সব সুখী পরিবার একই রকম; কিন্তু অসুখী পরিবারগুলো যার যার মতো করে অসুখী। টলস্টয়ের আনা কারেনিনা উপন্যাসের প্রথম বাক্যটি মিসরের মুরসি সরকারের জন্যও সত্য। জনগণকে খুশি করাই সফল সরকারের গুণ। কিন্তু জনগণের অসুখী হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। মিসরের বেলায় সরকার জনগণকে রুটি, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তাই তারা সেনাবাহিনীকে দিয়ে তাদেরই পতন ঘটিয়েছে, যারা নাকি কিছুদিন আগে তাদের সেনাশাসনের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু ঘটনাটি এত সরল মনে হয় না।
জন্ম থেকেই মুসলিম ব্রাদারহুড আমেরিকা ও ব্রিটেনের কাছে গ্রহণযোগ্য ‘ইসলামি’ দল। তাহলে কী কারণে ইসরায়েলের পর সর্বাধিক সাহায্যপ্রাপ্ত (এ বছর ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার) মিসরীয় সেনাবাহিনী সেই পছন্দের দলটিকে উত্খাত করল? ব্রিটেনের কাছে ঘটনাটা ‘গ্রহণযোগ্য’, যুক্তরাষ্ট্রও একে ক্যু বলতে রাজি নয়। অভ্যুত্থান ঘটানোর আগের দুই দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেল ও জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান মার্টিন ডেম্পসি মিসরীয় সেনাপ্রধানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে ছিলেন।
মনে করার কারণ নেই যে যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষিত মিসরীয় সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি পেন্টাগনের হিসাবের বাইরে মুরসিকে বন্দী করেছেন। ক্যুয়ের মাত্র কদিন আগে যে আদলি মানসুর বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হন, তাঁকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগের আগে সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারক করিয়ে নেওয়া হয়। অভ্যুত্থানের প্রধান দুই সিভিল সমর্থক হলেন আন্তর্জাতিক আণবিক কমিশনের সাবেক প্রধান নোবেলজয়ী এল বারাদি এবং হোসনি মোবারক সরকারের প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফিক। আহমদ শফিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুরসির কাছে পরাজিত হন। গত মার্চে তাঁরা দুজন সংযুক্ত আরব আমিরাতে মিলিত হয়ে মুরসি সরকারের পতনের পরিকল্পনা করেন।
অভ্যুত্থান ঘটার আগেই এক সাক্ষাত্কারে শফিক ফাঁস করেছেন যে মুরসিকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করার ফন্দি ছিল তাঁদের। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে ঠিকই, তবে তাঁকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট না বানানোয় তিনি হতাশ হয়ে চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন।
মুরসির পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছিল প্রধানত দুটি কারণে। সেনাবাহিনী তাঁর হাতে ছিল না, বিচার বিভাগ নির্বাচিত সরকারকে পদে পদে বাধা দিচ্ছিল, আমলাতন্ত্র নিজের ইচ্ছায় চলছিল, পররাষ্ট্র দপ্তর ও ব্যাংকব্যবস্থাও সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব কটি প্রতিষ্ঠানেই যখন মোবারক যুগের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গাঁট মেরে বসে ছিলেন, তখন মুরসির একমাত্র শক্তি ছিল নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পদ।
এমনকি সংসদও আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়ে গিয়েছিল। মোবারকের আমলের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জারি করা আদেশ কেন গণতান্ত্রিক আমলে পালিত হলো না, তার জন্য আদালত নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। ফিরিয়ে আনা হয়েছিল একসময়কার ঘৃণিত পাবলিক প্রসিকিউটরকে। অথচ মিডিয়ায় প্রচারিত হয়, ব্রাদারহুড সরকারই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে। পাশাপাশি শরিয়া আইনের কিছু কিছু বিধান জারি করা, রাষ্ট্রকে ইসলামি করতে চাওয়াও জনগণের বিরাট অংশ মানতে পারেনি।
