অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
আলোচনার টেবিলে অনেকগুলো প্রসঙ্গ জমা হয়েছে। সাহিত্যে লেখকের অবস্থান নিয়ে আলোচনার বিষয়টা অমীমাংসিত। সাহিত্য রচনায় লেখকের দায়বদ্ধতার প্রশ্নটা সামনে আসলেই সামাজিক মানুষের রাজনৈতিক চরিত্রের খোলসের অবলেপন ঘটে।
সাহিত্যচর্চা ঠিক তেমন অর্থে সামাজিক দায়স্খলনের পর্যায়ে পড়ে কি না এ নিয়ে তর্কে ঝাপিয়ে পড়া যায়। মানুষ কেনো সাহিত্যচর্চা করে বা কেনো মানুষের সাহিত্যচর্চা করা প্রয়োজন এ প্রশ্নেরও মীমাংসা হওয়া উচিত।
প্রেক্ষিতটা মোটেও সরল নয়। শুরুটে যেমনটা অনুমিত ছিলো মানে আমার নিজস্ব অনুধাবন যতটুকু-অন্যদের চেয়ে আলাদা বা স্বকীয়তার বাসনায় সাহিত্যচর্চার সূচনা হয় নি। কোনও রকম প্রশংসায় বিগলিত হওয়া বা প্রতিরোধের শঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয় নি। তেমন কোনো মঞ্চও ছিলো না যেখানে নিজেকে জাহির করতে হবে।
এসব ভির্জগতীয় প্রেষণার অনুপস্থিতিতে সাহিত্যবিষয়ক ভাবনায় আমার পারদর্শ ীতা বা বাগ্মিতার সুযোগ এবং এ বিষয়ক আলোচনার পরিসর স্বভাবতই কম।
এই মূহূর্তে কেনো লিখছি এ প্রশ্নের উত্তর একটাই হতে পারে, যদি কোনও ভাবে জানে যায় অন্যেরা কেনো লিখছে, সেসব উত্তর জেনে কোনটাকে নিজের কাছে গ্রহনীয় মনে হয় সেটা উপলব্ধির একটা সুযোগ পাওয়া যাবে।
প্রশ্নটা বা প্রশ্নগুলো সেভাবেই সাজানো হোক তবে-
প্রথম প্রশ্নটা অবশ্যই মানুষের শিল্পপ্রেষণার উৎপত্তি বিষয়ক। এর উত্তরটা সমাজবিজ্ঞানীরা যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা এই মুহূর্তে কতটা সমসাময়িক তা জানি না তবে জীবনের প্রয়োজনে বা শিক্ষার প্রয়োজনে এবং ইশ্বরের প্রতিসমর্পনের তাগিদ থেকেই বিভিন্ন ধরনের শ্লোক রচিত হচ্ছে, মুর্তি তৈরি হচ্ছে, হচ্ছে চিত্রাঙ্কন, হচ্ছে সংগীত সাধনা, নৃত্যপরা নারীরা দেবালয়ে নিজেদের নিবেদন করছেন। মানুষ সঙ্গমরত হচ্ছে দেবতার সম্মুখে- সবই আসলে একই ধরনের জীবনযাপনের ভেতরে নিজেকে ইশ্বরে সমর্পনের বাসনা। মানুষের শিল্পচর্চার অনুপ্রেরণা সূচনায় সমর্পন বাসনা ছিলো।
ঐশ্বরিক নৈবদ্য থেকে ক্রমশ বিমূর্তায়নে বর্তমানের সমাগ্রিক সভ্যতার মিথঃস্ক্রিয়ায় এই সমর্পন বাসনা কতটুকু প্রাধান্য পায় এটার নির্ণয় করবে কে? মুহাম্মদের কোরানের সাহিট্যগুন, রামায়ন মহাভারতের ভক্তিরসাপ্লুততা। সব সময় নির্দিষ্ট ধরনের শব্দ চয়নে কিংবা পরিবেশ তৈরি করে আমাদের আদর্শবাদীতা শেখায়। সাহিত্যের অন্যতম প্রেরণা যেহেতুঐশ্বরিক নৈবদ্যের কিংবা সমর্পনের পুর্বানুমান থেকে শুরু হচ্ছে তাই আদর্শবাদীতা সাহিত্যের একটা উপাদান চিহি্নত হয়েই থাকবে।
ইশ্বর বিশ্বাসের নিক্তিতে আমার অবস্থান যেখানেই হোক না কেনো ঐশ্বরিক প্রেষণায় রচিত সাহিত্য আমাকে মুগ্ধ করে। মানুষের প্রণত ভঙ্গি, মানুষের এই কোমল রূপ অন্যসব প্রাণী থেকে পৃথক করেছে মানুষকে।
