ভাবতে ভাবতেই একসময় হারিয়ে যেতে চায় ভাবনার জগতে ১.
ধোঁয়া উড়া এক কাপ গরম চা আর হাতে একটি ইংরেজী পত্রিকা থাকলে নিজেকে বড় স্মার্ট মনে হয় জাভেদের। বাড়ি যাচ্ছে জাভেদ। এইমাত্র ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। বাংলাদেশে রেলের টাইমটেবল যে আর কবে ঠিক হবে! প্রায় চল্লিশ মিনিট দেরি। ট্রেনের জানালা দিয়ে সকালের সোনালী রোদ এসে পড়ছে জাভেদের পাশে বসা তরুণীটির গালে।
তরুণীর গালের উপর সোনালী রোদের আলো যেন মানবের গাঁয়ে আঁকা প্রকৃতির এক সুনিপুণ স্কেচ। জাভেদ ভাবল কিছুক্ষণ আগে কি এই মেয়েটিকেই বলেছিল- “এক্সকিউজমি, আপু আপনার ব্যগটা একটু সরাবেন ?”
স্বভাবে লাজুক প্রকৃতির জাভেদ ঢাকায় এক মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে মোটা অংকের বেতনের চাকরি করে। বাবা-মা গ্রামে থাকে, মাঝে মাঝেই মনটা ছটফট করে মাকে একনজর দেখবে বলে। তাই ছুটে চলা বাড়ির পথে। মেয়েটির থেকে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয় সে।
জাভেদ কেমন যেন অস্বস্তিবোধ করতে থাকে। এমনিতেই মেয়েদের সামনে নার্ভাস তারপর আবার কোন মেয়ের সাথে পাশাপাশি ভ্রমণ, এটাই প্রথম। অস্বস্তিবোধ কাটানোর জন্য পত্রিকার দিকে নজর দেয়।
আজকাল পত্রিকাগুলোতেও কোন খবর খুঁজে পাওয়া যায় না। সবসময়ই একইরকম খবর ছাপতে ছাপতে এখন এমন অবস্থা হয়ে গেছে আগামী এক সপ্তাহ পর পত্রিকায় কি খবর ছাপা হবে এটা যেন আগে থেকেই বলে দেয়া যায়।
খেলার পাতায়ও কোন খবর নাই। খেলার পাতার শিরোনাম “ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কে ২-০ গোলে হারালো বার্সেলোনা। ফুটবলের খবর পড়তে ভাল লাগে না জাভেদের। ফুটবলের খবর পড়লেই কেন যেন নিজের দেশের ফুটবলের উপর খুব করুনা হয় তার। পত্রিকা রেখে দিল।
আবার অস্বস্তি লাগছে। আড়চোখে আরেকবার তাকায় মেয়েটির দিকে।
নাহ, অসম্ভব সুন্দর একটা মেয়ে। এরকম একটা মেয়েকে পাশে বসিয়ে কথা না বলে কি থাকা যায়!! মনে মনে ভাবে জাভেদ। কিন্তু কি দিয়ে কথা শুরু করা যায়।
পরক্ষণেই আবার মনে হয় তার, “ধ্যাৎ কি কথা বলব, কলেজ-ইউনিভার্সিটি লাইফে কত সুন্দরী দেখলাম কারও সাথে সখ্যতা গড়তে পারলাম না আর ১০-১২ ঘন্টার যাত্রা পথ কিইবা আর হবে”। নিজেকে নিজে বলতে থাকে “ঝেড়ে ফেলো, ঝেড়ে ফেলো এসব চিন্তা মাথা থেকে”। বরং এই মেয়েটি পাশে বসে যাত্রার আনন্দটাই নষ্ট করে দিচ্ছে। না পারছে একটু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে, না পারছে ঘুমোতে। জানালার দিকে তাকালে যদি আবার বলে বসে, “এমন ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন??” আর ঘুমানো, সেও সম্ভব না।
পাশে মেয়ে মানুষ থাকলে ঘুমানো কষ্টকর হয়ে পরে। মেয়েরা নাকি আবার ছেলেদের ঘুমের খুঁত ধরতে খুব ওস্তাদ।
২.
