আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বলছি- প্রিন্স মাহমুদ এর গুণী 'সম্মান দর্শন' এর গল্প

৯০ দশকের শুরুতে 'ব্লুজ' ব্যান্ড এর এক কণ্ঠের নাম ছিল 'প্রিন্স'। তখন সোলস, ফিলিংস, রেনেসাঁ, ফিডব্যাক, নোভা, চাইম আর অবসকিউর,ডিফরেনট টাচ এর কলরবে বাংলাদেশ মাতোয়ারা। আর প্রতিমাসেই কোন না কোন নতুন ব্যান্ড এসে ঝড় তুলছেই। তাই সেই 'প্রিন্স' কে নিয়ে ভাবার সময় স্রোতাদের ছিল না। এরপর সেই প্রিন্স ব্লুজ থেকে বের হয়ে করলেন 'ফ্রম ওয়েস্ট' ।

৯১ সালে বাজারে এলো ফ্রম ওয়েস্ট এর অ্যালবাম ' সে কেমন মেয়ে'। যেহেতু আগে থেকেই ব্লুজ এর মাধ্যমে প্রিন্স কে চিনি সেই জন্য ফ্রম ওয়েস্ট এর অ্যালবাম টি কিনে ঘরে ফিরলাম। পুরো অ্যালবাম শুনে তো মাথায় হাত! একী ব্লুজ এর সেই প্রিন্স? ফ্রম ওয়েস্ট এ তাঁর কণ্ঠ এতো পরিপক্ক! যথারীতি ফ্রম ওয়েস্ট ভালো লেগে গেলো আর সারাদিন গাইতাম তাদের '' রাজাকার আলবদর কিছুই রইবো নারে, উপরে দালাল ভিতরে চোর কিছুই হইবো নারে, সব রাজাকার ভাইসা যাইবো বঙ্গোপসাগরে"। চরম একটা গান ছিল প্রিন্স এর কণ্ঠে। এরপর মিক্সড অ্যালবাম এর যুগের শুরুতেই এলো 'আবেগ' নামের একটি অসাধারণ মিক্সড অ্যালবাম।

সেখানেও ফ্রম ওয়েস্ট আর প্রিন্স দারুণ সব গান নিয়ে হাজির। যে ২/১ টি গান ফ্রম ওয়েস্টের অ্যালবামেও ছিল । সেই থেকে প্রিন্স কে প্রিয় তালিকায় রাখা। এরপর প্রিন্স এর আর কোন খোঁজ নেই। ১৯৯৪ সাল।

বাজারে মিক্সড অ্যালবাম তখনও শক্ত আসন গড়তে পারেনি। এলো ''শক্তি'' নামের এক অ্যালবাম । যেখানে অ্যালবাম কভারের ভিতরে ছবি দেখেতো অবাক! এতো আমাদের সেই ফ্রম ওয়েস্ট এর প্রিন্স মানে প্রিন্স মাহমুদ। যে অ্যালবাম এর ৮টি গানের কথা,সুর ও সংগীত তাঁর। সেই 'শক্তি' এসে মিক্সড অ্যালবাম এর এমনই এক শক্তিতে রূপান্তরিত হলো যা মিক্সড অ্যালবাম এর ভিত্তিটা শক্ত করে দিলো।

এরপর শুধু মিক্সড অ্যালবাম এর জয় জয়কার যার প্রধান এক কাণ্ডারি এই প্রিন্স মাহমুদ। সেই শক্তি অ্যালবাম থেকে একটা ব্যাপার লক্ষ করতে লাগলাম । যা সত্যিই মুগ্ধ করেছিল। তা হলো কিভাবে গুণী ও সিনিয়র শিল্পীদের সম্মান জানিয়ে তাদের গান প্রচার করতে হয় যা এখনকার সুরকার ও সংগীত পরিচালকদের মাঝে নেই। 'শক্তি' অ্যালবাম এর শিল্পী ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, ফজল, বাবনা, পার্থ ,নকিবখান ও আজম খান।

