ব্যাঘ্র যুগে শুধু মৃত হরিণীর মাংস পাওয়া যায় 'এতদিন ভাবতাম কেউ আমাকে জড়ায়নি; অচ্ছুৎ, অপাংক্তেয় লাগত নিজেকে। আজ কেন যেন নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মনে হয়, আমিই কি জড়াতে চেয়েছিলাম? রিটায়ার করার আগে শেষ কর্মদিবসে কোন চাকুরে যেমন কাজ করে, প্রয়োজনে নয় বরঞ্চ সামাজিকতা বজায় রাখতে, তেমনি মনোভাব নিয়ে কিভাবে যেন জীবন কেটে গেল। বহু সুবর্ণ সুযোগ, সোনালি বিকেল হাত পিছলে সরে যেতে দিয়েছি- ক্ষমতা নয়, ইচ্ছার অভাবে। আরেকটু যদি সাহসী হতাম, যদি আঁকড়ে ধরতে পারতাম ওই ভালবাসাকে! কিন্তু এখন ভেবে কি লাভ? বেঁচে থেকে কিছুই পাইনি বলে কেঁদে কি হবে? শুধু দীর্ঘশ্বাস থেকে যাবে অনন্তকাল।
আজ আমি অচল, আমার পাশে কেউ নেই। খবর পেলে উত্তরাধিকারীরা আসবে, হয়তো দুই ফোঁটা চোখের পানিও ফেলবে। কিন্তু আমার তাতে কি আসে যায়? পরম অন্ধকার বলে যদি কিছু থাকে, তবে তার বাস আমার ভেতরে। অমরাবতীর বাসিন্দারা আলো-কে দাম দিতে শেখে না, তার আসল মূল্য ধরতে জানে কেবল নরকের কীট। আমি সে কীটেরও অধম, পুড়ে জ্বলে খাক হবার জন্য আমার ভাগ্যে আগুনও জোটে না।
নিশীথের জ্যোৎস্না দেখে বিবাগী সিদ্ধার্থের মত আমারও গৃহত্যাগে ইচ্ছা জাগে। পার্থক্য এই, সিদ্ধার্থ ছিলেন যুবক, আর আমি পরাজিত সময়ের এক বৃদ্ধ ক্রীতদাস। '
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে পাণ্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠাটা নামিয়ে রাখল নার্স। ঘুরে তাকাল এর লেখক, বিশাল বিছানায় শায়িত একটা জীবন্মৃত মানুষের দিকে। পাণ্ডুলিপিটা তার লেখা।
ছ'তলা বিশাল এক প্রাসাদোপম বাড়ি, তার তিনতলায় লেখকের বর্তমান অবস্থান। পুরো ছ'তলা বাড়িতে লেখক আর নার্স বাদে আছে দশ বারজন কাজের লোক। রাতে তারা একতলায় আশ্রয় নেয়, তাঁদের হই হল্লা উপরে এসে পৌঁছয় না। বাড়িটা সারাদিন খাঁ খাঁ করে। নার্সকে লেখকের দেখভালের জন্য রাখা হয়েছে, যদিও দেখভালের কিছু নেই, লেখকের শরীর প্যারালাইজড হলেও এছাড়া তেমন কোন রোগ নেই।
তবুও নার্সটি দায়িত্ব ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে পারে না। লেখকের পরিবার নার্সের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা তিন তলাতেই করে দিয়েছে। এজন্য বাইরে যাবার যৌক্তিক কোন কারণ নেই।
লেখক রাগ করেন বলে প্রয়োজন ছাড়া চাকর বাকর তার সামনে আসে না। আশেপাশে কেউ থাকে না, নার্স কথা বলার জন্য ছটফট করে, লেখক উৎসাহ দেখান না।
তিনি হয়তো বা এটাও জানেন না যে নার্স তার লেখার দারুণ ভক্ত।
লেখক হঠাৎ বাইরে তাকাতে জানালার দিকে পাশ ফেরেন, তার হাতের শিরায় লাগানো নলটি খুলে যায়। নার্স দ্রুত গিয়ে লাগিয়ে দেয় আবার। তারপর পিছু হটে এসে সোফায় বসে। সোফার সামনে, লেখকের বিছানার পাশে একটা ছোট টেবিল, তার ওপরে ফলভর্তি একটা প্লেট, ফল কাটার ছুরি প্লেটের পাশে একটা সবুজ রুমালের ওপরে রাখা।