হঠাৎ গালে কোন কিছুর স্পর্শ টের পেল জাভেদ। আলতো করে ছুঁয়ে যাওয়া এলোমেলো কিছু চুলের স্পর্শ। অনেকক্ষণ ছুঁয়ে দিতে থাকলো।
বেলীফুলের গন্ধ। হয়তোবা বেলীফুলের নির্যাসযুক্ত কোন তেল মাথায় দিয়েছে মেয়েটি। হঠাৎ ট্রেনের গতি কমে গেল। স্পর্শ বন্ধ হয়ে গেল। জাভেদ মনে মনে ভাবল, ট্রেনের চালককে গিয়ে “অসংখ্য ধন্যবাদ” টাইপের কিছু একটা জানিয়ে আসি এমন একটা মুহূর্ত তৈরী করে দেওয়ার জন্য।
স্টেশনের পত্রিকা ওয়ালারা হাঁক ছাড়ছে-
এই পেপার, ম্যাগাজিন, বই, বাচ্চাদের বই
এই পেপার, এই
মামা, কিছু লাগব?
আনন্দআলো আছে?
হ মামা।
একটা দাও।
পত্রিকা ওয়ালাকে জানালা দিয়ে টাকা দিতে গিয়ে মেয়েটির দিকে আরেকবার ভাল করে তাকায় জাভেদ। ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে জাভেদ মনে মনে ভাবে, পেশা জিনিসটা মানুষের নামও পাল্টে ফেলতে দিধাবোধ করে না। এই পেপার ওয়ালার কি কোন নাম নেই?? কিন্তু সবাই ডাকে পেপার বলে, মনে হয় তার নামই যেন পেপার।
জাভেদকেও তার অফিসের কিছু কর্মচারী ‘স্যার’ নামেই চিনে, তার নাম যে জাভেদ এটা কেউ কেউ জানেই না। জাভেদের খোঁজে কেউ যদি অফিসের পিয়নদেরকে জিজ্ঞাসা করে, “জাভেদের রুমটা কোন দিকে?” পিয়নরা এমনভাবে তাকায় যেন মনে হয় জাভেদ কি কোন মানুষের নাম হয়?? যখন বলে ফর্সা করে লম্বা ছেলেটা তখন চিনতে পারে আর বলে,
“ওহ, স্যারের রুম??
ঐ যে ঐটা!”
জাভেদেরও এই স্যার শব্দটা মোটেও ভাল লাগে না। নিজেকে কেমন যেন মুরুব্বি মনে হয়। কিন্তু অফিসের ফর্মালিটি পালন করতেই হয়।
আনন্দআলোতে এক সেলিব্রেটির সক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
তাকে জিজ্ঞেস করেছে “অমুকের সাথে আপনার একধরনের ঘনিষ্ঠতার কথা শোনা যাচ্ছে, কথাটাকি সত্যি?” সেলিব্রেটির উত্তর, “না, তেমন কিছু না, সে আর আমি খুব ভাল বন্ধু”। আজকাল সেলিব্রেটিরাও শুরুতে সবাই সবার ভাল বন্ধু থাকে। পরে এই বন্ধুরাই তাদের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে।
প্রায় দুই ঘন্টার যাত্রা শেষ, পাশের তরুণীটির সাথে কোন কথা হয়নি, শুধু শুরুতে ব্যাগ সরাতে বলা ছাড়া। জাভেদ মনে মনে ভাবে, এটা কি ঠিক করছি! তার কি দোষ, মেয়েটাও তো তার সাথে কোন কথা বলেনি।
কিন্তু বন্ধু মহলে যদি এই কথাটা বলে তাহলে উত্তর আসবে-
“আরে ব্যাটা ঐ তো মায়্যা, ব্যাটা মায়্যা
মায়্যা মানুষকি তোর লগে আগে কথা কইব
তুই তো পুরাই আবাইল্যা”।
ইউনিভার্সিটি লাইফে মেয়েদের সামনে এই আনইজি ফিলের ব্যাপারটা মাঝে মাঝে বন্ধু মহলে তাকে ভাবারু হিসেবে পরিচয় করাত। বন্ধুমহলে জাভেদ আবার খুব চটপটে একটা ছেলে। তাকে ছাড়া যেন আড্ডায় জমে না।
আনন্দআলোতে একটা কবিতার দিকে নজর পড়ল তার, কবিতার নাম “নারী তুমি”।
একটু লুল মার্কা কবিতা। আজকাল ব্লগে লুল শব্দটা অনেক বেশি শোনা যায়। নারী নিয়ে কোন পোস্ট থাকলেই তার নিচে মন্ত্যব্য থাকবে লুলামী পোস্ট, লুল-লুল ইত্যাদি। এদের এই মানসিকতা দেখলে মাঝে মাঝে মনে হয় রবীন্দ্রনাথও কি লুলমার্কা কবি ছিলেন নাকি??
