অরুণালোক তৈয়ব খান
সারা বছরই কোন না কোন সমস্যা আবর্তিত হতে থাকে সারা দেশবাসীর ওপর। এক সরকার যায় আবার অন্য সরকার মতায় আসে কিন্তু জনসাধারণের দূর্ভোগ লাঘবের কোন চেষ্টা থাকে না কারো। সরকারের পট পরিবর্তন হওয়ার পর তারা ব্যস্ত থাকে তাদের ঘর গোছাতে। তাতে মুষ্ঠিমেয় কিছু স্বার্থপর লোকের ভাগ্য পরিবর্তন হলেও দেশের আপামর জনসাধারণ কোন সুফল ভোগ করতে পারে না। বর্তমানে সমগ্র দেশবাসি যখন দ্রব্যমূল্যের উদ্ধগতিতে দিশেহারা, বিদ্যুতের বিরামহীন লোডশেডিংয়ের শিকার হয়ে অতিষ্ঠ, গ্যাসের জন্য পানির জন্য শহরবাসি সীমাহীন দূর্ভোগের জীবন কাটায় তখন কেউ কেউ দেশ প্রেমের পরম পরাকাষ্ঠা হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বদলের খেলায় মেতে উঠে।
তাতে খরচ করে রাশি রাশি অর্থ।
বর্তমানে সারাদেশের বিদ্যুতের যে অবস্থা তাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সারাদেশ। এখন যে পরিস্থিতি তাতে এভাবে চললে সারা দেশের শিল্পকারখানায় উৎপাদন বন্ধ করে দিতে আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাথে এর ব্যবহারের যে ব্যবধান তার দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যেতে চায় প্রতিটি সরকার, এ যেন দায়মুক্ত হওযা। এ কথা সত্য যে উৎপাদনের তুলনায় ব্যবহারিক চাহিদা বেশি।
কিন্তু চাহিদা পূরণ করার যে উৎপাদন টার্গেট তার তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার। আবার উৎপাদন যা-ও আছে তা যদি সঠিক ব্যবহার হয় তাহলে কোন কথা ছিল না। গভীরে খতিয়ে দেখলে এতে এক শ্রেণীর লোকের দুর্নীতির চিত্রই পরিষ্কার হয়ে চোখের সামনে। গত ০৩-০৪-১০ তারিখের দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে উঠে এসেছে এ চিত্রটি। খবরের শিরোনাম “মার্কেট ৮টায় বন্ধ, ফুটপাতের ব্যবসা গভীর রাত পর্যন্ত, বাতি জ্বলে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে, ওরা বলে জেনারেটর”।
দূঃখজনক হলেও প্রকাশিত খবরটি সত্য। কিন্তু কত খবর যে অপ্রকাশিত রয়ে গেছে, তা খোঁজতে গেলে মনে হবে এক শ্রেণীর অসাধু লোকের কাছে জিম্মি হয়ে আছে সারা দেশ, দেশের মানুষ। সব সরকারের সময় এদের চেহারা একই থাকে।
“গ্যাসের জন্য কাফকোসহ পাঁচটি সার কারখানা বন্ধ” এটিও একই দিনের নয়াদিগন্তের প্রকাশিত খবর। অন্যান্য সংবাদপত্রে শিরোনাম ভিন্ন হলেও খবরটি একই আছে।
খবরটি সত্য। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ না করতে পারার কারণে সার কারখানা বন্ধ করতে হচ্ছে। যার প্রভাব পড়বে সামনের ইরি-বুরো মৌসুমে। তখন উচ্চমূল্যে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ভেজাল সার আমদানী করা ছাড়া উপায় থাকবে না। অপরদিকে গ্যাস সঙ্কটের কারণে রাজধানীবাসীর যে দূর্ভোগ তার পুরোটা চিত্র যারা ঢাকায় বসবাস করেন তারা বিলক্ষণ জানেন।
