আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেয়ারবাজার নিয়ে একটি অতি সরলীকৃত গল্প

রহিম ১০ টাকা মুলধন নিয়ে বাদাম বিক্রির ব্যবসা শুরু করল। ব্যবসায় কিছু লাভ ও হল, কিন্তু লাভের টাকায় দিনশেষে কিছু খেতে হয়, তাই মুলধন আর বাড়াতে পারেনা। মুলধন আরেকটু বেশি হলে ব্যবসাটা জমিয়ে ফেলতে পারত। এদিকে আবার টাকা ধারকর্জ করাও পছন্দ করে না। একদিন কথায় কথায় করিম বলল, তার ১০ টাকা আছে যেটা ভাল কোথাও খাটানোর চিন্তা করছে।

রহিম বলল, আমার ব্যবসায় ই খাটাও না কেন, ভাল লাভ পাবে। প্রস্তাবটা পছন্দ হয়ে গেল করিমের। ১০ টাকা দিয়ে সেও বাদাম ব্যবসার অংশীদার হয়ে গেল। যেহেতু দুইজনের ই ১০ টাকা করে মুলধন ব্যবসায়, তাই দুজনের শেয়ার সমান, অর্ধেক অর্ধেক। রহিম ই ব্যবসা দেখাশোনা করে, আর প্রতিদিনের বিক্রির টাকা থেকে মজুরি বাবদ ২ টাকা কেটে নেয়।

তারপরেও লাভ থাকে। এভাবে কয়েক মাস পর তাদের লাভসহ মুলধন গিয়ে দাঁড়াল ৪০ টাকা। ব্যবসার এরকম রমরমা অবস্থা দেখে ওপাড়ার রামও ব্যবসার অংশীদার হতে চায়। রামের কাছেও আছে ১০ টাকা। এখন ১০ টাকা দিয়ে সে কি সমান শেয়ার পাবে? না, ১০ টাকা দিয়ে রাম কোম্পানির (মনে করুন বাদাম বিক্রির ব্যবসা এখন কোম্পানি হয়ে গেছে) ৫ ভাগের ১ ভাগ পাবে।

বাকি ৪ ভাগ রহিম আর করিমের মাঝে সমান ভাগ হবে। মনে করি শেয়ার বিক্রি এখানেই শেষ। প্রাইমারি মার্কেটে আর শেয়ার ছাড়া হচ্ছে না। তাহলে মার্কেটে আছে ১০ টাকা ফেস ভ্যালুর ৫ টি শেয়ার, রহিম আর করিমের কাছে ২ টি করে, আর রামের কাছে ১ টি। আর কেউ যদি এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে এই তিনজনের কারুর কাছ থেকে কিনতে হবে সেকেন্ডারী মার্কেটে।

তাহলে সেকেন্ডারী মার্কেটে শেয়ারের দাম কত হবে? কে নির্ধারন করবে? কেন, চাল-ডাল, আলু-পেঁয়াজের দাম যেভাবে নির্ধারিত হয় সেভাবে। মার্কেটে ডিমান্ড আর সাপ্লাই দিয়ে। একটু পার্থক্য আছে এখানে। চাল-ডাল খাওয়া ছাড়া অন্য কোন কাজে কেউ খুব একটা কিনে না, কিন্তু কিনতে ও পারে। মনে করুন, আপনি জানেন আগামীকাল বাজারে চালের দাম বেড়ে যাবে, আপনি আজকে বেশী করে চাল কিনে রাখলেন।

তাহলে আগামীকাল বাজারে যদি আসলেই যদি জমানো চাল বিক্রি করতে পারেন, তাহলে আপনার ক্যাপিটাল গেইন হবে। আবার অন্যরা যদি মনে করে বাজারে চালের দাম আরো বাড়বে, তাহলে সবাই চাল কিনে স্টক করতে চাইবে। তখন ডিমান্ড বেড়ে চালের দাম আরো বেড়ে যাবে। এই দাম বাড়া কিন্তু ভোক্তার ডিমান্ড বাড়ার কারনে হচ্ছে না। সবাই ক্যাপিটাল গেইন এর ধান্ধায় দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আর এই দাম বাড়ানোর তালিকায় সবার শেষে আছে মফিজ, সে চাল কিনেছে ১০০০ টাকা করে কেজি। আশা করছে পরের দিন বেশি দামে বিক্রি করবে। কিন্তু অন্য চাল ব্যবসায়িরা ভাবছে দাম অনেক বেড়ে গেছে, আর বাড়বে না। বাজারে গিয়ে দেখল ব্যবসায়ি ক্রেতারা কেউ চাল কিনছে না, কিনতে আসছে শুধু মোখলেস, সে চাল রান্না করে খাবে। তার কাছে ১০০০ টাকা দাম চাইতেই তো তেড়ে আসে, “আমারে কি পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে যে ১০০০ টাকা দিয়ে চাল খামু?” আটার কেজি ৪০ টাকা, কয়েকদিন রুটি খাই, পরে চালের দাম কমলে তখন ভাত খাব।

অবস্থা বেগতিক দেখে মফিজের মত সবাই চাল বিক্রি করে দিতে চায়, সাপ্লাই যায় বেড়ে। আর কয়েকদিনের মধ্যে চালের দাম নেমে আসে ৫০ টাকায়। খাওয়ার জন্য চাল কিনলে যেটা স্বাভাবিক দাম। মাঝখান থেকে মফিজের ক্যাপিটাল লস প্রতি কেজিতে ৯৫০ টাকা। কে দায়ী? মাঝখানে অনেকেই লাভ করেছে চালের বাজারে।