৩.
ইতোমধ্যে তিন ঘন্টার যাত্রা শেষ। আরও একটি স্টেশন।
কোনও কথা হল না এখনও। অনেকক্ষণ হয়ত সিগারেট খাওয়া হচ্ছে না জাভেদের। ট্রেন থেকে নেমে সিগারেট কিনল জাভেদ। এক প্যাকেট বেনসন। পকেটে ছিল এক প্যাকেট।
আসার সময় কমলাপুরে এক ঝাড়ুদার এসে জাভেদকে বেনসন বের করতে দেখে আব্দার করে বসল-
“স্যার একটা বেনসন দিবেন ? বিড়িডা ভালাপায় কিন্তু খাইবার সামুর্থ্য নাই”।
জাভেদ তাকে পুরো প্যাকেটটিই দিয়ে দিল। আর বলল, “এটা বিড়ি না, সিগারেট”।
লোকটার মুখে চমৎকার হাঁসি ফুটে উঠল আর “বেনসন সিগারেট, বেনসন সিগারেট” বলতে বলতে চলে গেল। জাভেদ ভাবে এই পৃথিবীতে কতই না সহজ সরল মানুষ আছে যাদেরকে এক প্যাকেট সিগারেট দিয়েই অনেক খুশি করা যায়।
ইউনিভার্সিটি লাইফে গোল্ড-লিফ খেত জাভেদ। পয়সার অভাব ছিল, টিউশনি করে চলতে হত। মাঝে মাঝে এক-আধটা বেনসন যদি কেউ সাধত তাহলে খাওয়া হত। এখন আর বেনসন ছাড়া খাওয়া হয় না।
একটি সিগারেট ধরাতে গিয়ে জাভেদ টের পেল তার হাতটা অনেক কাঁপছে।
ট্রেনের জানালা থেকে দুটো মায়াবিনী চোখ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে আর বলছে -
“এই হাত থেকে সিগারেট ফেল”।
কেমন যেন একটা আদেশ আদেশ ভাব।
মেয়েটার আপাদমস্তক পুরোটাই বাঙ্গালী নারীর অবয়ব। পরনে শাড়ি, হাতে চুড়ি, কপালে টিপ। জাভেদ ছাড়া অন্য কোন ছেলে পাশে বসলে এই মেয়েকে এতক্ষণে অফার-টফার দিয়ে ফেলত।
বলা যায় না, ট্রেন থেকে নেমে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েও করে ফেলতে পারত। তারপর ছেলের বাসাই মেয়েকে নিয়ে গিয়ে সবার সামনে বলত “সারপ্রাইজ, একদম বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে আসলাম”। কিছুদিন মেয়ের বাসা থেকে ছেলের বাসার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করত তারপর সব ঠিক হয়ে যেত। ঊফ, কতই না সহজ, তাহলে সে পারছে না কেন? মনে মনে ভাবে জাভেদ।
এতক্ষণ ধরে মেয়েটা তাকিয়ে তাকিয়ে তার দিকে কি দেখে।
সিগারেটটা ফেলে দিব নাকি? মনে মনে ভাবে সে। অবশ্য সিগারেট খাওয়ার সময় কোন মেয়ে তাকিয়ে থাকলে সিগারেট খাওয়ার মুডটাও অনেক বেড়ে যায় । নাহ, চোখ সরিয়ে নিয়েছে মেয়েটি। মনে মনে বোধহয় ভাবছে “কি ইতর ছেলেরে বাবা, এতক্ষণ একটা মেয়ে তাকিয়ে আছে আর তার সামনে ধপ ধপ করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে”। মেয়েরা এগুলো ভাবতে খুব এক্সপার্ট।
ট্রেন এই স্টেশন ছাড়তে বেশি দেরি নেই। ট্রেনে উঠে পড়ল জাভেদ।
সিটে বসতে যাবে এমন সময় সামনের সিটের একটি ছেলে মেয়েটিকে বলছে -
“তিথি, সামনে চলে আস আমার পাশের জনকে ওখানে পাঠাচ্ছি”।
“না-না, আমার এখানে কোন সমস্যা হচ্ছে না”।
ছেলেটি এবার জাভেদকে বলল,
“ভাইয়া আপনি কি একটু সিটটা চেঞ্জ করবেন?”