ব্রাদারহুড শেষ পর্যন্ত জনগণের দল না হয়ে দলের জন্য জনগণ ভাবা শুরু করেছিল।
অন্যদিকে হোসনি মোবারকের আমলে আইএমএফের ‘পরামর্শে’ মিসরের অর্থনীতিকে বাজারীকরণ করা হয়। রাষ্ট্রীয় সেবাসুবিধা উঠিয়ে নেওয়া হয়। জনগণ মূলত এ কারণে ক্ষিপ্ত হয় মোবারকের বিরুদ্ধে। কিন্তু মুরসিকেও ক্ষমতারোহণের সময় আইএমএফের নির্দেশ মেনে নিতে হয়েছিল।
এতে অর্থনীতি আরও নাজুক অবস্থায় চলে যায়। আইএমএফের নির্দেশ মানতে গিয়ে অর্থনৈতিক ব্যর্থতা মুরসির জন্য রাজনৈতিক ব্যর্থতা হয়ে দেখা দেয়।
তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়, যুক্তরাষ্ট্র কেন ব্রাদারহুডকে পরিত্যাগ করল? প্রধান কারণ, গণবিক্ষোভ উত্তরোত্তর মার্কিনবিরোধী হয়ে উঠছিল। মুরসিবিরোধী বিক্ষোভে সে দেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যান পিটারসনের বিরুদ্ধেও স্লোগান ওঠে। বিক্ষোভ চলাকালেই তিনি মিসরীয়দের বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘কেউ কেউ বলে, নির্বাচনের বদলে রাজপথের বিক্ষোভেই ভালো ফল আসবে।
কিন্তু সত্যি কথা বললে আমি ও আমার সরকার এ বিষয়ে সন্দিহান। ’ মুরসিকে রক্ষার জন্য ওবামাও শেষ চেষ্টা করেন, মুরসি ও সেনাপ্রধানকে ফোন করে মীমাংসার আহ্বান জানান। বিপরীতে মুরসিকে ওবামার পুতুল বলে অভিহিত করে ব্যানার ওঠে তাহরিরে। সুতরাং, সময় থাকতেই একে নিয়ন্ত্রণে আনায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপই যথার্থ মনে করেছে মার্কিন প্রশাসন। মার্কিন মিত্র সৌদি আরব, কাতার হইহই করে একে সমর্থনও করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ‘আরব জাগরণ’ এভাবে তার অন্তিমে গিয়ে পৌঁছাল।
আরব জাগরণ আর যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ তথা মডারেট ইসলামপন্থী দলের ক্ষমতারোহণ প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। এর পেছনে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা সরকারগুলোর মুসলিমবিষয়ক নীতি। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে যাতে আমেরিকা-ইসরায়েলবিরোধী জনগণের সত্যিকার বিকল্প দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে মার্কিনপন্থী ইসলামি দলকে সমর্থন দেওয়া হতে থাকে। এর শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে সোভিয়েতঘেঁষা আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মোকাবিলার উদ্দেশ্য থেকে।
সে সময়ই মিসরের জাতীয়তাবাদী নেতা গামাল আবদেল নাসেরের বিরুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুডকে মদদ দিতে থাকে ব্রিটেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য অস্তমিত হলে উত্তরাধিকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র একই কায়দায় মুসলিম দেশগুলোর জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার সরকারগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করতে থাকে। এই সরকারগুলো অচিরেই স্বৈরতন্ত্র হয়ে উঠলে পশ্চিমাদের আরও সুবিধা হয়।
সেক্যুলার স্বৈরশাহির বিরুদ্ধে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে উসকে দেওয়ার সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারা। তারা চেয়েছিল প্রথমত, রক্ষণশীল শাসনে মুসলিম দেশগুলো পিছিয়ে থাক; অন্যদিকে সেক্যুলার বনাম ইসলামপন্থার বিবাদে অশান্তিও চলতে থাকুক।
