আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি বীরাঙ্গনা বলছি

একাত্তরের ডিসেম্বরে মাদার তেরেসা খুলনা ও ঢাকার কয়েকটি ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। ওখানে তিনি দেখেন, পাকসেনারা কী পশুর তান্ডব চালিয়েছে। এসব ক্যাম্পে পাকসেনারা বাংলাদেশের নারীদের উপর দিনের পর দিন অত্যাচার চালিয়ে আসছিল। কেবল তাঁদের নগ্ন করেই রাখত না, অভাগীরা যাতে লম্বা চুল পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করতে না পারে এই ভাবনায় তাঁদের চুল কেটে দিত। এসব ক্যাম্পে তিনি কাউকে পাননি কিন্ত দেখেছেন তাদেঁর ছেঁড়া চুল, ব্যবহৃত পোশাক।

বেশিরভাগ যুদ্ধ-শিশুদের ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হত। তেমন কেউ এদের নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল না, নিজেদের কাছে, এমকি দেশেও রাখতে চাইছিল না। মাদার তেরেসা পরম মমতায় ওইসব যুদ্ধ-শিশুদের কোলে তুলে নিতে থাকেন। তাদের পাঠিয়ে দেন কলকাতা, ফ্রান্স, সুইডেনে। এই কারণে তিনি বাংলাদেশে তীব্র রোষের সম্মুখীন হন, জোর বলাবলি হতে থাকে, এইসব যুদ্ধ-শিশুদের তিনি খ্রীস্টান বানিয়ে ফেলবেন।

তেরেসা তখন থেমে থাকেননি। তাঁর কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন, গোপনে। বিজয়ের বেয়াল্লিশ বছর পার হলেও বীরাঙ্গনাদের অন্ধকার কাটেনি। সম্মান দিয়ে বীরের মর্যাদা দিতে পারেনি রাষ্ট্র। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে থাকতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের এ তরুণীরা সবার অগোচরে এখন বৃদ্ধা।

বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করা রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব ছিল। কিন্তু এতো বছরেও করেনি। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের অনেক বীরাঙ্গনা নারী। ৭২ সালে গঠিত নারী পুর্নবাসন বোর্ডের সদস্য লেখিকা নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটিতে বীরাঙ্গনা রীনার উক্তিতে বেরিয়ে আসে বিজয়ের সময় বীরাঙ্গনাদের অবস্থান। যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে সেই সময়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছিলেন ড: নীলিমা ইব্রাহীম।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন বীরাঙ্গনাদের মর্যাদা। ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন, “আজ থেকে পাকবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত। কেননা দেশের জন্য তারা ইজ্জত দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাঁদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাঁদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে।

আর সেই স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশে আমি বলছি যে, “আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহৎ স্ত্রীর স্বামী বা মেয়ের পিতা হয়েছেন। ” দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদের জন্য পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। নীলিমা ইব্রাহীম সে-ই বোর্ডের সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় খোলা হয়েছিল নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র।

সেখানে সিরাজগঞ্জের এই যুদ্ধাহত নারী মুক্তিযোদ্ধারা মাথাগোঁজার ঠাঁই পান, তিন বেলা খাবার পান। কুটিরশিল্পের কাজ শেখানো হতো তাদের আর এই জন্য তাদের দেয়া হতো কিছু বেতন। যুদ্ধকালীন সময়ে সারা দেশের ৪৮০ টি থানা থেকে গড়ে প্রতিদিন ২ জন করে নির্যাতিত মহিলার সংখ্যা অনুসারে ২৭০ দিনে ধর্ষিতার নারীদের সংখ্যা দাড়ায় ২ লক্ষ। সরকারী এক হিসাবে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা বলা হয়েছে তিন লাখ। কানাডিয়ান ইউনিসেফের চেয়ারম্যান যুদ্ধ চলাকালিন এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে দু'বার বাংলাদেশে আশার পরে তার রিপোর্টে ১০,০০০ যুদ্ধ শিশুর কথা উল্লেখ করেছেন।