এমনিতেই নরম টাইপের ছেলে হলেও এইসব ইভ-টিজিং মার্কা ব্যাপারগুলো একদমই সহ্য করতে পারে না জাভেদ।
জাভেদ বলল-
“এক থাপ্পড় দিয়া চাপাড় সব দাঁত ফালাইয়া দিমু, সামনে তাকা ব্যাটা”
এই প্রথম জাভেদ নিজের অজান্তেই মেয়েটিকে প্রশ্ন করল-
“আপনি কি কোন প্রবলেম ফিল করছেন ?”
“না ভাইয়া, আসলে ওরা আমার সেল নাম্বার চাচ্ছিল”
“ও আচ্ছা, আরেকবার চাইলে আমার নাম্বারটা দিয়ে বলবেন এটা আপনার নাম্বার, নাম্বারটা নিন ০১.........”
ছেলেটি আবার নাম্বার চাইল, তিথি কাজটা ঠিকমত করল। এইবার ছেলেগুলো নাম্বার সঠিক কিনা যাচাই করার জন্য কল দিল।
“হ্যালো, তিথি”
“তোর বাপরে ফোন দিছস”(জাভেদের উত্তর)
যাক বখাটেগুলোর অত্যাচার থামল।
৪.
হঠাৎ করে জাভেদের মুখে যেন কথার ফুলঝুড়ি ফুটে উঠল-
“কোথায় যাবেন আপনি?”
“লালমনিরহাট”
“আমিও তো ওখানেই যাচ্ছি, ঢাকায় কি করেন?”
“একটা প্রাইভেট ফার্মে আছি। আচ্ছা ভাইয়া এতক্ষণ হয়ত আসছি আপনার নামটাই তো শোনা হল না”
“আমি জাভেদ, আপনি তিথি।
আপনার নাম জিজ্ঞেস করলাম না”।
তিথি হাসল। জাভেদ বুঝলনা। সে কি হাসির কিছু বলেছে ?! জানি না, মেয়েরা যে কেন হাসে কেন কাঁদে তা বুঝা খুব কষ্টকর। জাভেদের মনে হয়, মাঝে মাঝে তারা নিজেও জানে না যে তারা কেনইবা হাসে আর কেনইবা কাঁদে।
স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মনে হয় নিজ হাতে তাদের মুখ দুইটা ফাঁক করে দিয়ে হাসায় আবার নিজ হাতেই মুখটা ভোজকা করে দিয়ে কাঁদায়। তবে তিথির হাসিটা অনেক সুন্দর। না হাসলে মনে হয় ওর সৌন্দর্যের এই রূপটা দেখা হত না জাভেদের।
প্রায় সন্ধ্যা হতে চলল, তিথির চুলের বেলীফুলের গন্ধটা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। জাভেদের কাছে মনে হচ্ছে এ সুবাসটা যেন শুধু ওর চুলেই মানায়।
বেলীফুলের সৌরভ, কিছু কথা আর কিছু হাসির মাঝে পথ চলতে চলতে এক সময় গন্ত্যব্যের কাছাকাছি চলে আসে ট্রেন, প্রায় তিন ঘন্টা লেট। অন্য কোন সময় হলে জাভেদ বাংলাদেশ রেলওয়ের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করত মনে মনে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সময়টা আরেকটু বেশি নিলে মন্দ হত না। এর মধ্যে অনেক কথা হয়ে গেছে তাদের ভিতর, এককাপ চাও শেয়ার করা হয়ে গেছে। চায়ের বিলটা জোর করেই তিথি দিয়েছে।
