আরব বিশ্বে জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম দেশ মিসরের চলমান সংকট সহজে নিরসন হওয়ার তেমন কোনো সুস্পষ্ট সংকেত দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য সংকটের গভীরতা এবং জটিলতার কারণে কোনো সহজ কিংবা আশু সমাধান আশা করাটাই হবে বাস্তবতাবহির্ভূত। বিশেষ করে যেখানে বড় এবং প্রভাবশালী দেশগুলো হয় পরস্পরবিরোধী অবস্থানে অবতীর্ণ হয়েছে এ সংকটকে কেন্দ্র করে কিংবা দোদুল্যমান নীতিতে বিচরণ করছে। আমেরিকা এবং বৃহত্তরভাবে অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য মিসরের সংকট একটি 'উভয়-সংকট' অর্থাৎ 'ডিলেমার' মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। কেননা এই প্রভাবশালী আরব দেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত করার কারণেই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
তাই গণতান্ত্রিক বিশ্বের পক্ষে এ পদক্ষেপ সমর্থন করা সম্ভব নয়। 'মিলিটারি ক্যু' তারা একটি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করতে পারে না। সেটা আমেরিকা এবং মিত্ররা করছেও না।
তবে মিসরের ব্যাপারে এসব দেশের বিশ্লেষণে অন্য উপাদানও বিরাজমান। ভিন্নধর্মী ব্যাখ্যাও রয়েছে মিসরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে, যদিও সামরিক বাহিনী কর্তৃক গণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতাচ্যুতি নীতিগতভাবে সর্বত্রই সমালোচিত হচ্ছে।
মিসরে মোহাম্মদ মুরসির ইসলামপন্থি সরকারকে অনেক গণতান্ত্রিক দেশই পছন্দ করেনি। তারা মনে করেছে এ সরকার অতি মাত্রায় ধর্মীয় 'অ্যাজেন্ডাকে' গুরুত্ব দিয়েছে। আমেরিকা এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতে, মোহাম্মদ মুরসির এক বছরের শাসনামলে মিসরের সমাজ ব্যবস্থায় বিভক্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বড় কথা হলো, তারা মনে করে, এই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও দেশ শাসনে তেমনি মনোভাব দেখাতে পারেনি। তাই সামরিক বাহিনী কর্তৃক প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মন্তব্য করেছেন, সেই সরকার 'ওঘঈখটঝওঠঊ' ছিল না।
অর্থাৎ জনগণের আস্থার প্রতিফলন মোহাম্মদ মুরসি দেখাতে পারেননি দেশ শাসনে যদিও গণতন্ত্র অর্থ এই নয় যে, সবারই মতামতে শাসন চলবে। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যেন মনে করে, এটা তাদের সরকার।
অবশ্য তাই বলে ওবামা সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপ সমর্থন করেননি। মার্কিন গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের অধিকাংশই মনে করেন যে, শাসন পদ্ধতিতে ধর্মীয় কর্মসূচিকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও শুধু জনগণই পারবে গণতান্ত্রিকভাবে সরকার পরিবর্তন করতে। প্রেসিডেন্ট ওবামা মিসরের সংকট সৃষ্টির সময়ে 'ম্যাসাচুসেটস' রাজ্যে পরিবার নিয়ে সাত দিনের ব্যক্তিগত ছুটি কাটাচ্ছিলেন।
কিন্তু মিসরের ভয়াবহ ঘটনাপ্রবাহ এবং তার দেশে এ পরিস্থিতির তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করে তিনি অবকাশকালীন সময়েই একটি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, আমেরিকা এই সংকটে কোনো পক্ষ অবলম্বন করছে না। তবে আমাদের প্রতিক্রিয়া রয়েছে এবং সেটা হলো মিসর বিপজ্জনকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ওবামা সামরিক বাহিনী কর্তৃক 'মুসলিম ব্রাদারহুড' এবং মোহাম্মদ মুরসির সমর্থকদের ব্যাপক হত্যা ও গ্রেফতারের অবসান দাবি করে সহনশীলতার মাঝ দিয়ে দেশটিকে গণতন্ত্রে যথাশীঘ্রই ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। কিন্তু মিসর সংকটের শুরুর পর আমেরিকার বিভিন্ন মহলে যে বিষয়টি নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে সেটা হলো, এই সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেই দেশটিতে মার্কিন ১.৬ বিলিয়ন ডলার আমেরিকান সাহায্য অব্যাহত থাকবে কিনা।
আমেরিকার আইন হলো কোনো দেশে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক ক্যু সংঘটিত হলে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী গণতন্ত্র হিসেবে ওয়াশিংটনের সেই দেশে সাহায্য-সহায়তা স্থগিত করতে হবে। মিসরের বার্ষিক ১.৬ বিলিয়ন ডলারের প্রায় সবটাই ব্যবহৃত হয় সেখানে সামরিক বাহিনীর জন্য। কিন্তু ওবামা প্রশাসন জুলাই মাসের ৩ তারিখে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ্ আল-সিসির নেতৃত্বে মোহাম্মদ মুরসির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হওয়ার পরও দেশটিতে মার্কিন সাহায্য বন্ধ করেনি। প্রশাসন এ ঘটনাকে একটি 'সামরিক অভ্যুত্থান' বলে আখ্যায়িত করতে আগ্রহী নয়। কেননা সেটা হলে আইন অনুযায়ী মার্কিন সাহায্য বন্ধ করতে হবে মিসরে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত সরকারের এভাবে ক্ষমতাচ্যুতির বিরোধিতা করলেও এ ঘটনাকে সরাসরিভাবে 'সামরিক ক্যু' বলতে উৎসাহী নন। কিন্তু এ কারণে তাকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