“এক বেলার রুটি ভাজতেই দুই দিন লাগে” শিরোনামে যে খবরটি নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয়েছে তা পড়লে নাগরিক দুর্ভোগের চিত্রটা পরিষ্কার ফুটে উঠে। গত ০৩-০৪-১০ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশ “গ্যাস সঙ্কটে বদলে যা"েছ রাজধানীর জীবনযাত্রা”।
পানির অবস্থা তথৈবচ। ঢাকাবাসীর পানির কষ্ট দেখলে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। পান করার উপযোগী হলে চোখের পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করা যেত।
কিন্তু কেন এসব হচ্ছে? পানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি তো আছেই তার ওপর আছে পানির ব্যাপক অপচয়। ঢাকার প্রায় এলাকার কাচা, আধা পাকা, বস্তি ও বস্তি সাদৃশ্য পায় বাড়িতেই ওয়াসার পানি ধরে রাখার কোন আন্ডার গ্রাউন্ড টাঙ্কি নেই। তার বদলে আছে ওয়াসার মূল পাইপের সাথে ট্যাপ বা নলকুপের সংযোগ। পানি সরবরাহের মূল পাইপে নলকুপ সংযোজন করে এসব বাড়িওয়ালারা। খরচ বাঁচানোর জন্য আন্ডার গ্রাউন্ড ট্যাঙ্কি তৈরি করে না এরা।
ফলে পানি যখন আসে তখন সমস্ত লোকজন টিউবওয়েল চেপে ধাক্কাধাক্কি মারামারি খিস্তিখেউর করে সে পানি সংগ্রহ করতে যায়। ফলে পানির অপচয় যে কী রকম হয় তা জায়গায় না দাঁড়িয়ে থেকে কেউ ভাবতেও পারবে না। ওয়াসা যে পরিমাণ পানি সকাল বিকাল সরবরাহ করে তার অধিকাংশই যদি অপচয়ই হয় তবে নিজেরাই নিজেদের দুর্ভোগ কিনে নেয় বলা ছাড়া আর উপায় থাকে না। ফলে একদিকে যেমন ওয়াসা পানির ঘাটতি পূরণ করতে পারে না, অপর দিকে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ অপচয় হয়। ওয়াসার পানি সরবরাহ করার সময় মূল পাইপ থেকে মোটর চালিয়ে বাড়িওয়ালা নাম-কা-ওয়াস্তে কিছু পানি ছাদের ওপর রাখা ট্যাঙ্কি ভরে যা নিতান্তই সামান্য।
বাকি পানি যাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাঙ্কি আছে তাদের দিকে চলে যায়। ফলে কেউ কেউ পানি পায় আবার কেউ কেউ পায় না। এটা নদ্দা জগন্নাথপুর, রামপুরা, কুড়িল এলাকার চিত্র। মিরপুর, মোহাম্মদ পুরে এরকম আছে বলে জানা গেছে। বাংলাবাজারেও রাস্তার মোড়ে এই ধরণের টিউবওয়েল দেখা গেছে।
খোঁজ নিলে হয়তো অন্যান্য এলাকার চিত্রও এরকমটাই দেখা যাবে।
গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎÑ এ তিনটি যে কত জরুরী তা বলে বুঝাতে যাওয়াটা বোকামু। আর এই জরুরী তিনটি জিনিসকে আমরা যেভাবে অপচয় করি তার সঠিক চিত্র তুলে ধরতে গেলে সংবাদ পত্রের পৃষ্ঠা সংখ্যা যদি প্রতিদিন একশ’ও করা হয় তবু এই অপচয়ের সবগুলো ছবি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বাইরে কড়কড়ে রোদ থাকার পরও গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে কাপড় শুকানো, অকারণে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখা, গ্যাসের অবৈধ সংযোগসহ তার ব্যবহার একসময় মানুষকে কাঁদাবে, সেদিন সম্ভবত আর দূরে নয়। পানির ক্ষেত্রে অকারণে ট্যাপের মুখ খোলে রেখে পানি ফেলে দেয়া, মাত্রাতিরিক্ত পানির ব্যবহার, নির্মাণাধিন ভবনগুলোতে অবৈধভাবে পানির জোগান দিয়ে পানির সঙ্কট তৈরি করছি আমরা নিজেরাই, এদেশের মানুষরাই।
