বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ার যে প্রচেষ্টা বেশ অনেক আগের থেকেই শুরু হয়েছিল, তা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। সিপিবি ও বাম মোর্চার আলোচনা ও যৌথ কর্মসূচি ভেঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক এবং সামগ্রিক বাম রাজনীতির জন্য ক্ষতিকারক।
সম্প্রতি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর বাস ভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক আলোচনায় বসেছিলেন। সেই আলোচনার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ ও তার জোট মহাজোটের সঙ্গীরা এবং অপরদিকে সিপিবি যুগপৎভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে কয়েকটি কর্মসূচি গ্রহন করেছে। তার মধ্যে একটি ছিল গত ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে মিছিল করা।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মিছিলটি শেষ হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনের নিকটে। সিপিবির কয়েকটি মিছিল একত্রিত হয়ে শেষ হয়েছিল শহীন মিনারে গিয়ে। একই প্রশ্নে হলেও সিপিবি ও আওয়ামী লীগ এক হয়নি। কারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মিল থাকলেও, অন্যান্য সকল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রশ্নে পার্থক্য রয়েছে বিস্তর। শুধু তাই নয়, দু'দল দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা এবং সেটাই স্বাভাবিক।
আওয়ামী লীগ হল লুটেরা ধনীক শ্রেনীর প্রতিনিধি এবং সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্নসর্মাপণকারী দল। তার সঙ্গে একত্রে মিলে জোট গঠন ( যা কোন কোন বাম দল করেছে ) তা কখনই শ্রমিক শ্রেনীর বিপ্লবী পার্টি বলে দাবিদার কোন দলের পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও আওয়ামী লীগের সাথে সিপিবির পার্থক্য রয়েছে। সিপিবি মনে করে যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে, কিন্তু বড় ঢিলাঢালা। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
যুদ্ধাপরাধীদের তদন্তকারী সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, দেখা গেলে সেই ব্যক্তি ছিলেন জামাত ও ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মী। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একেবারে শত্রু শিবিরের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের লোকদের কিভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তা ভাবতেও অবাক লাগে। একি কেবল অমনযোগীতা? যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে সেটা গুরুতর অপরাধ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মত জায়গায় এমন অমনোযোগীতা, তদন্ত সংস্থার প্রধান রূপে একেবারে যুদ্ধাপরাধীদের শিবিরের (অন্ততঃ মতাদর্শগতভাবে একই শিবিরের) লোককে নিয়োগ দেয়া এটাকে ছেলে খেলা বলে উড়িয়ে দেয়া সঠিক হবে না। আর এত বড় ইস্যু নিয়ে ছেলে খেলাই বা হবে কেন?
একথা সত্য যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে সরকারের মধ্যেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, অমনযোগিতা ও আপোস করার প্রবণতা রয়েছে।
বিএনপি জামাতকে নিয়ে একসঙ্গে নির্বাচন ও সরকার গঠন করেছে। আওয়ামী লীগ অবশ্য এতদূর যায়নি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে তারাও জামাতকে সঙ্গে নিয়ে একত্রে বসে যৌথ আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহন করেছিল। ২০০৬ সালে আরেকটি কট্টর মৌলবাদী গ্রুপের সঙ্গে (মতার্দশভাবে তারাও যুদ্ধাপরাধীদের একই শিবিরের অন্তর্ভূক্ত) চরম প্রতিক্রিয়াশীল পাঁচ দফা চুক্তি করেছিলো। আওয়ামী লীগের মতো দলের কাছে ক্ষমতা এবং নির্বাচনে জয় লাভটাই গুরুত্বপূর্ণ।
আর্দশের কোন বালাই নেই। সেই জন্য অপশক্তির সঙ্গে সমঝোতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে যে কোন মুহুর্তে সরে যাওয়া, জামাতের কোন অংশের সঙ্গে আপোস করা অথবা মার্কিন সাম্র্যাজ্যবাদ ও মধ্য প্রাচ্যের কোনো প্রতিক্রিয়াশীল রাস্ট্রের চাপের কাছে নতি স্বীকার করা অসম্ভব নয়। অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নানা অজুহাত তুলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিঘ্ন ঘটাতে তৎপর রয়েছে; এমনকি সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছে।
