কদিন আগে (৩ জানুয়ারি) একই সঙ্গে দুটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট ও কুয়েটের মারামারি ও সহিংসতার ঘটনা সবারই নজরে এসেছে। নতুন বছরের শুরুতেই যেখানে সবাই ভালো কিছুর প্রত্যাশা করছে, সেখানে এমন দুটি ঘটনা সত্যিই বেদনাদায়ক। প্রথম ঘটনাটি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়র (বুয়েট) বিদায়ী ব্যাচের কনসার্টকে কেন্দ্র করে। একজন শিক্ষার্থীকে গুরুতর আহত করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার খানেক শিক্ষার্থীর দাবির মুখে বুয়েটের দুজন ছাত্রকে আজীবন বহিষ্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শাস্তিপ্রাপ্তরা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত (সূত্র: প্রথম আলো এবং কালের কণ্ঠ, ৩ জানুয়ারি)।
বুয়েটের ছাত্ররাজনীতির কারণে সহিংসতা ও মারামারির সংবাদ এর আগেও পত্রিকায় এসেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরাই এ রাজনীতির সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।
অপর ঘটনাটি খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট)। সম্ভবত এ ঘটনাই অধিক বেদনাদায়ক। কুয়েটের হলের বার্ষিক ভোজনকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা কুয়েটের হলে হামলা চালালে বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি, বেশি টাকা নিয়ে তাদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। এ জন্য তারা তদন্তেরও দাবি জানিয়েছিল। বার্ষিক ভোজনের শুরু হয় শনিবার (৩১ ডিসেম্বর), মূল আয়োজন ছিল রোববার (১ জানুয়ারি), সেদিনই সহিংসতার সূচনা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনার তদন্তের আশ্বাস দিয়েছিল এবং কোনো শিক্ষার্থী মার খেলে তার দায়িত্ব নেবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিল।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হামলায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। এরপর উত্তেজিত সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ভাঙচুর চালিয়েছে। ঘটনাগুলো চট করেই ঘটে গেছে এমন নয়। এটাকে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সামনেই দীর্ঘ সময় নিয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে অথচ প্রশাসনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়নি।
হামলার সময় ধারালো অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে সেগুলো বড় বেশি বেমানান। বহিরাগত সন্ত্রাসীরাও হামলায় ভূমিকা রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এই সন্ত্রাসীদের আগমন ঘটল কীভাবে?
চুয়েট ও রুয়েটেও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়ছে। চুয়েটের দুটি গ্রুপের মারামারির ঘটনার খবর পত্রিকায় অনেকবার এসেছে।
এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় মারামারির পর পরাজিত গ্রুপটির কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী স্থায়ীভাবে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে যাদের পুরো শিক্ষাজীবনই বিপর্যস্ত হয়, আরও কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী সাময়িকভবে ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়, যাদের কয়েক সেমিস্টার ড্রপ দিতে হয়। এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের দায়দায়িত্ব কে নেবে? প্রতিটি সিস্টেমে কিছু অঘোষিত বিধি, রীতি ও নিয়ম থাকে। একজন জুনিয়র শিক্ষার্থীর কাছে সিনিয়র শিক্ষার্থী অথবা একজন শিক্ষক যদি লাঞ্ছিত হন তবে সেখানে শিক্ষার পরিবেশ কতটুকু বজায় থাকে? শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ২৬ ডিসেম্বর ২০১১ থেকে ১ জানুয়ারি ২০১২ পর্যন্তু শীতকালীন ছুটি ঘোষণা করেছিল চুয়েট কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী সময়ে আবারও ছাত্রদের দাবির মুখে ছুটি ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকেই জানা যায়, গত দুই বছরে কারণে-অকারণে শুধু চুয়েট বন্ধ হয়েছে আটবার।
শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় দেড় মাসেরও বেশি সময় বন্ধ ছিল রুয়েট। প্রতিটি বিশ্বকাপ খেলার সময়ই অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হোক বা না হোক বুয়েট বন্ধ হয়ে যায় বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। এসব কারণে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে প্রকৌশল শিক্ষা। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যে প্রকৌশলীরা হবেন ডিজিটাল স্বপ্ন বুননের কারিগর, এখন তাঁরাই হচ্ছেন দ্বিধাগ্রস্ত।