অন্যদিকে বিদ্যুতের অবস্থাও তাই। বিদ্যুৎ অপচয়, অবৈধ সংযোগ বন্ধ করতে পারলে হয়তো মানুষের কষ্ট অন্তত পঞ্চাশভাগ কমে আসতো।
আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, ‘কনভার্টেট ন্যাচারাল গ্যাস’ তেলের বিকল্প গাড়ির জ্বালানী হিসেবে পেয়ে মনে হয়েছিল নাগরিক বুঝি এবার অল্পব্যায়ে যাতায়াত সুবিধা ভোগ করতে পারবে। কিন্তু পরিবহন মালিকরা কম মূল্যে গ্যাস কিনে পরিবহন ভাড়া তেল চালিত গাড়ির সমানই রেখেছে। তো, লাভটা হয়েছে কার? নাগরিকের নাকি পরিবহন মালিকদের? এরা মুনাফা লুটে নিয়ে ফোলে ঢোল হচ্ছে আর নাগরিকরা সব মাছের শুটকি হচ্ছে।
সিএনজি পাম্পগুলোতে সঠিক তদারকি কি হচ্ছে?
গ্যাস পানি ও বিদ্যুৎ, এই তিনটিকে যদি সুষ্ঠু বন্টন, সঠিক তদারকি ও অপচয় রোধ করা না যায় তবে এমন একটা সময আসবে যখন সবকিছু স্থবির হয়ে পড়বে। দুর্নীতির মাধ্যমে যারা এসব জাতীয় সম্পদকে কেন্দ্র করে অবৈধ অর্থ উপার্জন করে তারা শুধু নিজের স্বার্থের কথাটাই ভাবে। দেশের বাকি মানুষদের প্রতি যে একটা কর্তব্য আছে তা একবারও এসব দূর্নীতিবাজদের মনে পড়ে না। মনে পড়লে ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা ভেবে তাদের পরিবর্তন হতো।
প্রাসঙ্গিক একটা কথা বলা যাক, তা হচ্ছে তাবলীগ জামায়াতের একটা আদর্শ আছে।
তা হচ্ছে, সবকিছু সুন্দর করতে হলে আগে ব্যক্তিকে (নিজে) পরিশুদ্ধ হতে হবে, তারপর সমাজ, তারপর দেশ”। এ কথাটি হয়তো আমরা সবাই জানি, কিন্তু মানি না। যখন নিজের মূল্যায়ন করি, তখন সাধু সেজে বাইরে তার প্রকাশটাই করি, কিন্তু মনের গহনে জমে থাকে স্বার্থপরতা। এখনতো আর পাকিস্তান নেই, ব্রিটিশ নেই। তাহলে? লোভ, মোহ এসবের কারণে আমরা একভাই আরেকভাইকে ঠকিয়ে চলছি প্রতিনিয়ত।
তাই আমরা কেউ ভাল নেই। আমাদের কষ্টের জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করছি। রবীন্দ্র নাথ বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করো নি”।
এখন সবচেয়ে বড় যে প্রয়োজন তা হচ্ছে প্রশাসনের দূর্বলতা কাটিয়ে এই তিনটি সেক্টরের দূর্নীতি বন্ধ করে সুষ্ঠু বণ্টন ও সঠিক তদারকির ব্যবস্থা করা।
অপরদিকে এসব জাতীয় সম্পদ ব্যবহারের ওপর জনগণের অসচেতনতা ও অজ্ঞতা দূর করা। যাতে তারা জাতীয় সম্পদের গুরুত্বটা বুঝতে পারে।
লেখক ঃ কবি, সাংবাদিক
(স্টাফ রিপোর্টার, ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা পোস্ট ও পাকি তৃতীয় বাংলা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।