সরকার ও সরকারি দলের দোদুল্যমানতা এবং প্রধান বিরোধী দলের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান গ্রহন বেশ জটিল অবস্থা তৈরি করেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার ভেস্তে যেতে পারে অথবা হাল্কা হয়ে যেতে পারে, এমন আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
অথচ যুদ্ধাপরাধের বিচার হওয়া এবং যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হওয়া জাতির জন্য অতীব প্রয়োজন। এইজন্য প্রবল জনমত সৃস্টি করা প্রয়োজন এবং সরকারকেও অধিকতর কমিটমেন্ট এর জায়গায় আটকে ফেলা দরকার। এই মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরি জাতীয় কর্তব্যের মধ্যে এটা পড়ে। সেইদিক থেকে বিচার করলে সিপিবি নেতৃত্ব যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তা আমার বিবেচনায় যথাযথ ছিল।
তবু এই বিষয়টি নিএ বাম মহলে বেশ শোরগোল শুরু হয়েছে।
এমনকি কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও কিছু ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া, সামান্য হলেও দেখা গেছে। সিঁদুরে মেঘ দেখলে গরু যেমন ভয় পায়, তেমনি অহেতুক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। পার্টি কর্মীদের কারোর মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, পার্টি নেতৃত্ব কি স্বাধীনভাবে দাঁড়ানোর প্রত্যয় থেকে সরে গিয়ে বুর্জোয়ার ওপর নির্ভরশীলতার পুরাতন ভ্রান্ত লাইনে চলে গেল? বিশেষ করে আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে আগেকার সেই ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি কি আবার ফিরে এলো?
বস্তুতঃ এই রকম আশঙ্কার কোন ভিত্তি নেই। কারণ পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম পরিষ্কার করে বলেছেন, 'আমরা ১৪ দলের আগেও ছিলাম না, এখনও নাই, ভবিষ্যতে যাবো না। আমরা বিরোধী দলে আছি ও থাকবো।
' তবে পার্টি এই একটি ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সাথে যুগপৎ ধারায় কয়েকটি কর্মসূচি গ্রহন করেছে।
একত্রে কোন সভা, সমাবেশ, মিছিল বা কোন যৌথ বিবৃতিও নয়। একই তারিখে যুগপৎভাবে অর্থাৎ আলাদা আলাদাভাবে একই দাবি বা ইস্যুতে মিছিল বা সমাবেশ করার যে ধারা ইতিপূর্বে তৈরি হয়েছিল, সেটাই এক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। একত্রে নয় বরং যুগপৎ ধারায় কর্মসূচি গ্রহনের দিকটি কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আমাদের বাম মহলের বন্ধুরা সেটা বোঝার চেষ্টা করেনি।
উক্ত ঘটনা বাম মহলে এমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে যে, তারা ইতিপূর্বে তৈরি হওয়া সিপিবি বামমোর্চার মধ্যকার সমঝোতা ও ঐক্য এবং ইতিপূর্বে যৌথভাবে ঘোষিত কতিপয় কর্মসূচি থেকে এক তরফাভাবেই ঘোষণা দিয়ে সরে এসেছেন। অর্থাৎ বৃহত্তর বাম ঐক্য গড়ার যে প্রচেষ্টা বেশ অনেক আগের থেকে শুরু হয়েছিল, তা হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো। সিপিবি ও বাম মোর্চার আলোচনা ও যৌথ কর্মসূচি ভেঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক এবং সামগ্রিক বাম গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য ক্ষতিকারক। এর জন্য কে দায়ী সেই প্রশ্নে আমি আপাততঃ এই নিবন্ধে কোন আলোচনা বা বির্তক উপস্থাপন করছি না। কারণ তাতে যতটুকু তিক্ততা তৈরি হয়েছে, তা বাড়বে বৈ কমবে না।
সুস্থ যুক্তির ভিত্তিতে বিবেচনা করার জন বোধ হয় আরও একটু সময় দেয়া বা নেয়া দরকার।
সুনির্দিষ্ট ঘটনা কেন্দ্রীক আলোচনা ও বিশ্লেষণের আগে আমি পাঠক ও পার্টি কর্মীদের জন্য বুর্জোয়ার সঙ্গে ঐক্য প্রসঙ্গে কমিউনিস্টদের সাধারণ নীতিমালার বিষয়গুলি সংক্ষেপে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। এই নিবন্ধের বাকি অংশ সেই আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে।
------------ হায়দার আকবর খান রনো
বিঃদ্রঃ ' সাপ্তাহিক একতা ' সংখ্যা ২১। ।
৮ জানুয়ারী ২০১২ থেকে সংগৃহীত
ঐক্য ও বাম সংকীর্ণতা -২
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।