঝার সুবির্ধাথে তাঁরা দৃষ্টান্ত হিসেবে কয়েকটি দেশের কথা উল্লেখ করেছেন- সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, জার্মানী প্রভৃতি দেশে কোন বুর্জোয়ার সঙ্গে কি মাত্রায় ঐক্য হতে পারে, তাও তাঁরা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, জার্মানীতে শ্রমিক শ্রেণী বুর্জোয়ার সঙ্গে একত্রে লড়বে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র, সামন্ত জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু তার ঠিক পরের বাক্যেই ইশতেহার বলছে, '' কিন্তু বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের মধ্যে যে বৈরিভাবাপন্ন বিরোধ বর্তমান তার যথাসম্ভব স্পষ্ট স্বীকৃতিটা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সঞ্চার করার কাজ থেকে তারা মূহুর্তের জন্যও বিরত হয় নয়া...।

" পরাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির গোড়ার যুগে প্রলেতারীয় পথ (Proletarian path) নামে একটি কথা চালু ছিল। তার মানে সোজাসাপটা পথ, সর্বহারার বিপ্লবের পথ, অনেকটা রুশ বিপ্লবের মতোই পথ। রাশিয়া ও ভারতবর্ষ দুই দেশের রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক গুরুতর পার্থক্যকে বিবেচনায় আনার দরকার নেই। ভারতবর্ষ অবশ্য ছিল পরাধীন দেশ, রাশিয়ার মতো নয়। তাতে কি হয়েছে? প্রলেতারিয়েতের পথ একটাই।

এখানে বুর্জোয়াদের সাথে ঐক্যের কোন কিছু নেই। বলাই বাহুল্য এমন চিন্তা ছিল আগাগোড়া ভুল। এমনকি রুশ বিপ্লবেও বহু আগু পিছু ছিল, বুর্জোয়া পেটিবুর্জোয়ার সঙ্গে অনেক আপোস করতে হয়েছিল বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায়ে। আমরা অজ্ঞতাবশ্ত মনে করেছিলাম যে প্রলেতারীয় বিপ্লবের পথ একই সাথে আনবে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্র। তখনও উপনিবেশিকতা সম্পর্কে লেনিনের থিসিস ভারতে এসে পৌছায়নি।

পরে এসেছিল। তাঁরা উপলব্ধি করলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় বুর্জোয়ার সঙ্গে ঐক্য দরকার আছে। যদিও সেই বুর্জোয়া এবং বিশেষ করে তার প্রতিনিধিত্বকারী ব্যাপক গণভিত্তিকসম্পন্ন রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ছিল স্বাধীনতার প্রশ্নেও আপোসকামী ও দোদুল্যমান। বৃটিশ আমলে এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে ও স্বাধীন বাংলাদেশে কমিউনিস্টরা এবং কমিউনিস্টদের বিভিন্ন অংশ যে ঐক্যের নীতিটি ঠিকমতো ধরতে পেরেছিলেন, এমন দাবি করা যাবে না। বরং ঐক্যের নামে লেজুড়বৃত্তি অথবা অতিবিপ্লবীপনা ও সংকীর্ণতায় ভরপুর আমাদের ইতিহাস।

ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। পুরাতন ভুলের স্মৃতি এখনও বিস্মৃত হয়নি। ফলে ডান ভুল থেকে যেন বেশী বামে অথবা বাম বিচ্যুতি থেকে যেন বেশী ডানে ফিরে যাবার আশঙ্কা থাকে। অতএব আমাদের সর্তক হতে হবে। ঐক্যের প্রশ্নে শুধু নিজেদের অতীত অভিজ্ঞতা নয়, বিশ্ব ইতিহাসের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা নেয়া দরকার।

বিশ্ব প্রলেতারিয়েতের মহান বিপ্লবী নেতা ও শিক্ষকদের শিক্ষাও গ্রহন করা উচিত। এই প্রসঙ্গে চীন বিপ্লবের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট শিক্ষণীয় হতে পারে। চীন পুরোপুরি পরাধীন না হলেও আধা উপনিবেশ আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশ ছিল। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তৎকালীন চীনা বুর্জোয়ার দল কুয়োমিনটাং এর সঙ্গে ঐক্য ও সংগ্রামের দ্বান্দিক সম্পর্ক ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল। 'ঐক্য-সংগ্রাম-ঐক্য'- মাওসেতুং-এর এই তত্ত্বটি খুবই প্রাসঙ্গিক।