বিরোধী রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর ও সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন ম্যাককেইন ওবামার বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে অভিযোগ করে বলেন, 'আমরাই আমাদের আইন ভঙ্গ করছি_ মিসরকে সব সাহায্য স্থগিত করা উচিত। '
আরও কয়েকজন বিরোধী সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান প্রশ্ন রাখেন, এত হত্যাযজ্ঞের পরও কেন প্রেসিডেন্ট সাহায্য বন্ধ করার ঘোষণা দিচ্ছেন না? প্রভাবশালী পত্রিকা দৈনিক 'ওয়াশিংটন পোস্ট' সম্পাদকীয়তে এ ক্ষেত্রে সরকারের সমালোচনা করেছে। মার্কিন সরকার এখনো মিসরে সাহায্য বন্ধ করেনি।
তবে স্বীয় দেশের বিভিন্ন মহলে পরিস্থিতি অনুধাবন করে প্রেসিডেন্ট ওবামা মিসরের সঙ্গে আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য আমেরিকার যৌথ সামরিক কর্মসূচি আপাতত বাতিল ঘোষণা করেছেন। মিসরের 'সাইনাই' অঞ্চলে এ কর্মসূচি দুই বছর পর পর হয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও বার্ষিক সাহায্য বন্ধের ব্যাপারে চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। সরকারদলীয় ডেমোক্র্যাট কয়েকজন সদস্যও এ বিষয়ে বক্তব্য রাখছেন। উল্লেখ্য, আমেরিকার কংগ্রেস ও সিনেট সদস্যদের ভিন্ন মত দেওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছুটা স্বাধীনতা রয়েছে।
বাংলাদেশে স্বীয় দলের নীতির বাইরে অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়। তাই সংসদ সদস্য এবং নেতা-নেত্রীদের বিবেকের তাড়নায় কিংবা সত্য ভাষণের সুযোগ নেই। যেভাবে নেই সংগঠনগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চার। এমনকি এই কথাটাও বলার স্বাধীনতা রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রায় নেই বললেই চলে। স্বীয় নেতা-নেত্রীর বন্দনা এবং বিরোধীদের 'ইবষড় িঃযব ইবষঃ' অর্থাৎ অমর্যাদাকর মন্তব্য করার মাঝে বিরাজ করে উল্লাস এবং ক্ষেত্রবিশেষে অবদান রাখে রাজনৈতিক উত্থানে।
যেভাবে বিদ্যমান রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে শিক্ষা, জ্ঞান, সেবা ও সততার নূ্যনতম স্বীকৃতি। অন্যান্য তথাকথিত 'গুণাবলী' প্রাধান্য পায় প্রায় সব সরকারেরই সময় বাংলাদেশে। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো দৃষ্টান্ত জঘন্যভাবে প্রকট হলেও যারা দেয় এবং যারা সেই সুবিধা উপভোগ করে তাদের এ ব্যাপারে লজ্জা নেই।
এখানে গত তিন সপ্তাহকালে অবস্থানকালে আবারও প্রত্যক্ষ করছি সর্বক্ষেত্রে মেধা ও দক্ষতার কি দাম। রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয় থাকলেও মেধা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা মার্কিন রাজনীতি ও প্রশাসনের সর্বাগ্রে প্রাধান্য পায়।
'চাটুকারিতা' এবং তথ্য গোপন জঘন্য বলে বিবেচিত হয়ে অবধারিত শাস্তির ক্ষেত্র তৈরি করে। যাই হোক, মার্কিন নীতির স্ববিরোধিতা মিসরের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, সম্ভবত সেই দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের স্বার্থ চিন্তা করে। উল্লেখ্য, মুরসি সরকারের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তেলআবিব এ সময় মিসরে সেনা সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে।
আমেরিকার তুলনায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিসরের ঘটনাবলীতে অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
একটি বিরল যৌথ বিবৃতিতে ইউরোপীয় কমিশন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টরা মিসর সরকারকে সহনীয়তার পরিচয় দিতে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রদর্শন করতে আহ্বান জানিয়েছেন। মিসর ইউরোপীয় অসংখ্য পর্যটক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সাহায্যের ওপর বেশ কিছুটা নির্ভরশীল। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল জার্মানদের আপাতত মিসরে যেতে বারণ করেছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়া ওলাদ বলেছেন, ইউরোপীয় এবং আরব বিশ্ব মিসর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অবদান রাখতে পারে।
কিন্তু আরব বিশ্বে মিসরের ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কি প্রভাবশালী আরব দেশসমূহ এ সংকটে বেশ সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। সৌদি আরব মিসরের সামরিক শাসকদের পক্ষ নিয়ে প্রচুর আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে_ যা কিনা মার্কিন সাহায্য থেকে অনেক বেশি। সংযুক্ত আরব আমিরাতও একইভাবে কায়রো সরকারের পক্ষে। তবে কাতার মোহাম্মদ মুরসির প্রতি সহানুভূতিশীল। রিয়াদ ও আবুধাবি মুরসির সমর্থকদের 'সন্ত্রাসী' বলে আখ্যায়িত করছে।
এতে সামরিক শাসকরা উল্লসিত। একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেন, মার্কিন ও ইউরোপীয় সাহায্য মিসরে বন্ধ করলেও আরব সাহায্য সেই ক্ষতি বড় করে পুষিয়ে দেবে। নীতি ও আদর্শ নয়, স্বার্থ ও কৌশলই আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে বেশি প্রভাবিত করে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।