কিন্তু ৫০ টাকার চালের দাম ১০০০ টাকায় নিয়ে গেলে কাউকে না কাউকে তো ধরা খেতেই হবে। চালের উদাহরনটা শেয়ার বাজার বুঝানোর জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। তাও ইচ্ছা করেই দিলাম। আসলে চালের বাজারে এটা কখনোই হবে না। কারন চালের দামটা একটু অস্বাভাবিক পর্যায়ে গেলেই ব্যবসায়ীরা বুঝে যাবে আর বাড়ানো ঠিক হবেনা।

কারন চালের বাজার আর ভোক্তা কাছাকাছি থাকায়, ভোক্তা সর্বোচ্চ কত টাকায় ১ কেজি চাল কিনতে পারে সেটা ব্যবসায়ীরা মোটামুটি জানে। সমস্যাটা হয় শেয়ার বাজারে। মনে করুন রহিম, করিম আর রাম জানে তারা কোথায় বিনিয়োগ করেছে, বাদাম বিক্রি ভাল হলে তাদের লাভ বেশি হবে। ভাল কোম্পনি দেখে এখন যদি রামের শেয়ার শ্যাম ১৫ টাকায় কিনে নেয়, তার থেকে যদু ২৫ টাকায় আর মধু ৪০ টাকায় যদুর কাছ থেকে কিনে। এভাবে হাতবদল হতে থাকে, আর শেয়ারবাজারে চাঙগাবস্থা বিরাজ করতে করতে সর্বশেষ মদনের হাতে সেই শেয়ার আসে ১০০ টাকায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই শেয়ারের দাম কি ১০০ টাকা হওয়া উচিত? আবার একটু পেছনে তাকাই এখন। আমরা জানি শেয়ার মানে এখানে বাদাম ব্যবসার শেয়ার। এক বছর আগে ব্যবসার মুলধন ৫০ টাকা ছিল। এই এক বছরে শেয়ার হাতবদল হয়েছে, কিন্তু কোম্পানীতে কোন টাকা যোগ হয়নি। তবে কোম্পানী লাভ করেছে, তাই বছর শেষে কোম্পানীর মুলধন দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকা।

ভাল পারফর্মেন্স ই তো বলতে হবে। কিন্তু আমাদের মদনের কি অবস্থা দেখি। কোম্পানীর ভ্যালু যদি ১০০ টাকা হয়, সে তার ৫ ভাগের ১ ভাগের অংশীদার, অর্থাৎ ২০ টাকা। কিন্তু সে তো ২০ টাকার শেয়ার ১০০ টাকায় কিনে বসে আছে। তাও সে লাভ করতে পারে, যদি সে আর কারু কাছে ১০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি করতে পারে।

কিন্তু সেই চালের গল্প, কাউকে না কাউকে তো ধরা খেতেই হবে, ২০ টাকার সম্পদ ১০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার মানে এই ৮০ টাকা কারুর না কারুর পকেট থেকে যাবে। এখানে যা হচ্ছে, রামের শেয়ার হাত ঘুরে মদনের হাতে আসতে আসতে বাদাম বিক্রির কথা আর কারুর মনে নেই। শেয়ার যে বাদাম বিক্রির টাকার অংশীদারিত্ব দিচ্ছে, সেটা ভুলে গিয়ে সবাই ক্যাপিটাল গেইন এর আশায় শেয়ার কিনছে। ফলশ্রুতিতে শেয়ারের দামের সাথে কোম্পানীর ভ্যালুর সামঞ্জস্য থাকছে না। শেয়ারের দাম এত কমে গেছে শুনতে শুনতে একবার মনে হলো, দু’একটা শেয়ার কিনে দেখব নাকি।

তখন ভাবলাম, একটু দেখি তো, শেয়ারের দাম কি আসলেই কম? ডিএসই থেকে জেনারেল ইনডেক্স নিয়ে বানানো ফিগার দেখুনঃ ২০০৯ পর্যন্ত ইনডেক্স ৩০০০ এর নিচেই ছিল। এরপর একলাফে ৯০০০ এ উঠে গেল? এটা কি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ফল? না, ইনডেক্স যদি তিনগুন হতে হয় দেশের উন্নতির ফলে, তারমানে শেয়ারমার্কেটে অংশগ্রহনকারী কোম্পানীগুলো গড়ে তিনগুন হয়ে গেছে রাতারাতি! আসলেই কি? দেশের অবস্থা দেখে তো মনে হয়না। গ্রাফটাকে ২০০৯ থেকে আগের ট্রেন্ডে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ধরে যদি বর্তমান সময়ে পৌছান তাহলে দেখবেন ৩৫০০ র মত হয়েছে। এখান থেকে এটাও আশা করার কারন নেই এটা আবার ৯০০০ এ পৌছাবে রাতারাতি। আবার পৌছাতেও পারে, নির্ভর করবে বিনিয়োগকারীরা কি আচরণ করছে তার উপর, তবে বাদাম বিক্রির কথা মাথায় রেখে বিনিয়োগ করলে খুব তাড়াতাড়ি হওয়ার কথা না।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.