অ্যালবাম এর প্রথম গান আইয়ুব বাচ্চুর 'পালাতে চাই' শেষ গানও আইয়ুব বাচ্চুর 'নিহত নারী'। এ সাইড শুরু হয় আইয়ুব বাচ্চু দিয়ে আর বি সাইড শুরু হয় নকীব খান কে দিয়ে। অ্যালবাম এর ১১ নং গান ছিল গুরু আজম খানের 'মনকে বোঝাই তুমি কেঁদোনা'' যার আগের গানটি অর্থাৎ ১০নং গানটি ছিল নকীব খান এর ''মেঘটাকে দেখেছো নীল আকাশ কখনও দেখনি'' অর্থাৎ গুরুর গানের আগে পরে দুইজন ব্যান্ড যোদ্ধা যারা গুরুর খুব কাছে ছিলেন তাদের ২ জনের মাঝখানেই গুরুকে রেখেছিলেন যাতে গুরুর বিন্দুমাত্র অপমান বা অসম্মান না হয়। এবার আসুন ২য় অ্যালবাম 'ওরা ১১ জন' এ যাই। এখানে শক্তি অ্যালবাম এর জেমস ছিলেন না, তাঁর জায়গায় আসলো উইনিং এর চন্দন।

আসলো প্রমিথিউস এর বিপ্লব বাবনার পরিবর্তে। আর আসলো চাইমের খালিদ , অবসকিউর এর টিপু গুরু আজম খানের পরিবর্তে। যথারীতি শুরু হয় আইয়ুব বাচ্চুর 'আমার দুটি আকাশ ছিল'' গান দিয়ে। অর্থাৎ রাজাকে দিয়েই অ্যালবাম এর শুরু। অ্যালবাম শেষ হয় খালিদ এর ' কিভাবে কাঁদাবে' গান দিয়ে।

কি চমৎকার মিল শুরু এবং শেষের। শুরুতেই রাজা আইয়ুব বাচ্চুর বিরহের গান শেষে রাজপুত্র খালিদ এর বিরহের গান। এবার যাই 'ঘৃণা' অ্যালবাম এ । যেখানে আগের দুটি অ্যালবাম এর প্রথম কণ্ঠ আইয়ুব বাচ্চু নেই। এই প্রথম প্রিন্স মাহমুদ এর অ্যালবাম এ আসলেন আরেক কিংবদন্তী সবার প্রিয় মাকসুদ, সাথে আর্কের টুলু এবং হাসান।

বিরতি দিয়ে ফিরে আসলেন বাবনা। বাদ পড়লেন ওরা ১১ জন থেকে বিপ্লব, নকীব খান। বাকী সবাই আছেন। প্রথমেই শুরু হলো সবার প্রিয় মাকসুদ এর দুর্দান্ত '' ঘৃণা' গানটি দিয়ে। অর্থাৎ অ্যালবাম এর শিরোনাম সংগীত টি দিলেন অ্যালবাম এর মধ্যমণি মাকসুদ কে।

এরপর যথারীতি বাকিদের প্রাপ্য সম্মান দিয়েই অ্যালবাম এর গানগুলি সাজালেন। একই ভাবে শুরু ''ক্ষমা' অ্যালবাম এ মাকসুদ কে দিয়ে শুরুতেই ''ক্ষমা' গানটি দিয়ে। অর্থাৎ যে অ্যালবাম এ আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন সেই অ্যালবাম এ শুরু হতো আইয়ুব বাচ্চু কে দিয়ে, আর যে অ্যালবাম এ মাকসুদ ছিলেন সেই অ্যালবাম শুরু হতো মাকসুদ কে দিয়ে। ২জন শিল্পীকে প্রিন্স এর অ্যালবাম এ একসাথে পাওয়া যায়নি। হয়তো বা এটাও তাঁর গুণী দর্শন এর একটি রীতি।