শুধু সেদিনকার চীন বিপ্লবের ক্ষেত্রেই নয়, আমাদের দেশের বিপ্লবী সংগ্রামের জন্যও প্রযোজ্য। বিপ্লবের পথ যে কখনই যে সরল অথ হয় না, তা ইতিহাসের সকল মহান বিপ্লবের অভিজ্ঞতা এবং মার্ক্স-লেনিন থেকে আরম্ভ করে সর্বহারার সকল নেতা ও শিক্ষকের কাজ ও শিক্ষা থেকে জানা যায়। বিপ্লবের কোন শর্টকাট ফর্মূলা নেই। তেমনি সকল অবস্থায় সকল দেশের জন্য প্রযোজ্য বিপ্লবীদের কোন সার্বজনীন কোনো পথ বা ফর্মূলা নেই। লেনিন একবার বেশ কৌতুকের সঙ্গে বলেছিলেন( Discussion of Self Determination Summed Up রচনা সংকলন,খন্ড-২২, ইংরেজী সংস্করণ, মস্কো, পৃষ্ঠা ৩৫৫-৩৫৬) যে, একদল লোক লাইনে দাঁড়িয়ে বলবে ' আমরা সমাজতন্ত্রের পক্ষে ' এবং আরেকদল লোক অন্য একদিকে দাঁড়িয়ে বলবে, ' আমরা সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে আর সেটাই হবে বিপ্লব!! লেনিন বলেন, ' এমন 'বিশুদ্ধ' বিপ্লব যারা আশা করেন, তারা তা কখনোই দেখিতে পাবেন না।

এমন লোক বিপ্লব সম্পর্কে কিছু না বুঝে কেবল বিপ্লবের জন্য মৌখিক সমর্থনই (Lip-service) দিতে পারবে। ' (ঐ পৃষ্ঠা-৩৫৬) 'নির্দিষ্ট অবস্থায় নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ' (যা লেনিন খুব জোর দিতেন) যেমন দরকার তেমনি দরকার নির্দিষ্ট মুহূর্তে ঐক্যের পরিধি, মাত্রা এবং ঐক্য সংগ্রামের দ্বান্দিক সম্পর্ক নির্ধারণ করা। এক্ষেত্রে ডান ও বাম বিচ্যুতি উভয়ই ক্ষতিকর। সংশোধনবাদ, বিলোপবাদ ইত্যাদি যেমন বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য দারুণভাবে ক্ষতিকর, তেমনি সংকীর্ণতাবাদ, নৈরাজ্যবাদ ইত্যাদি ক্ষতিকর। আমরা আমাদের ইতিহাস থেকে উভয় ক্ষতির অনেক দৃষ্টান্ত দেখতে পাব।

আমরা কি তার থেকে কোনো শিক্ষাই নিবো না? আবার ডান বিচ্যুতি থেকে শিক্ষা নিয়ে অতি বামের দিকে ঝুঁকে পড়া অথবা বিপরীত পক্ষে বাম বিচ্যুতি পরিণাম দেখে অতি সতর্ক হয়ে দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির গহবরে নিমজ্জিত হওয়া-ইতিহাসের এই গোলকধাঁধায় আমরা কি শুধু ঘুরপাক খাবো? আবার আশা যাক, ঐক্য প্রসঙ্গে কমিউনিস্টদের সাধারণভাবে গৃহীত নীতি প্রসঙ্গে। ঐক্য প্রসঙ্গে লেলিনীয় নীতি ব্যাখা করতে গিয়ে স্তালিন প্রাভদায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে (২৮ জুলাই, ১৯২৭ সাল) বলেন,'বাম সোসালিস্ট রেভ্যুলেশনারীর সঙ্গে বলশেভিকদের বিপ্লবী জোট গঠনের নীতি, যে জোট অক্টোবরের সময় এবং অক্টোবরের পরেও ১৯১৮ সালের বসন্তকাল পর্যন্ত ছিল, তা কি সঠিক ছিল না? আমি মনে করি, এই পর্যন্ত কেউই এই জোট গঠনের সঠিকতাকে অস্বীকার করেননি। কিন্তু এই জোটের পরিণতি কি হল? বাম সোসালিস্ট রেভ্যুলেশনারীরা সোভিয়েত ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলো। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা কি বলা যায় যে, বাম সোসালিস্ট রেভ্যুলেশনারীদের সঙ্গে জোট গঠনের নীতিটি ভুল ছিল? এমন কথা কখনই সঠিক নয়। '(Comments on Current Affairs on China) স্তালিন তৎকালীন চীন বিপ্লব প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে রুশ বিপ্লবের ইতিহাসের একটি বিষয় উদাহণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

