স্বাধীনতার এতগুলো বছর পার হওয়া স্বত্তেও বাংলাদেশ এই মুহূর্তে চরম সংকটময় দিন পার করছে। চারিদিকে হত্যা, খুন, ক্রসফায়ার, অপহরণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। অসুস্থ রাজনীতি অতিষ্ট করে তুলেছে জন-জীবন। আর ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে প্রতিবাদের ঝড়ো বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয় নীল। কলম দিয়ে একের পর এক প্রতিবাদী কন্ঠের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে থাকে সে।
আর তাতেই সরকার ক্ষেপে ওঠে তার ওপর। দু’দিন আগে তাকে রাস্তা থেকে কয়েকজন সাদা পোশাকধারী পুলিশ তুলে নিয়ে এসে অজ্ঞান করে এখানে রেখে যায় একটা মর্গের ভেতর । অজ্ঞাত এক মর্গ। জীবন্ত নীল কে অনেকগুলো লাশের সাথে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এটা শুধু কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা ছাড়া কেউ জানে না।
তবে আর একজন জানে...একটা মেয়ে।
১.
আবছা অন্ধকারে ছেয়ে আছে চারপাশ। নীল এখন ভীষণ ক্ষুধার্ত আর তৃষ্ণার্ত। জ্ঞান ফেরার পর বোটকা গন্ধে বমি আসার জোগার। কিন্তু খালি পেটে বমিটাও শেষ পর্যন্ত না আসার পায়তারা করল।
সময় কত হলো, এখন রাত না দিন কিছুই বুঝতে পারছে না সে। অন্ধকাারে এই ঘরের ভেতর পেতে রাখা চৌকিতে কি সব রাখা আছে কিছুই বুঝল না সে। ওঠে গিয়ে দেখার মত শক্তিও নেই। হঠাৎ দরজার বাইরে মৃদু আলো দেখতে পেল। মেয়েটি এখন মর্গের দরজার ধারে ছোট্ট একটা চার্জার লাইট হাতে দাড়িয়েছে।
মেয়েটি নীলের নাম ধরে বেশ জোরে ডাকতে লাগল-
-নীল...নীইইইল...
-কে ডাকছ আমাকে? (খানিকটা জোরেই জবাব দিল নীল)
-তুমি কি বেঁচে আছ নীল! তোমাকে আরো কয়েকবার ডেকে গিয়েছি কিন্তু সাড়া পাইনি।
-হাঃহাঃহাঃ...মেরে ফেলার জন্য নিয়ে এসে এখন খোঁজ নিচ্ছ বেঁচে আছি কিনা?
-আমি...
-কে তুমি বলত?
-আমি বন্দিনী।
-তোমার নাম বল?
-নামইতো বললাম...বন্দিনী!
-বন্দিনীই যদি হবে আমাকে কেন বন্দি করে রেখেছ...(করুণ আর দূর্বল স্বরে বলল নীল)
-নীল ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। তুমি পালাও ( কিছুটা চিৎকার করে বলল মেয়েটি)
-হাঃহাঃহাঃ...(মর্গের ভেতর থেকে প্রচণ্ড জোরে হেসে ওঠল নীল)। তুমি কে হে রমণী, একটু জানাবে প্লিজ?
-আমিও তোমার মত পথিক।
ওরা বহুকাল আগে আমাকেও ধরে এনেছিল। পার্থক্য শুধু আমি এখানে এই বন্দীশালায় নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারি, তোমাকে তা করতে দেয়া হচ্ছেনা। আমি জীবিত থেকেও মৃত। এখান থেকে কেউ কোনদিন পালাতে পারে না। মেরে না ফেলে আমাকে ওরা ওদের ভোগের জন্য বাঁচিয়ে রেখেছে।
...