যে সব দেশ এগিয়ে এসেছিল যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে তার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, সুইডেন এবং অষ্ট্রেলিয়া। ‘বীরাঙ্গনা’ মানে বীরের অঙ্গনা, বীরের নারী। মেয়েরা তাদের চোখের সামনে স্বজনদের খুন হতে দেখে প্রতিশোধ স্পৃহায় যুদ্ধে নেমেছিল। অথচ আজো মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি কেবলই পুরুষেরই দখলে। অনেকেই তাঁকে চেনেন ড. নীলিমা ইব্রাহীম নামে।

তবে শোনা যায়, তিনি নাকি নিজের নামের সাথে ‘ডক্টর’ কথাটা যোগ করতে চাইতেন না। তাঁর অনেক শিক্ষার্থীর লেখায় জানা যায় বিষয়টা কথাটা। তিনি নীলিমা ইব্রাহীম নামেই পরিচিত ছিলেন সবার মাঝে- একেবারে আকাশের নীলিমার মতোই। ১৯২১ সালের ১১ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামের এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নীলিমা ইব্রাহিম বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক। ’ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন তিনি। নীলিমা ইব্রাহিম আমৃত্যু মানুষের শুভ ও কল্যাণী চেতনায় আস্থাশীল ছিলেন।

মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উদার মানবিকতাবোধই ছিল তার জীবনদর্শন। পুষ্প বৈরাগীর গল্প দিয়ে শেষ করছি। পুষ্প বেওয়া স্বামীর সাথে গান গাইতেন। গানের মাধ্যমেই যুদ্ধের কথা বলতেন। একদিন রাজাকার পাকিস্তানী আর্মি নিয়ে আসে পুষ্পর বাড়িতে।

পুষ্পকে তার স্বামীর সামনেই নির্যাতন করে আর নিয়ে যায় তার স্বামীকে। তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরপর গত ৪০ বছর পুষ্প বৈরাগী শুধুই বঞ্চনা আর লাঞ্ছনা পেয়েছেন সমাজ থেকে। তাই আজ পুষ্প ও কমলা, রাহেলা, মাহেলা, আছিয়া, আয়শাসহ সকল যুদ্ধাহত নারী মুক্তিযোদ্ধার দাবি, রাজাকারের বিচার আর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। যাতে করে মৃত্যুর পরে তাদের কেউ ঘৃণার চোখে না দেখে।

১৯৭৩ সালে ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এর মধ্যে মাত্র দু’জন ছিলেন নারী। তাদেরই একজন কুড়িগ্রামের দরিদ্র নারী তারামন বিবি। তিনি তার ‘বীরপ্রতীক’ উপাধি পাওয়ার খবর জানতে পারেন ঘটনার ২৪ বছর পর। শেখ মুজিব কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘আমি ওদের বাবা।

মুক্তিযুদ্ধের প্রামান্য কিছু বইসমূহের তালিকাঃ ১। আমি বিজয় দেখেছি : এম আর আখতার মুকুল; (সাগর পাবলিশার্স) ২। একাত্তরের দিনগুলি : জাহানারা ইমাম; (সন্ধানী প্রকাশনী) ৩। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ : অধ্যাপক আবু সায়ীদ ৪। মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা : আবুল হাসনাত ৫।

মানবতা ও গণমুক্তি : আহমদ শরীফ ৬। স্বাধীনতা '৭১ (১ম ও ২য় খণ্ড) : কাদের সিদ্দিকী ৭। একাত্তরের স্মৃতি : বাসন্তি গুহঠাকুরতা; (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড) ৮। স্মৃতি ১৯৭১ : রশীদ হায়দা ৯। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস : লুৎফর রহমান রিটন ১০।

একাত্তরের ঢাকা : সেলিনা হোসেন; (আহমদ পাবলিশিং হাউজ) ১১। একাত্তরের ডায়েরী: বেগম সুফিয়া কামাল ১২। রাজাকারের মন (১ম ও ২য় খন্ড) : মুনতাসীর মামুন ১৩। ইতিহাসের রক্ত পলাশ : আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ১৪। আমি বীরঙ্গনা বলছি : নীলিমা ইব্রাহীম ১৫।

কালরাত্রির খন্ডচিত্র : শওকত ওসমান ১৬। আত্মকথা ১৯৭১ - নির্মলেন্দু গুণ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।