জীবনের প্রত্যেক প্রবাহ অমৃত চায়।
সদ্য যুবতী আমি- কলেজের চৌকাঠ পেড়িয়েছি,
বিশ্ববিদ্যালয়িক জীবনে পা দিয়েছি মাত্র এক বছর।
আমার ভাই ‘ইকবাল হল’-এর ছাত্র- তুখোর ছাত্রনেতা;
যেদিন ইকবাল হলে হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে,
আমাদের স্বপ্নের চাঁদকে গিলে খেতে চায় রাহু-রূপ পশুরা;
সেদিনই অভীক ভাই আমার সূর্যের অন্বেষনে ঘর ছেড়ে যায়।
এর কয়েকদিন পর-
কিছু পশু আমাদের বাড়িতে আসে ভাই-এর খোঁজে,
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা,
স্কুল শিক্ষক আমার বাবা, তাঁর জ্ঞানের অহমিকা নিয়ে বললঃ
গণতন্ত্রের কথা, ন্যায়ের কথা, ভালোবাসার কথা।
পশুদের সাথের শেয়ালগুলো দু’টি ইতিউতি করছে ,
একসময় দরজার পাল্লার পেছনে পর্দার আড়ালে আমাকে দেখে।
ভয়ে থরথর করে কাঁপছে আমার শরীর,
ঘৃণায় এক কলসী থুতু জমে মুখে;
হঠাৎ, একটি হায়েনা আমার বাবাকে গুলি করে-
পেটে, বুকে, মাথায়- অজস্র গুলি;
আমার মা পাশের ঘর থেকে ছুটে আসেন- তীব্র ঝড়ে আক্রান্তা, ভীত সন্ত্রস্ত;
বাবাকে বাঁচানোর ফুসরতই পেলেন না,
লুটিয়ে পড়লেন বাবার পায়ের কাছে, বড়ো লক্ষ্মী ছিলো মা আমার।
আমার চোখের সামনে ঘটে গেলো- পৃথিবী পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক লহরী,
নির্বাক আমি চেতনবিদ্ধতাহীন অচিন দেশের যুবতী।
যখন হুঁস হলো নিজেকে আবিস্কার করি
অয়োময় খাঁচায় বন্দী বিধ্বস্ত পাখি এক ;
প্রচন্ড ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর,
নারীত্বের অহংকারে জ্বলছে হাবিয়ার তীব্র আগুন।
সারা মেঝেতে রক্ত- যেন অজস্র অশোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে;
গবাক্ষ গলে পড়া একটি আলোর রেখা ছাড়া
আর কিছুই দেখছি না; অন্ধকার জতুগৃহের দোজখে
কতো লক্ষ বছর ছিলেম! আমি কিছুই জানি না।
একদিন অনুভবে বুঝতে পারলাম আমি ,
সব সুনসান- নেকড়ে, হায়েনা, কুকুর, শেয়ালের
কোন আনাগোনা নেই, চিৎকার নেই;
কাঁদার ভেতরে শুয়োরের ঘোঁৎঘোঁৎ নেই;
শুঁকতে শুঁকতে আসে না কোন পশু, শুয়োরের বাচ্চা,
আমার দেহের কাছে, আমার ঘৃণার নাগালে।
কোথাও দূর থেকে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জনের মতো
জলোদ্ভবিত হিরন্ময় শ্লোগান- ‘জয় বাংলা’ ...।
আমার রক্তে ঝড় ওঠে, কন্ঠ মেলাতে চাই;
অক্ষম আমি, নিস্তেজ হয়ে পড়ি নিষ্প্রভতায়।
অনুভবে ধরা পড়ে আমার ভেতরে আরেকটা ‘আমি’।
এমনি সময় , অন্ধকার ভেদ করে সমস্ত ঘরে
ছড়িয়ে পড়ে তীব্র সূর্যালোক রশ্মি ;
আলোর আঘাতে চোখে জ্বলে, কিছুতেই চোখ খুলতে পারছি না।
শরীরের সমস্ত শক্তি নিংড়ে ধীরে ধীরে দাঁড়ালাম আমি-
সূর্যের পানে যাওয়ার প্রচন্ড শক্তি নিয়ে।
চোখের সামনে দেখি আমার ভাই!
দাঁড়িয়ে আছে শশ্রুমন্ডিত, রাইফেল কাঁধে।
এই সে-ই ভাই-
যে আমাকে আদর করতো পুতুলের মতো,
ভর দুপুরে সবচেয়ে উঁচু ডালের পাকা আমটি পেড়ে দিতো,
নিজের শরীর রক্তাক্ত করে পেড়ে আনতো বেতস ফল,
বৈশাখী মেলা হতে আমারই জন্য কিনে আনতো-
চুলের রঙিন ফিতা, কাঁচের বেলোয়ারি চুড়ি,
মাটির পুতুল, সোলার পাখি, আলতার বড়ি।
তাকে চিনতেই আমি অবশ হয়ে গেলাম,
নিংড়ে তোলা শরীরখানি হারিয়ে গেলো।
একসময় দেখলাম, আমি শুয়ে আছি- প্রেমময় ভাইয়ের কোলে,
তাঁর মমতার হাতখানি আমার জট-পাকানো চুলে বিলি কাটছে।
দু’চোখে তাঁর অশ্রুর নদী নেমে আসছে- বরফ গলা জলের ধারা।
বিহ্বল আমি তাকিয়ে রই অনিমেষ- আমার সূর্য সন্তান ভাইয়ের প্রতি।
পাশে তাঁর সংসপ্তক বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে;
যে আমাকে তুলে নিয়েছিলো ‘যুদ্ধশিশু’সহ
লাল সবুজের মাঝে হলুদের টিপ পড়া পতাকাকে স্বাক্ষী রেখে ... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।