-তবে আমাকে পালাতে বললে কেন? (কিছুটা সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইল নীল)
-যদি তুমি পালাতে পার, যদি তুমি এই বিভীষিকাময় পরিণতির কথাগুলো বাইরের জপতে বলতে পার... (মেয়েটির কণ্ঠে করুণ কান্না)
-ওরা আমাকে বেশ কয়েকবার সতর্ক করেছে ওদের বিরুদ্ধে কিছু না লিখতে। আমি লিখেছি। ওরা আমাকে থামাতে পারেনি। পারবে না। হাজার হাজার নীল এদেশের বুকে আছে।
ওরা কয়জন কে থামাবে বল! ওরা হেরে যাবেই। মানুষ আজ জেগে ওঠতে শুরু করেছে...
-হাঃহাঃহাঃ...তুমি এখনো কত বোকা নীল! এই বন্দীশালায় বন্দী হয়েও আত্মবিশ্বাসীর মত কথা বলছ? তাকিয়ে দেখ তোমার সামনে পরে থাকা লাশগুলোর দিকে। ওরাও তোমার মতই প্রতিবাদী ছিল। আজ ওরা এই গুপ্ত, অন্ধকার মর্গের ভেতর পরে আছে। মৃত্যুও পরও ওদের মুক্তি মেলেনি।
দেখ নীল...চেয়ে দেখ...
২.
মন্ত্রীসভার জরুরি বৈঠক আইন রক্ষাকারী প্রত্যেকটা বাহিনীর প্রধানগণের সাথে। তবে বৈঠকটি অত্যন্ত গোপনীয়। কোন মিডিয়া জানবেনা কেন এই বৈঠক। সময় রাত একটা। পিন-পতন নিরবতা চলছে।
কারো মুখে কোন শব্দ নেই। নিরবতা ভাঙলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।
-কি করে...কি করে ওই ছেলে বিদেশের সাথে আমাদের সকল গোপন চুক্তি সম্পর্কে জানল! গুপ্ত হত্যা, সিন্ডিকেট, জনগণের সাথে ভণ্ডামী এসব নিয়ে কেন লিখছে সে? আপনারা এতদিন ধরে শুধু মজা নিয়েছেন। বেড়াল প্রথম রাতেই মারেননি কেন? (বেশ চিৎকার করে প্রধানমন্ত্রী কথাগুলো বললেন। সাউন্ডপ্র“ফ রুম, তা না হলে বাইরের কয়েক এলাকার লোকজন শুনে ফেলত এমন একটি অবস্থা)
-স্যার...(মিনমিনে গলায় র্যাব প্রধান কিছু বলতে চাইলেন)
-চুপ করুন...আমি কোন অজুহাত শুনতে চাইনা...
-স্যার বলছিলাম কি, ছেলেটাকেতো আমরা ধরে এনছি এবার তো আর কোন প্রবলেম হবে না।
আর ওকে আমরা এমনভাবে মেরে ফেলব জগতে কেউ কোন দিন জানতেও পারবে না। যা এতদিন ধরে করে এসেছি... (দাঁত বের করে হাসি দিল সে)
-হুমম। ওর মৃত্যু নিশ্চিত হলে আমাকে জানাবেন। আর আগের লাশগুলো কি করেছেন?
-ওগুলোর এখনো কোন ব্যবস্থা নেইনি।
-স্যার আমরা ঠিক করেছি সবগুলো একসাথে এসিডে ঝলসে দেব।
(কথা বললেন পুলিশ প্রধান)
- আর এসিডের জন্য বাজেট করেছি তিন কোটি টাকা। (অর্থমন্ত্রী)
-তিন কোটি টাকা! লাশ কয়টা? (প্রধানমন্ত্রী যেন আকাশ থেকে পড়লেন)
- মর্গে লাশ আছে একশ আটষট্টিটা। আরো বাড়বে। তাছাড়া বাড়তি আরো কিছু খরচ আছে। কারণ এত এসিড একসাথে আমদানী করতে গেলে কিছূ ঝামেলা মেটাতে হবে।
অমাদের যে পরিমাণ মজুদ আছে তা দিয়ে হবে না।
-হুমম। কিন্তু এই খরচ জনগণের কাছ থেকে আদায় করা কি সম্ভব হবে? এমনিতেই জনগণ ক্ষেপে আছে...
