২০১১ থেকে ২০১৩। মাত্র দুই বছরের ব্যবধান। এবার মোহাম্মদ মুরসির পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল মিসরের তাহরির স্কয়ার। গতকাল বুধবার রাতে গণবিক্ষোভের মুখে দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র এক বছরের মাথায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে দেশের সংবিধান স্থগিত করে প্রধান বিচারপতি আদলি মানসুরকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করা হয়েছে।
গতকাল রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি বলেন, দেশকে বাঁচাতে মুরসিকে সরিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী তাদের ‘ঐতিহাসিক দায়িত্ব’ পালন করেছে। মুরসি ক্ষমতা ভাগাভাগিতে বিরোধীদের দাবি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন।
সেনাপ্রধান টেলিভিশনে ভাষণ দেওয়ার সময় মুরসিবিরোধী লাখ লাখ উৎফুল্ল মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারা স্লোগান দিতে থাকে, ‘জনগণ-সেনাবাহিনী ভাই ভাই। ’
প্রায় দুই বছর আগে ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল তাহরির স্কয়ার।
ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। তাঁর পদত্যাগের পর বাঁধভাঙা উল্লাস করেছিল মিসরের জনগণ।
মুরসিসহ ক্ষমতাসীন ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির কয়েকজন নেতার দেশত্যাগের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সেনাবাহিনী। এর আগে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদসহ রাজধানী কায়রোর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ট্যাংক, সাঁজোয়া যানে সজ্জিত সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
রাষ্ট্রীয় আল-আহরাম পত্রিকায় বলা হয়, স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটার দিকে সেনাপ্রধান সিসি প্রেসিডেন্ট মুরসিকে জানিয়ে দেন, তিনি আর মিসরের প্রেসিডেন্ট নেই।
সিসি ভাষণে বলেন, দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়েছে। নতুন করে পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং আগাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালতের প্রধান আদলি মানসুর স্থলাভিষিক্ত হবেন মুরসির।
সেনাপ্রধান যখন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিরোধী জোটের নেতা মোহাম্মদ এল বারাদি, আল-আজহারের প্রধান ও কপটিক গির্জার প্রধান। জনতা মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পক্ষে—এমনটা বোঝাতে এই তিনজনকে সেখানে নেওয়া হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে মুরসির কার্যালয় সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করে এটিকে ‘অবৈধ’ বলে উল্লেখ করেছে। প্রেসিডেন্টের ফেসবুক ও টুইটারে বলা হয়, দেশের স্বাধীন মানুষ এই ক্ষমতাচ্যুতিকে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করবে। তিনি বেসামরিক-সামরিকসহ সর্বস্তরের মানুষের প্রতি সংবিধান মেনে চলার এবং শান্তিপূর্ণভাবে এই ‘অভ্যুত্থান’ প্রতিহত করার আহ্বান জানান। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মুরসিকে কোথায় রাখা হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
মিসরের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে মুরসিকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিল সেনাবাহিনী।
গতকাল বিকেলে তা শেষ হয়। সেনাবাহিনীর আলটিমেটামকে কেন্দ্র করে মিসরজুড়ে গতকাল ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাজপথে অবস্থান নেয় সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষের হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক। দুই পক্ষের সহিংসতায় গতকাল নিহত হয়েছে অন্তত ১৮ জন।
শেষ মুহূর্তে মুরসি অন্তর্বর্তী জোট সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এই সরকার আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচন আয়োজন এবং সংবিধান সংশোধনের জন্য স্বাধীন কমিটি গঠন করবে। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।
গত রোববার মুরসির ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হয়। সেই দিন থেকে শুরু হয় মুরসিবিরোধী বিক্ষোভ। তাদের অভিযোগ, মুরসি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মাধ্যমে ২০১১ সালের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা বস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছেন।
সহিংসতায় নিহত ১৮: রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, প্রেসিডেন্ট মুরসির সমর্থকেরা গতকাল কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাইরে মিছিল বের করে। এ সময় বন্দুকধারীরা গুলি চালালে অন্তত ১৮ জন নিহত হয়।
নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র জানায়, মুরসিপন্থীরা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ ইসলামপন্থী।
সেনাবাহিনীর আলটিমেটাম: মিসরে গণবিক্ষোভের মুখে দীর্ঘ তিন দশকের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতনের পর এক বছর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুরসি।
এরপরই নিজের ক্ষমতা বাড়াতে তিনি কিছু পদক্ষেপ নেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় দেশের মানুষ। আবার দানা বাঁধতে থাকে ক্ষোভ। শুরু হয় বিক্ষোভ। মুরসির পদত্যাগের দাবিতে সম্প্রতি ওই বিক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করে।
এ অবস্থায় গত সোমবার একটি বিবৃতি দেয় সেনাবাহিনী। এতে সংকট সমাধানে সরকার ও বিরোধী পক্ষকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সমাধানে পৌঁছাতে না পারলে মুরসিকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। বলা হয়, তা না হলে সেনাবাহিনী পদক্ষেপ নেবে।
সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির বরাত দিয়ে একটি বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সন্ত্রাসী, চরমপন্থী ও গোঁড়াদের হাত থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করতে আমাদের জীবন উৎসর্গের শপথই আমরা নিয়েছি।
’
এর আগে গতকাল দুপুরে বৈঠকে করেন সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। বৈঠকের কিছুক্ষণ পর কায়রোয় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সদর দপ্তরে যায় সেনাবাহিনীর দুটি সাঁজোয়া যান। টেলিভিশন ভবন থেকে বের করে দেওয়া হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সেনাপ্রধান জেনারেল সিসি গতকাল এল বারাদিসহ বিরোধী বিভিন্ন পক্ষের নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে সুন্নি মুসলমান ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতাসহ ক্ষমতাসীন দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।