মানুষ ভাববিনিময় কৌশলে উৎকর্ষতা লাভ করেছে বিধায় হয়তো এমন ভাবছি কিংবা আমাদের অসমর্থতা অন্য প্রাণীর ভাষা বুঝতে পারার এর কারন হতে পারে।
তাই আমাদের পূজনীয় প্রাণীকূলের শৈর্য্য, ধৈর্য্য, চাতুর্য এবং নৃশংসতা দিয়ে আমরা মানুষকে রূপায়িত করি। যদিও অক্লান্ত সঙ্গমের রূুপক খরগোশ তেমন জনপ্রিয় টোটেম না, শুধুমাত্র প্লে বয় ম্যাগাজিনের কভারে বা সে ম্যাগাজিনের কতিপয় ছবিতেই এই ভঙ্গি ধরে রাখা হয়েছে। সিংহ বাঘ চিতা এসব হিংস্র প্রাণীই পূজ্য। গাভী সর্বদাই শিষ্ঠতার প্রতীক, তেমন ভাবে গাধা কিংবা ছাগল নির্বুদ্ধিতার প্রতিরূপ।
এই রূপান্তর থেকেই কিংবা চেনা পরিবেশ না আবহ থেকে আরও বেশী সার্বজনীনতা দেওয়ার জন্যই সাহিত্য বিবর্তিত হচ্ছে। টম এন্ড জেরীর জেরী সর্বজনপ্রিয়। বলিষ্ঠের নাকাল হওয়ার যে তীব্র মর্ষকাম তা ক্রমাগত সরবরাহ করে যায় জেরী। এমন ভাবেই নাকাল হওয়ার কাহিনী ড্যারী কিংবা বানীর কার্টুনে। এমন অনেক অনেক কার্টুনের নাম চলে আসবে যা আমার উপভোগ করি।
তবে এদের ভিতরে আমার বিবেচনায় সবচেয়ে সামাজিক চরিত্র ডোনালড ডাক। তার ভেতরে আমি সব সময়ই চেনা মানুষের প্রতিরূপ খুঁজে পাই। এই যে প্রক্রিয়া এটাকে সার্বজনীনতা বলতে দ্্বিধা নেই। কখনও উচ্চাভিলাষি, কখনও সারল্য, কখনও নির্বুদ্ধিতা কখনও নিয়তির খেয়লার সাম্ভাব্য মৃতু্য থেকে পরিত্রান লাভ এসব ঘটনাগুলোর মনস্তাতি্বক অভিক্ষেপ কিরকম এটা গবেষনার বিষয় হতে পারে।
এভাবেই ডিজনী থেকে আমরা আদর্শ আহরন করি।
আমি নিয়মিত কার্টুন নেটওয়ার্কের দর্শক এখন। শুধু বয়সের কারনে এখন সেখান থেকে আলাদা কিছু আদর্শবাদ খুঁজে পাচ্ছি, আমার ছেলেও এটা গ্রহন করছে অচেতন ভাবে।
সাহিত্য পাঠককে আদর্শবাদ সরবরাহ করছে, এখন এই সরবরাহকৃত আদর্শের দায়ভারটা লেখন কতটুকু নিবেন এ নিয়েই আলোচনার সূচনা। সচেতনতা থাকলে সেই আদর্শ সরবরাহের সময় সামানউ কৌশলী ও বিবেচক হতেন লেখক। অচেতন লেখক যে আদর্শ সরবরাহ করবেন তা সেই প্রথাগত আদর্শ।
ওখান থেকে উত্তরণের জন্যই আবার বিকল্প কিছু আদর্শ প্রচারণা প্রয়োজন।
শ্রদ্ধেয় জলিল ভাই বলেছেন আদর্শাবদ চাপিয়ে দেওয়ার জিনিষ না, মানে লেখক কোনো ভাবেই পাঠকের উপর আদর্শ চাপিয়ে দিতে পারেন না, তবে এটা হয়তো তার অচিন্তিত মতামত. তেমন ভাবে না ভেবেই তিনি বলেছেন। রবিনসন ক্রুশো উপন্যাসের নায়কের সংগ্রাম, সংশয়, স্বনির্ভরতা কিংবা 56 হাজার বর্গমাইলের নায়কের আত্মবিশ্বাস এবং কলুষতা এবং এই বাস্তবতার উপলব্ধি কি আমাদের ভাবনায় জায়গায় নাড়া দেয় না। আমরা অবশেষে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। এবং আমাদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহনের যৌক্তিকতা বিচার করি- আমাদের নৈতিকতাবোধ সার্বক্ষনিক ক্রিয়াশীল।