-লোল...এটা আমার ওপর ছেড়ে দেন স্যার। ( বাণিজ্যমন্ত্রী হাসি দিয়ে বলল)
-লোল? এটার মানে কি? (আবারো প্রধানমন্ত্রীর অবাক হওয়ার পালা)
-স্যার এইটার মানে হইলো মজা পেয়ে হাসি দেয়ার সংক্ষেপরূপ। লাফড্ আউট লাউডলি, সংক্ষেপে লোল।
(বেশ মজা নিয়ে জবাব দিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী)
-এটাতো কোনদিন শুনিনি...
-ওই আর কি... ইন্টারনেটে এগুলো পাওয়া যায়। (কিছুটা লজ্জা রাঙা হাসি দিয়ে বললেন বাণিজ্যমন্ত্রী)
-স্যার আমিও ফেসবুক ইউজ করি। (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুটা বোকা আর গর্বের সুরেই বলল)
-ফেসবুকে নাকি আমাদের কে নিয়ে বেশ হইচই হয়?
-ও কিছুনা স্যার। বেশি বাড়াবাড়ি দেখলে সব ক্লোজ করে দেব। ( তথ্যমন্ত্রী মহোদয় পানির বোতলের মুখ খুলতে খুলতে বললেন)
-তাহলে আমার ফেসবুকের কি হবে? (কিছুটা কাদোঁ কাদোঁ হয়ে বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ) আমার লিস্টে এখন দুইশ ছত্রিশ জন ফ্রেন্ড।
আরো প্রায় দশটার মত এ্যাড রিকোয়েস্ট ঝুলে আছে...
-আরে রাখেনতো আপনাদের ফালতু আলোচনা। বাণিজ্যমন্ত্রী কি যেন বলছিলেন বলুন...
-জ্বি স্যার যা বলছিলাম, এই বাড়তি খরচ জনগণের কাছ থেকে ওঠানোর জন্য একটা সিন্ডেকেট করে দিয়ে কয়েকটা পণ্যের দাম বাড়াই দেব। দ্যাটস্ অল। আগে যে রকম করেছি...
-হুমম...গুড। তা এখন ছেলেটার কি কনন্ডিশন?
-বোধয় জ্ঞান ফিরেছে।
কোন খাবার-পানি দেযা হচ্ছে না। এতগুলো লাশের সাথে থেকে এমনিতেই অক্কা পাবে। (হেসে কথাগুলো বললেন র্যাব প্রধান)
৩.
বিস্ফোরিত চোখে লাশগুলোর দিকে তাকাতে লাগল নীল। দুর্বল পায়ে লাশগুলোর কাছে হেঁটে গিয়ে মুখগুলো দেখার চেষ্টা করল। এক একটা লাশ দেখে তার কন্ঠ থেকে অস্ফুট স্বর বেরিয়ে আসে।
সে বুঝে নিল বেশ কিছুদিন যাবৎ গুম হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সারি সারি লাশ পড়ে আছে এখানে। পত্রিকার পাতা উল্টালেই যাদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার খবর আসত। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। এখন এই লাশগুলো আর তার মাঝে কোন তফাৎ নেই। বিশাল এই ঘরের মধ্যে সারি বদ্ধ করে রাখা হয়েছে লাশগুলো।
কয়েকদিন যাবৎ এই মৃত্যু রহস্য নিয়ে তথ্য বের করার সোর্স খোঁজা শুরু করেছিল। কিন্তু তার আগে তাকেই নিখোঁজ করে দেয়া হল।
-কেঁদনা নীল! এটাই এখন চরম বাস্তবতা। আমিওতো মৃতই। এই মৃত্যুপুরীতে এতগুলো লাশের সাথে আর একদল শত্রুর সাথে থাকতে থাকতে আমি ভেবে নিয়েছি যে, আমি এখন কবরে...
-তুমি কি আমাকে এখান থেকে বাঁচাতে পারবে! আমি বাঁচতে চাই...
চিৎকার করে কাঁদতে লাগল নীল।
ক্ষুধা-তৃষ্ণায় গলা ধরে এলো তার। কণ্ঠটাও যেন বিট্রে করতে লাগল তার সাথে... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।