গন্ত্যব্যে নেমে জাভেদ তিথিকে রিকশা ঠিক করে দিল। তারপর দুজন দুজনার পথে রওনা দিল।
রাত নয়টা, গ্রামের এলাকায় এটাই অনেক রাত। নিস্তব্ধ রাত। রিকশাতেই জাভেদের নিজেকে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
একটা সিগারেট ধরাল জাভেদ। বাংলাদেশের গ্রামগুলো একটা দিক দিয়ে আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোর মত মনে হয় তার। ওখানেও যেমন গভীর রাতে ছিনতাইয়ের ভয় নেই, এই গ্রামগুলোতেও এই ভয়টি নেই।
ঢাকায় পাজেরোতে ঘুরতে ঘুরতে কেমন যেন একটা বিরক্তি চলে এসেছে জাভেদের। অনেকদিন পর রিকশায় চরতে তাই ভালই লাগছে তার।
রিকশা চলার স্টাইলটা কেমন যেন একটু আলাদা। কেমন যেন একটা স্মুথ চলন। রোমান্টিক চলনও বলা চলে। তাই বোধহয় প্রেমিক-প্রেমিকাদের রিকশা খুব পছন্দের বাহন। রিকশা চালকরাও কেমন যেন একটা শিল্প নিয়ে রিকশা চালায়।
হেলে-দুলে।
আকাশে পরিস্কার একটি রূপালী চাঁদ। সচরাচর এই চাঁদ দেখা যায় না। এই মুহূর্ত গুলোতে সিগারেট খেতে ভালই লাগে। জাভেদ ভাবছে, পাশে তিথি থাকলে মন্দ হত না।
হঠাৎ এমন ভাবনা আসছে কেন তার মনে? মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেল না তো!! মনে মনে ভাবে জাভেদ, ধ্যাৎ এতক্ষণ কথা বললাম অথচ তার সেল নাম্বারটা নেওয়া হল না। নিলে হয়তোবা এতটুকু পথ কথা বলতে বলতে যাওয়া যেত। রাস্তার দু-ধারে ঝিঝি পোকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই ঝিঝি পোকার শব্দটা শহরে একদমই পাওয়া যায় না। যেইসব বাচ্চারা কখনো গ্রামে আসেনি তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে “কখনো ঝিঝি পোকার ডাক শুনেছ?” তারা নিশ্চয়ই হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে আর ভাববে ঝিঝি নামে আবার কোন পোকা হয় না কি!!
বাসার সামনে চলে আসল জাভেদ।
বারান্দায় এখনো মা দাঁড়িয়ে আছে। একেই বোধহয় বলে মা। নিজের বউ কি কখনো এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে স্বামীর অপেক্ষায়? জাভেদের মনে প্রশ্ন জাগে। তিথি কি তার জন্য এভাবে অপেক্ষা করবে? কি ভাবছে এসব সে!?