নার্সটি অন্যমনস্ক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আসলে সে ভাবে লেখকের কথা। মানুষ এমনও হয়! দারুণ সফল একজন মানুষ, যেখানে হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে। ব্যক্তিজীবনে আবার তিনি ততটাই বিতর্কিত। শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন, তার নিজে হাতে গড়া কোম্পানি এখন চারটে দেশে ব্যবসা করছে।
তিনটে বিয়ে করেছেন, একেকবার একেক বয়সের নারীকে। কারো সাথেই সম্পর্ক এক-দু বছরের বেশি টেকে নি, কিন্তু কাউকেই তিনি ডিভোর্স দেন নি। সবার ভরণপোষণ চালিয়েছেন।
ষাট পেরুতেই কি হল, সব ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে এই বাড়িতে আশ্রয় নিলেন, শুরু করলেন লেখালেখি। দ্বিতীয় বইয়েই বাজিমাত।
তিন বছরের মাঝে সমালোচকদের প্রিয় লেখকে পরিণত হলেন। বই বেরুতে লাগল একের পর এক, তার পাঠকসংখ্যা বাড়তে লাগল আস্তে আস্তে। আরও পাঁচ বছর পর জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করলেন। সমালোচকরা বলাবলি করতে লাগলেন মানিকের পর বাংলা সাহিত্যে এতটা প্রতিভাবান লেখক আর কেউ আসেননি। খ্যাতি, সম্মান, বিতর্ক - সব তার পিছু ধাওয়া করতে লাগল।
লেখালেখির ন' বছর পর হঠাৎ ঘোষণা দিলেন, বাংলা সাহিত্যকে তার যা দেবার ছিল তিনি দিয়ে ফেলেছেন, তিনি আর লিখবেন না। ভক্তদের হতাশ করে তিনি চলে গেলেন নির্বাসনে।
ক'মাস পর এক দুরারোগ্য ব্যাধি তার শরীরে ধরা পড়ল। পায়ের মাসল সব ধীরে ধীরে অবশ হয়ে গেল। নার্সিংহোম থেকে নার্স এলো দেখাশোনা করতে।
পাশাপাশি তার কাজ লেখককে সঙ্গ দেওয়া। অনেক মানুষ এলো লেখকের কাছে। পরিবারের সদস্য, শুভাকাঙ্ক্ষী, ভক্তের দল। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে সবাই চলে গেল, সারাদিন বৃদ্ধ এক লেখকের 'বোরিং' সান্নিধ্যে কেই বা থাকতে চায়! রয়ে গেল সেই নার্সটি।
সে প্রত্যেকদিন সকালে লেখকের পিঠে বালিশ গুঁজে হাতে পত্রিকা ধরিয়ে দেয়।
লেখক ক্ষীণ চোখে চশমা লাগিয়ে নার্সের দিকে তাকিয়ে হয়তো হাসেনও, কিন্তু নার্স ওই সময়ে খুব ভয় পায়। লেখকের চোখে জীবনের কোন অস্তিত্ব নেই, নার্সের মনে হয় মৃত একজন মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাজার চেষ্টা করেও নার্স তার অস্বস্তি লুকিয়ে রাখতে পারে না।
নার্সের মনের ভাব বুঝতে পেরেই হয়তো লেখক একদিন বিকেলে গম্ভীর স্বরে আদেশ দেন, 'এই মেয়ে, শোন, ড্রয়ারে একটা মোটা হলুদ ফাইল আছে, ওটা নিয়ে এস। ' নার্স আদেশ পালন করে।
ফাইল হাতড়ে লেখক একতাড়া কাগজ বের করে নার্সের দিকে বাড়িয়ে দেন, 'নাও, আমার আত্মজীবনী এটা। তুমি এর প্রুফ রিডিং কর। যথাযথ পারিশ্রমিক পাবে। '
নার্স কিছুটা ভড়কে গিয়ে কাগজগুলো নেয়। নেড়েচেড়ে দ্যাখে।
তারপর ঘুরে দাঁড়াতে যাবে এমন সময় তাঁকে চমকে দেন লেখক, 'আর হ্যাঁ, রাতে আমার দেখাশোনা করার দরকার নেই। তোমার ঘরে থাকবে, কিছু দরকার হলে আমি ডাকব। ঠিক আছে?' হতবিহবল নার্স মাথা নাড়ে। তারপর সোফায় বসে পাণ্ডুলিপি পড়া শুরু করে। লেখকের উদ্দেশ্য সে ঠিকই বুঝেছে, তাঁকে যুগপৎ একঘেয়েমি ও অস্বস্তি থেকে মুক্তি দেওয়া।
নার্স কৃতজ্ঞ বোধ করে।