কারণে-অকারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব সহিংসতায় ছাত্ররাজনীতি অবশ্যই দায়ী কিন্তু এসব মারামারি ও সহিংসতায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউশন অব টেকনোলজি (বিআইটি) থেকে চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছিল। আশা ছিল প্রকৌশল শিক্ষায় তথাপ্রযুক্তিনির্ভর দেশ গড়ার ব্যাপারে একটি নতুন ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন অনিয়ম, ছাত্রদের মধ্যে মারামারি আর সহিংসতার কারণে সে ভিত্তিতে মনে হয় চির ধরতে বসেছে।
এ ছাড়া প্রতিটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধেই অনিয়ম আর দুর্নীতির সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। প্রশাসনের অনিয়ম, দলীয়করণের সঙ্গে ছাত্রদের মধ্যে মারামারি, সহিংসতা ও অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটির সংশ্লিষ্টতা (যোগসূত্র) আছে। সচেতন মানুষ এই সংশ্লিষ্টতার গূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত। বিআইটি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রার সুযোগ লাভ করার পর পরিণত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা ছিল। যেসব গুরুত্তপূর্ণ কাজ এ সময়ে সম্পাদনের কথা ছিল এর মধ্যে গবেষণা কার্যক্রমের প্রসার ঘটানো, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন এসব অন্যতম।
কিন্তু পরিণত হওয়ার আগেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আসছে একের পর এক দুর্যোগ। সারা বিশ্বের ইউনিভার্সিটিগুলোর র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার একটি বড় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মারামারি ও সহিংসতা। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ তুলনামূলক বেশি। দেশের সেরা শিক্ষার্থীরাই এ বিষয়ে পড়তে আসেন।
কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এখানে পড়তে আসার পর প্রায়ই তাঁরা তাঁদের মেধাকে ভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে ফেলেন।
তিনটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট) জন্য ২০০৩ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সে আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা শীর্ষক ধারায় বলা আছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করা, সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলীর উন্নতি বর্ধন এবং স্বাস্থ্যের উৎকর্ষ সাধনের ব্যবস্থা করা। ’ একই আইনের অন্য একটি ধারায় বলা আছে, ‘ছাত্র এবং সকল শ্রেণীর নিয়োগকৃতদের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা ও বজায় রাখা এবং তাহাদের আচরণবিধি প্রণয়ন ও কার্যকর করা। ’
প্রকৌশল শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ওই আইনগুলোর সার্থক প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
যেকোনো সহিংসতায় যাতে প্রকৃত অপরাধী সাজাপ্রাপ্ত হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর বিভিন্ন মহলের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের তদবিরের কারণে তা কার্যকর করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে প্রকৃত অর্থে নিজস্ব আইন দ্বারাই প্রভাবমুক্তভাবে পরিচালিত হতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হয়েছে। কয়েক দিন ধরে পত্রিকাগুলোতে বিভিন্ন খাতে আমাদের অগ্রগতির খবর ও পরিসংখ্যান বেরিয়েছে।
কিন্তু প্রযুক্তি খাতের বিষয়াদি নিয়ে মনে হয় আমরা একটু উদাসীন। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজনীতির বিরূপ দৃশ্য ইতিমধ্যেই আমাদের সামনে প্রতীয়মান হয়েছে। দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান এখনো সমুন্নত আছে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মারামারি ও সহিংসতার বর্তমান চিত্র ভবিষ্যতের খারাপ সময়ের ইঙ্গিত দেয়। তাই এসব অপরাজনীতি, মারামারি, সংঘাত, দলীয়করণ ও অনিয়ম বন্ধের ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ মানেই হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ। প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহিংসতামুক্ত থাকবে, এটাই আমাদের কামনা।
আমিনুল ইসলাম দীদার: প্রাবন্ধিক, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।