প্রত্যেকবারই বাড়িতে পৌঁছার পর অনেক ক্ষুধা লাগে তার। ইচ্ছা করে, ফ্রেশ না হয়েই খেতে বসতে।
কিন্তু মায়ের জোরাজুরিতে ফ্রেশ হয়েই খেতে হয়। পয়সাওয়ালাদের এই হল একটা সুবিধা, প্রচুর ক্ষুধাতেও এদের টেনশন কম থাকে। কারণ তারা জানে, পয়সা থাকলে খাবার আসবে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এই ক্ষুধা নিয়ে, খাবারের সন্ধান করে অবশেষে খাবার না পেয়ে ঘুমিয়ে পরা লোকের সংখ্যা পৃথিবীতে যে কত তা মনে হয় স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই জানেন। খেতে খেতে এসব চিন্তা করতে থাকে জাভেদ।
মায়ের হাতের রান্নার তৃপ্তিই অন্যরকম। ঢাকায় তিনবেলায় হোটেলে খেতে হয়। আর জাভেদের আরেকটা স্বভাব হচ্ছে কখনোই বাড়ি আসার সময় রাস্তার উল্টাপাল্টা খাবার খেয়ে পেটটাকে জ্যাম করে রাখে না, যেন মায়ের হাতের খাবার তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া যায়। চলতি পথে তার খাবার বলতে কয়েকটি সিগারেট আর কয়েক কাপ চা।
শেষ
নিস্তব্ধ রাত, ঘুম পাচ্ছে না।
খাওয়া শেষ করে বাড়ির ছাদে গেল জাভেদ। কেন যেন মনে হচ্ছে তার বিশাল এক শূন্যতার রাত কেটে যাচ্ছে আজ। তিথিকে কি সে সত্যিই ভালবেসে ফেলেছে!? নাহ, কথাটা জানাতে হবে তিথিকে, মনে মনে ঠিক করে জাভেদ। কিন্তু কিভাবে, ওর সেল নাম্বার, ঠিকানা কিছুই নেই তার কাছে। চরম এক অস্থিরতা কাজ করছে তার ভিতর।
কাল সকালে বন্ধু মহলে কথাটা জানালে হয়তোবা কিছুটা সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। আরেকটা সিগারেট ধরায় জাভেদ। আকাশের চাঁদ আর সিগারেটের মধ্যে মনে হয় খুব ভাল একটা সম্পর্ক আছে। আকাশে পরিস্কার চাঁদ, আর একটা সিগারেট আর তার ধোঁয়া, যেন একে অপরের সেতুবন্ধন।
পরদিন সকালে জাভেদ তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু নাফিসের সাথে ঘটনাটি শেয়ার করে।
নাফিস বলে-
“আরে ব্যাটা এইডা চিন্তার কি অইল, অর নাম্বার তো আমার কাছেই আছে। আমরা একলগে কলেজে পড়তাম না! ঐ সময় অবশ্য আমি একটু পল্টি মারার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পাত্তা দেয় নাই। এইডা টেনশনের কিছু নাই, চা খা, নাম্বার দিতাছি তরে”।
জাভেদ চা খেতে খেতে বলে-
“আমিও একটু পল্টি মারার চেষ্টা করি দেখি পাত্তা-টাত্তা পাই কি না। আর ভাবিরে তর এই পল্টি মারার খবরটা দিতাছি।
”
একচোট হাসি হয়ে যায় তাদের ভিতর।
বাসায় ফিরে ছটফট করতে থাকে জাভেদ। কখন জানাবে। জানাবে নাকি জানাবেনা। নাহ, আজকে জানাতেই হবে।
কিভাবে বলবে সরাসরি নাকি একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। ভাবতে ভাবতে বেলা বয়ে যায়। গোধুলীর বেলায় জাভেদ ফোন দেয়। ও-পাশ থেকে একটা ভারি পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসে। বলে-
হ্যালো, জাভেদ
জ্বি, আপনি কে?
আমি তিথির বড় ভাই, নাম্বারটা সেভ করা ছিল।
ও আচ্ছা, তিথিকে দেওয়া যাবে?
ওপাশের কন্ঠস্বর যেন আরও ভারি হয়। কেমন যেন একটা বেদনা বেদনা কন্ঠস্বর –
“তিথি তো নেই, গতকাল রাতে স্টেশন থেকে ফেরার পথে বিপরীত দিক থেকে একটি ট্রাক...............................................................”
জাভেদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ওর ভাই আবার বলতে শুরু করে –
“ওর হাতের মুঠোয় ওর সেলফোনটা ধরা ছিল যাতে লেখা ছিল- জাভেদ অনেক ভালবাসি তোমায়”
ওপাশের কন্ঠ আরও ভারি হতে থাকে। জাভেদ লাইনটি কেটে দেয়।
গোধূলীর আলোয় ভারি হয়ে আসছে প্রকৃতি।
নিমজ্জিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে চোখের কোণের কয়েক ফোটা জলকে সঙ্গী করে জাভেদ মনে মনে আওরাতে থাকে –
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।