তার দু সপ্তাহ পর, আজ, তার পড়া শেষ হল। নার্স একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
লেখক তখন পাশ ফিরেছিলেন বিরক্ত হয়ে। ঘড়িটা আবার নষ্ট হয়ে গেছে।
সেকেন্ডের কাঁটা প্রতি দুই সেকেন্ডে একবার করে নড়ছে। তার এখন সময়ের হিসাব রাখার কোন দরকার নেই। কিন্তু একটানা টিক টিক শব্দ শুনে শুনে সেটা মাথার ভেতরে কেমন ঢুকে গেছে। না শুনলে খালি খালি লাগে। যা হোক, লেখক জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন।
তিনতলা থেকে শহরটা খুব...খুব নিচু মনে হয়।
লেখকের বাড়ির সামনে একটা স্কুল আছে। বাচ্চারা হইচই করে বেরোচ্ছে। ছুটি হল মনে হয় কেবল। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন স্কুল নিয়ে একটা গল্পের প্লট বানাতে।
চারপাশে তাকান আর ভাবেন। স্কুলের বাচ্চাদের দল। বাইরে পার্ক করা গাড়ির সারি। স্কুলের সামনে একটা ঝাউ গাছ। কতগুলো ছেলে রাস্তায় মোটর সাইকেলের ওপরে বসে আড্ডায় মগ্ন।
চটপটি-ফুচকার দোকানে ভিড়। দূরে কোথাও চটকদার গান বাজছে.....
লেখকের হঠাৎ খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি চোখ বোজেন। না, যে পথ তিনি ত্যাগ করেছেন, তাতে কেন হাঁটা আবার? কেবলি...তার চিন্তায় বিঘ্ন ঘটে, লেখক সচকিত হয়ে ওঠেন। কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
তিনি চোখ খোলেন।
নার্স।
নার্স বলে, 'আপনি কেমন আছেন, স্যার?'
লেখক নার্সের এই হঠাৎ মমতায় কৌতুক বোধ করেন। তিনি বলেন, 'কেন এ কথা বলছ, বলো তো?'
'স্যার, আসলে আপনার মন খুব খারাপ, তাই না?'
এবার লেখক সত্যিই অবাক হন। তিনি দেখেন, নার্স থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।
বলেন, 'মেয়ে, কি হয়েছে তোমার, একথা বলছ কেন?'
নার্স প্রশ্নের উত্তর দেয় না। তার চোখ দুটো ঈষৎ বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে, কেঁপে কেঁপে শ্বাস নেয়। নাকের ফুটো ফুলে ওঠে। আবেগের দমকে সারা শরীর থরথরিয়ে ওঠে। সে কাঁপতে কাঁপতে বলে, 'আপনার জীবনে আপনাকে কেউ ভালোবাসেনি সেটা সত্য হতে পারে, কিন্তু আপনি নিজেকে কেন ভালবাসেন নি? এত ঘৃণা কেন আপনার? এতটা কষ্ট ভোগ করছেন কেন আপনি?'
বলতে বলতে মেয়েটি তার বাম হাত লেখকের হাতে রাখে।
তারপর ডান হাতে বেরিয়ে আসে ছুরি। টেবিলের ওপর সবুজ রুমাল তখন কেবলই সবুজ রুমাল, বাড়তি বিশেষণহীন।
তারপর লেখক কিছু বলার আগেই নার্স তার বুকে আমূল ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। লেখকের শরীর প্রচণ্ড একটা ঝটকা দেয়, নার্স বিষণ্ণ চোখে তার শরীরের পুরো শক্তি দিয়ে লেখককে বিছানার সাথে চেপে ধরে। প্রচণ্ড যন্ত্রনায় লেখকের মুখ বিকৃত হয়ে যায়, নার্স অবাক হয়ে দেখে, তাও সেখানে হাসির ক্ষীণ আভাস!
লেখক হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, 'জানো, পাণ্ডুলিপিটা এজন্যই লিখেছিলাম যেন একদিন কেউ এটা পড়ে, আর আজকের ঘটনাটা ঘটায়।
তোমাকে ধন্যবাদ, তুমি পেরেছো। '
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।