সে সময়ের কথা হচ্ছে, সেই সময় কুয়োমিনটাং প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে চীনা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, অথচ ইতিপূর্বে সান ইয়েৎ সেনের নেতৃত্বে কুয়োমিনটীং ও কমিউনিস্টদের ঐক্য ছিল, একত্রে তারা দক্ষিণ চীনের সরকার গঠন করেছিলেন। স্তালিন বলেছেন, বিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে কমিউনিস্টদের সঙ্গে কুয়োমিনটাং-এর সরাসরি সশস্ত্র যুদ্ধ সত্ত্বেও এবং কুয়োমিনটাং-এর বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও ইতিপূর্বের ঐক্যের নীতি সঠিকই ছিল। তিনি বলেন, 'চীন বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ে উহান কুয়োমিনটাং-এর সঙ্গে বিপ্লবী জোট গঠন কি সঠিক ছিল? আমার মনে হয় এই পর্যন্ত কেউই বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ে এইরূপ জোট গঠনের সঠিকতাকে অস্বীকার করেননি। ' উপরোক্ত প্রবন্ধে স্তালিন ঐক্য বিষয়ে লেনিনের একটি প্রাসঙ্গিক বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। লেনিন বলেছেন, 'The more powerful enemy can be conquered only by exerting the utmost effort and by necessarily thoroughly, carefully, attentively and skillfully taking a advantage of every, even the smallest, 'right' among the enemies of every antagonism of interest among the bourgeoisie within various countries and among the various groups or types of bourgeoisie within the various countries and also by taking advantage of every, even the smallest opportunity of gaining mass ally, even though this ally be temporary, vacillating, unstable, unreliable and conditional. These who do not understand this do not understand even a particle of Marxism or of scientific, modern socialism in general. Those who have not proved bu deeds over a fairly considerable period of time and in fairly varied political situations, their ability to apply this truth in practice have not yet learned to assist the revolutionary class in its struggle for emancipation of toiling humanity from the exploiters. And this applies equally to the period before and after the conquest of political power by the protectionist. (বাংলা অনুবাদে ভুল হতে পারে অথবা ভুল বা বিকৃতির অভিযোগ উঠতে পারে।

এই আশঙ্কায় অনুবাদের চেষ্টা না করে ইংরেজীতে উদ্ধৃতি রেখে দেয়া হলো) দীর্ঘ চীন বিপ্লবের কয়েকটি পর্যায় আছে। ১৯২৫-২৭ এই সময়কালে কমিউনিস্ট ও জাতীয় বুর্জোয়ার ঐক্য এমন পর্যায়ে ছিল যখন কমিউনিস্টরা সরকারেও ছিলেন। সেনবাহিনীতেও ছিলেন। ১৯২৫ থেকে ১৯৩৭ সাল এই দীর্ঘ দশ বছর কমিউনিস্ট ও কুয়োমিনটাং বুর্জোয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলে এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে প্রথমে দক্ষিণ চীন ও পরে উত্তরে ইয়েনান প্রদেশে মুক্তাঙ্গন ও লাল রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত চিয়ায়ংকাই শেকের নেতৃত্বাধীন কুয়োমিনটাং সরকারের (পিকিং সরকার) সঙ্গে কমিউনিস্ট সরকারের (ইয়েনানে অবস্থিত) যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল জাপানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।

এই পর্যায়ে ঐক্যের চেহারাটা ১৯২৫-১৯২৭ সালের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। কমিউনিস্ট ও বুর্জোয়ারা যে যার নিজ নিজ ভূখন্ড, সরকার ও সেনাবাহিনী পৃথক রেখেছিলেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হুবহু এই রকম যুক্তফ্রন্ট বা বুর্জোয়ার সঙ্গে এই ধরনের ঐক্যের সম্ভাবনা না থাকলেও আর্ন্তজাতিক অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে চীন বিপ্লবের ইতিহাস যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। স্তালিন উপরোক্ত প্রবন্ধে ঐক্য সম্পর্কীয় লেনিনীয় নীতি ব্যাখা করার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন। 'একটি সঠিক নীতি সকল সময়েই এবং আব্যশিকভাবেই যে বিরোধীপক্ষের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক বিজয় এনে দিবে, এমন নাও হতে পারে।

বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধের তাৎক্ষণিক বিজয় নির্ভর করছে শুধুমাত্রই সঠিক কৌশলের (Policy)ওপরই নয়, তা নির্ভর করছে সর্বোপরি ও প্রধানতঃ শ্রেণী শক্তিসমূহের নিশ্চিতভাবেই আধিক্য, শত্রু শিবিরের ছিন্নভিন্ন অবস্থান এবং অনুকূল আর্ন্তজাতিক পরিস্থিতির ওপর। ' তাই সঠিক কৌশল যে তাৎক্ষণিক বিজয়ে এনে দিবে এমনটা মনে করা ভুল। তাৎক্ষণিক ফলাফল না দেখতে পেয়ে কেউ যেন হা হুতাশ না করেন। তাহলে নীতি বা কৌশল যে সঠিক আছে বা ছিল তার প্রমাণ কি? উপরোক্ত একই প্রবন্ধে স্তালিন আবার বলেছেন, যে সঠিক কৌশল বা নীতি সকল অবস্থাতেই একটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করবে। তাহল,....'পার্টির সঠিক নীতি বা কৌশল (Policy) প্রলেতারিয়েতের লড়াই করার ক্ষমতাকে (fighting capacity) বৃদ্ধি করবে, শ্রমজীবি জনগণের সঙ্গে পার্টির যোগাযোগ (link) বহুগুণ বৃদ্ধি করবে...'।

তিন, এবার আশা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। আমরা এখানে সামগ্রিক রণনীতি বা রণকৌশল নিয়ে আলোচনা করছি না। আমরা রণকৌশলের একটা অংশ নিয়েই আলোচনার সূত্রপাত করেছি মাত্র। সেই সম্পর্কে শুধু একটি ছোট্ট মন্তব্য করেই এই সংক্ষিপ্ত রচনার সমাপ্তি টানা হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নটি যে নানা দিকে থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ্ম তা আমরা মনে করি।

এই বিচার নিশ্চিত করতে আমরা সবরকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো। সেই প্রচেষ্টার অংশ ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিপিবি'র আলোচনা এবং ২৯ ডিসেম্বরের যুগপৎ কর্মসূচি। ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে থেকে মিছিল ও সমাবেশ। যদি আমরা তা না করে একত্রে মিছিল বা সমাবেশ করতাম তবে আমাদের বিবেচনায় তা হতো ভুল। দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতিও বলতে পারেন।

আমরা যদি এই এক ইস্যুতে সামরিক সমঝোতার কারণে অন্য সকল প্রশ্নে সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে সামান্যতম সরে যেতাম তাহলে নিশ্চিয়ই তা হত বড় ধরনের বিচ্যুতি। কিন্তু না। তেমন সর্বনাশা পথে কমিউনিস্ট পার্টি যায়নি। বরং সকল প্রশ্নে, কি রাজনৈতিক, কি অর্থনৈতিক, কি বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত সকল প্রশ্নে সিপিবি কেবল সরকার বিরোধী আন্দোলনে রয়েছে তাই-ই নয়, বলা যায়, এই সকল আন্দোলনের ব্যাপারে অন্যান্য যে কোন দলের চেয়ে একটু এগিয়েই রয়েছে। পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণী সংগ্রামকে শক্তিশালী করে তোলা।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট সংগ্রামে সবচেয়ে বেশী, সংগ্রামী ভূমিকা রেখেছে সিপিবি এবং সবচেয়ে বেশী নিপিড়নেরও শিকার হয়েছে। তবু বলবো, সিপিবি'র একক সংগ্রাম অথবা অন্য কোনো বাম দল বা জোটের একক সংগ্রাম প্রয়োজনের তুলনায় মোটেও যথেষ্ট নয়। এটা দুঃখজনক যে, বৃহত্তর বামঐক্যের সম্ভাবনা আপাতত হোঁচট খেয়েছে। আমি আবারও বলবো যে, এর জন্য কে দায়ী সেই মিমাংসা আপাততঃ হবে না। কেউ বলবেন, সিপিবি'র ভুল ভূমিকাই এর জন্য দায়ী।

সিপিবি বলবে, বাম ঐক্যের উদ্যোগকে এইভাবে ভেঙ্গে দেয়াটাই ছিল ভুল। যাই হোক কোন এক পক্ষ ভুল করেছে অথবা নিছকই ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। যেভাবেই হোক, যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে, তা কেটে যাবে বলে আমি আশা করতে পারি। কারণ বৃহত্তর বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য একান্তভাবে দরকার। নীতিনিষ্ঠ থেকে, অথচ কৌশলে নমনীয় হতে ধৈর্য ধরে বাম ঐক্যের জন্যও সিপিবিকে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।

এটাও রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত সংগ্রামের একটা অংশ। এই সংগ্রামে আমাদের জয় ছিনিয়ে আনতে হবে। বিঃদ্রঃ ' সাপ্তাহিক একতা '। । সংখ্যা ২২।

। ১৫ জানুয়ারী ২০১২ থেকে সংগৃহীত ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।