ঘৃণা, ক্ষমা অ্যালবাম এর পরেই আসলো ''শেষ দেখা'' যেখানে মাকসুদ নেই। তাই যথারীতি শুরু হলো আইয়ুব বাচ্চুর ''শেষ দেখা '' নামক মনকাড়া চিরস্মরণীয় একটি গান দিয়ে। যার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু জেমস এর ''হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা'' নামক এক করুন আর্তনাদ এর গান দিয়ে। পরপর ২ কিংবদন্তীর ২ টা গান শুনে যে বিশ্রাম নিবেন তারও উপায় নেই কারন ৩ নং গানটা যে আরেক সম্রাট শাফিন আহমেদ এর গান। যেটিও বিরহের কিন্তু আগের ২ টির মতো চোখে জল আনার আর্তনাদ এই বিরহ এক দুরন্ত সুরের একাকীত্বের কষ্টের বর্ণনা।

যাকে বলে অসাধারণ ,অসাধারণ। কি চমৎকার ভাবে ৩ জন কিংবদন্তীকে দিয়ে ৩টি অসাধারণ গান পর্যায়ক্রমে সাজিয়েছেন যা না দেখলে বিশ্বাস হবার নয়। এখনকার সংগীত পরিচালকরা হয়তো এসব নিয়ে ভাবেন না। কার গান আগে আর কার গান পরে সেটা ভাবার সময় তাদের নেই। কারন এখন ডিজিটাল যুগ।

ঘণ্টায় ১০০ টা তাদের তৈরি করতে হয়। আসলে তারা যে গুণী নয় এটা স্বীকার করবে না। তাই তো গুনিদের কিভাবে সম্মান জানাতে হয় সেটা তারা জানেনা। শেষ দেখার পর আসে এখনও ''দু চোখে বন্যা'' অ্যালবাম টি । সেখানেও শুরু হয় আইয়ুব বাচ্চু র '' কতদিন দেখেনি দু চোখ'' গান দিয়ে যার পরেই আসে প্রিয় জেমস এর '' মা' গানটি।

ঐ দুটি গানের জন্যই এই অ্যালবামটি আমাদের অডিও ইতিহাসে ঠাই করে নেয়ার জন্য যথেষ্ট। বাকী হিট গানগুলোর কথা নাইবা বললাম। এমন করে ''স্রোত'', ''দহন শুধু তোমার জন্য'' ''দেয়াল'' এবং ''হারজিৎ'' পুরো ৯০ দশক শেষ হলো প্রিন্স মাহমুদ এর অসাধারণ চিরায়ত গুণী দর্শন দেখে আর একের পর এক গুনিদের সেরা গান দিয়ে তাদেরই জয়গানে। একজন সত্যিকারের গুণী জানে আরেক গুনিকে সম্মান জানাতে। যেখানে থাকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

যা প্রিন্স মাহমুদ তাঁর সুর করা অ্যালবাম গুলোতে বারবার দেখিয়েছেন। যা দিয়ে তিনি সবার কাছে একটি অলিখিত বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ''বড় হতে হলে আগে বড়দের সম্মান দিতে হয় যা একটা সময় তুমিও পাবে'' সংক্ষেপে হয়তো এটাই ছিল তাঁর সে গুণী সম্মানতত্ত্ব। যাদের চোখে পড়ার তা পড়বেই এই অলিখিত বার্তাটি, যাদের বোঝার ক্ষমতা আছে তাঁরা ঠিকই বুঝে নিবে অলিখিত বার্তাটি। কিন্তু সত্যি দুর্ভাগ্য জনক যে আজকের যারা সুপারস্টার ও জনপ্রিয় সুরকার বলে পরিচয় দেয় তাদের কারোরই হয়তো সেই বার্তাটি চোখে পড়েনি! সেই বার্তাটি বুঝতে পারেনি।

তাইতো তাঁরা প্রিন্স মাহমুদ এর মতো স্মরণীয় হতে পারেনি ও পারবেও না। কারন তাঁরা যে কেউ গুণী নয় তা প্রকৃতি ঠিকই জানে আর জানে স্রোতারাও। তাঁরা শুধু অস্থির ভজঘট সময়ের এক অস্থির 'বিনোদন কর্মী'' ছাড়া আর কিছুই নয়। সময় তাদের মনে রাখবে না। কে তুমি কথা রাখনি- আইয়ুব বাচ্চু অভিমান নিয়ে দিন কেটে যায় এক নদী যমুনা - জেমস একটি শিক্ষিত রেডিও  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.