১৩-১৪ বছরের শ্রাবন্তী নিজেকে নিয়ে খুবই অস্বস্তিতে ভুগতে থাকে। নিজের শারীরিক পরিবর্তনগুলো ঠিক মেনে নিতে পারছে না ও। এজন্য প্রায়ই ওর মনটা থাকে নানা রকম দুঃশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন। তবে যত দুঃশ্চিন্তাই থাকুক না কেন, স্কুল ছুটির পরে পথে ঐ ছেলেটাকে দেখলে মনটা ভাল হয়ে যায়। ছেলেটা কেমন করে জানি ওর দিকে তাকায়, তখন নিজেকে সত্যি বড় বড় লাগে।
একদিন ছেলেটা ওর সাথে এসে কথা বলে নিজের ভাল লাগার কথা জানিয়ে যায়। মুভিতে যেমন দেখায়, ঠিক তেমনই এক রকমের অনুভূতি হয় শ্রাবন্তীর। নিজের ভাল লাগার কথাটাও প্রকাশ করতে বেশি দিন লাগে না ওর। এরপর প্রায়ই দেখা হয়, কথা হয় ছেলেটির সাথে। ওর নাম পিয়াল, শ্রাবন্তীর এক ক্লাস সিনিয়র, পড়ে অন্য স্কুলে ।
এদিকে শ্রাবন্তীর মা কীভাবে যেন টের পেয়ে যায় ব্যাপারটা। কড়া নজরদারির মধ্যে মেয়েকে রাখার চেষ্টা করছেন। এছাড়াও মায়ের ভাবসাব এমন যেন শ্রাবন্তী খুব খারাপ একটা কিছু করছে। বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে ওর। কী এমন অসভ্যতাটা করছে শ্রাবন্তী? মুভির নায়ক নায়িকারাও তো এমনি করে।
সেটা তো খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে মা! তাহলে শ্রাবন্তীর বেলায় মায়ের সমস্যা কোথায়?
মায়ের কারণে পিয়ালের সাথে দেখা করতে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে বুদ্ধি করে ঠিকই একদিন স্কুল থেকে পালাতে পারে শ্রাবন্তী। তারপরে চলে যায় পিয়ালের বাসায়। সেদিন ওদের বাসায় কেউ ছিল না। খালি বাসায় সেদিন ওরা দুজন দুজনকে খুব করে ভালবাসতে চাইল।
ঠিক ঐ মুভিটার মত, কী যেন নাম! এই সময়ে নামটা শ্রাবন্তীর মনে পড়তে চায় না। আর পিয়ালের তো মনে পড়ার প্রশ্নই উঠে না। কারণ সে মারদাংগা মুভি ছাড়া আর কিছু দেখে না। তবে বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে কয়েকবার সে ঐসব মুভি দেখেছে। তাই ওর কাছে সেগুলোর কথাই মনে পড়ছে।
কিন্তু সেসব কি আর শ্রাবন্তীর কাছে বলা যায় নাকি? সেদিন দারুন কিছু সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরলো শ্রাবন্তী। মা কিছু টের পান নি দেখে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ও। কিন্তু কয়েকদিন পরে ঠিকই ধরা খেতে হল ওকে। যখন ওর শরীরে আরো পরিবর্তন এলো। শ্রাবন্তী জানতে পারল, ওর পেটে নাকি বাচ্চা! এটা কীভাবে আসলো, ও কিছুই জানে না।
অথচ মা ঠিকই পিয়ালের সাথে ওর সম্পর্কের কথা আঁচ করে ফেলেছেন। তারপর থেকেই ওর সাথে মায়ের আচরণ হয়ে গেল আরো খারাপ। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় প্রত্যেক কথাতেই মা যখন বলতে লাগলেন, ‘’মরিস না কেন তুই?’’ তখন, ওর আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করল না।
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের শরীর ও মনে কিছু পরিবর্তন আসে, যা খুব স্বাভাবিক।
রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করার কারণে পরিবারগুলোতে সন্তানদের এ সময়ে সঠিকভাবে যৌন শিক্ষা দেওয়া হয় না, বললেই চলে। বরং তাদের কৌতুহলকে সব সময় অবদমন করে রাখা হয়। কিন্তু তাই বলে ওদের কৌতুহল থেমে থাকে না। নিজের শরীর সম্পর্কে, শরীরের পরিবর্তন সম্পর্কে ওরা জানার চেষ্টা করে। আর ওদের জানার উৎস হল পর্নোগ্রাফি, রাস্তায় বিভিন্ন ভুয়া কোম্পানীর লিফলেট, বিজ্ঞাপন, সমবয়সী বন্ধু, অশ্লীল কৌতুক ইত্যাদি।
ফলে ওরা যেটা জানতে পারে, তা বেশির ভাগ সময়ই সঠিক, সুস্থ ও শোভন নয়। পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা সম্পর্কে তেমন কিছু নেই। যদি বা কিছু থাকে, তা সিলেবাসে থাকে না বা পড়ানো হয় না। সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে টিন এজাররা বড় হয় এক ধরনের অপরাধপ্রবন মন নিয়ে। শরীরের স্বাভাবিক পরিবর্তন অনেকের কাছে অভিশাপ বা পাপের মত মনে হয়।
এ বয়সের আবেগের কারণে বিপরীত লিংগের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। এটা অস্বাভাবিক নয়। আবেগ, কৌতুহল থেকে শ্রাবন্তী ও পিয়ালের মত সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়তে পারে কেউ কেউ। কিন্তু যৌন শিক্ষা না থাকার কারণে এমন সম্পর্কের পরিনতি বা খারাপ প্রভাব নিয়ে ওদের কোন ধারণা থাকে না। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক যৌন শিক্ষা না দিয়ে, শুধু নৈতিক শিক্ষার কথা বলে অথবা কঠোর অনুশাসন করে এ বয়সী ছেলে-মেয়েদের সুস্থ, সুন্দর বন্ধুত্ব ও বন্ধুত্বের সীমানা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন করা সম্ভব নয়।
যৌন শিক্ষা সম্পর্কে নিজেদের সঠিক ধারণা না থাকার কারণেও অনেকে সন্তানদের সচেতন করে তুলতে পারছেন না। তার উপর, আমরা উপরে উপরে আধুনিক হলেও, ভেতরটা রয়ে গেছে এখনো ক্ষ্যাত। তাই যৌন শিক্ষার কথা বললে আমরা ‘’শিক্ষা’’টা আর দেখতে পাই না, চোখের সামনে শুধু ‘’যৌন’’ শব্দটাই জ্বলজ্বল করে। অথচ বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন, সমস্যা, প্রতিকার, যৌন নিগ্রহ (abuse) সম্পর্কে সচেতনতা, জেন্ডার সচেতনতা, বিয়ে, পরিবার ও পারিবারিক মূল্যবোধ, মাদকাসক্তি ও তার কুফল, বিভিন্ন যৌন সংক্রামক রোগ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা এগুলো সব কিছুই যৌন শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।
বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ের কিশোর কিশোরীদের সৌন্দর্যই হল, ‘’ওরা অকারণেই চঞ্চল’’।
তাদের চপলতা, চঞ্চলতা কঠোরভাবে অবদমন করা হলে, সৌন্দর্যটাই যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আপনি যে সময়ে জন্মেছিলেন, বড় হয়েছিলেন, আপনার সন্তানটি জন্মেছে, বড় হচ্ছে তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে। তাই পুরাতন মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে সন্তানদের বয়স ও চাহিদা বুঝে যৌন শিক্ষা দেবার চেষ্টা করুন। আর এজন্য দরকার সন্তানের সাথে সহজ ও সুন্দর একটি সম্পর্ক তৈরি করা, তাকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, সন্তানের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা।
৩১ জানুয়ারি, ২০১২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।