এভাবে দেশগুলো বিভক্ত থাকলে পশ্চিমাদের পক্ষে আরবের অগাধ তেলসম্পদ ব্যবহার ও ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। এ কারণেই মুসলিম ব্রাদারহুড ছিল তাদের প্রথম পছন্দ। আবার ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সেক্যুলারদের গৃহযুদ্ধ হলেও সেই উদ্দেশ্যের কোনো ক্ষতি হয় না। আখেরে আরবকে অশান্ত ও বিভক্ত রাখাই তো লক্ষ্য।
এ লক্ষ্যেই আরব জাগরণকে নিজেদের খাতে বইয়ে দিতে নতুন করে নেমে পড়ে তারা।
আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম, এনজিও নেটওয়ার্ক, ফেসবুক-টুইটার তো রয়েছেই; আরব তরুণদের গণ-আন্দোলনের প্রশিক্ষণও দেওয়া হতে থাকে সেই জর্জ বুশের আমল থেকেই। লক্ষণীয়, যেসব মার্কিন প্রতিষ্ঠান (যেমন ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি) বছর দুই আগে তাহরিরের তরুণদের তহবিল জুগিয়েছিল, মুরসিবিরোধী আন্দোলনেও তারা পাশে থেকেছিল। গণ-আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল যে কিফায়া সিভিল সোসাইটি মুভমেন্টের পৃষ্ঠপোষকতা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর নন-ভায়োলেন্ট কনফ্লিক্ট।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, আরব জাগরণ ও মডারেট ইসলামপন্থা নিয়ে আমেরিকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার কি ইতি ঘটল? মিসরে যা ঘটল, তার প্রভাব সমগ্র মুসলিম দুনিয়ায় পড়বে। সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে মধ্যপন্থী ইসলামি দলগুলো চরমপন্থার দিকে যেতে পারে।
তাদের মনে থাকবে, ১৯৬০ সালে তুরস্কের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আদনান মেন্দারেসকে ইসলামপন্থী অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত করে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৯৯২ সালে আলজেরিয়ার নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করতে যাওয়া ইসলামিক সালভেশন ফ্রন্টকে সিংহাসনের বদলে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, যার পরিণতিতে গৃহযুদ্ধে এক লাখ মানুষ নিহত হয়। ফিলিস্তিনে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার খেসারত হামাসকে দিতে হয় ভেতরে-বাইরে অবরোধ ও হামলার শিকার হয়ে।
আজকে মুসলিম দেশগুলোতে সেক্যুলার বনাম ইসলামপন্থার যে দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে, তার ফলাফল কারও জন্যই ভালো নয়। কেননা, সেক্যুলারিজম ও ইসলাম উভয়ই এসব দেশে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ঢাকার ঢাল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।
এসব দেশে দরকার সহনশীল ও সমতাভিত্তিক গণতন্ত্র। ভালো-মন্দ যেকোনো আদর্শিক কঠোরতাই রাজনীতিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। আর যে গণতন্ত্র সমতা আনে না, যে সেক্যুলারিজম গণবিরোধী, যে ধর্মীয় রাজনীতি অধিকার দেয় না, জনগণতাদের রাখবে না। তখন জনগণের মধ্যে এতসববিভক্তির সুযোগ নেবে তৃতীয় পক্ষ।
মিসরে যা-ই ঘটুক, শেষ লড়াই সম্ভবত হবে রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র হয়ে ওঠা সেনা স্টাবলিশমেন্ট বনাম জনগণের মধ্যে।
ব্রাদারহুড সরে যাওয়ায় এখন জনগণ সামনে সেনা নেতৃত্বকেই পাবে জবাবদিহি চাওয়ার জন্য। তাদের মার্কিন-ইসরায়েল ঘনিষ্ঠতাও আর আড়ালে থাকবে না। ১৯৯২ সালে আলজেরীয় নেতা আবদেল কাদের হাচানি জয়ের প্রাক্কালে যা বলেছিলেন, তা যেমন মুরসির জন্য সত্য হয়েছে, তেমনি সেনাপ্রধান সিসির জন্যও সত্য হওয়ার অপেক্ষায়। তিনি বলেছিলেন, কখনো কখনো বিজয় পরাজয়ের চেয়ে বিপজ্জনক। মুরসি জিতে হেরেছেন, সেনাপ্রধান ও বারাদি গং বিজয়ের বিপদ এড়াতে পারবেন না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
farukwasif@yahoo.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।