দুরবীনের ধ্রুব এবং হুমায়ুনের হিমুর ভেতরের তফাতটা উপলব্ধি করলেই তিনি উপলব্ধি করবেন কিভাবে আদর্শবাদ মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে। উদাসীনতা বা খেয়ালীপনার নিক্তিতে এরা দুজন তুলনীয় হলেও বোধের জগতে এরা সম্পূর্ন ভিন্ন 2টা চরিত্র। এভাবেইর্চচরিত্র 2টার ভেতর দিয়ে লেখকের অবস্থানটাও আমরা জানতে পারি। প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতায় এরা সমতুল হলেও দুজনের ব্যাক্তিত্বের জায়গাটা ভিন্ন। হুমায়ুনের হিমুর দায়িত্বজ্ঞান হীনতার সাথে তার ব্যাক্তিত্বহীনতার মিশেল ঘটায় সে অনুকম্পার পাত্র।
সে এবং টার চারপাশের ঘটনায় যেভাবে লেখক ইশ্বরের মতো উপস্থিত হয়ে তাকে করুনা করেন তেমনটা নেই দুরবীনের ধ্রুবের জীবনে। এই যে করূনা এটা স্নেহ শব্দের প্রতিশব্দ হতে পারে না তবে স্নেহ শব্দটা ঠিক হিমুর চরিত্র চিত্রায়নে হুমায়ুনের আচরনের যথাযোগ্য প্রকাশ কতে পারে না।
ধ্রুবর দায়িত্বজ্ঞানহীন তবে ব্যাক্তিত্বহীনতা তার চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্য নয়। তবে শীর্ষেন্দুর নিজের ইশ্বরঅভুমুকখতা তার সাহিত্যের মূল সুর হয়ে ঊঠেছে, এখানেও ধ্রুবর চরিত্রে সেইসব ইশ্বর অভিমুখতা বা সামাজিক সচেতনতা বিদ্যমান। হিমু আর ধ্রুব এই 2টা চরিত্রের ভেতরের পার্থক্য সামাজিক সচেতনতার।
তবে পাঠক অনায়াসে এদের সাথে নিজেকে মেলানোর চেষ্টা করে যায়। এদের জীবনদর্শন আত্মস্থ করার চেষ্টা করে, এভাবেই লেখক তার আক্ষেপ, তার জীবনবোধ প্রচারিত করেন। অনেকটা চাপিয়েও দেন। লেখক দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে হিমুর মতো ব্যাক্তিত্বহীন চরিত্রটাকে করূনা না করে তাকে একটু ব্যাক্তিত্ববান করে গড়ে তুলতে পারতো হুমায়ুন, তা করলো না। নিজস্ব ব্যার্থতার জায়গাটা প্রকট হয়ে থাকে।
তার তরল ব্যাক্তিত্বের নায়কগুলোর তুলনায় তাদের বাবাদের ব্যাক্তিত্ব বেশী থাকে।
জেবতিক বলেছেন চেখভের উক্তিতে শুধু ধারাভাষ্য বর্ণনার দায়িত্ব নিয়ে পরিত্রানের চেষ্টা করা উচিত লেখকের। ধারাভাষ্যবর্ণনার জায়গাটাকেই প্রশ্ন করছি যখন তখন কি প্রকাশ্য আদর্শবাদের জায়গাটা আসবে কেনো?গ্র ীক ট্রাজেডীর বর্ণনার শৈর্য্যের অভাব না থাকলেও চরিত্রগুলো অদৃশ্য নিয়তির সুতোয় বাধা পুতুল। তারা সীমিত মানবীয় প্রচেষ্টায় যতটা যায় সেই অর্জন মুছে যায় দেবতার রোষে। এই যে নিয়তি নির্ভরতা এটা পাঠককে আলাদা একটা আদর্শবাদ শেখায়।
যদিও পরবর্তি গ্র ীক সমাজে ইশ্বর চেতনায় পূজোর বিষয়টা প্রাধান্য পায় নি তবে নিয়তি নির্ভরতার জায়গাটা মানুষের চেতনায় স্থিতু ছিলো আরও 1000 বছর। সক্রেটিসের বলি হওয়ার সময়ও এই নিয়তিবাদের সাথে যুক্তিবাদের সংঘর্ষও একটা উপাদান হিসেবে চলে আসে।
সচেতন বা অচেতন এই আদর্শবাদের রূপায়নের প্রেক্ষিতটা কোথায় কিভাবে শুরু হলো এটা কি নির্ণয় করা যাবে?
বক্তব্য পাঠকের কাছে পৌঁছাবেই। সেই শৈশবের রূপকথা দিয়ে যে আদর্শবাদী চেতনা গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় সেই সূচনাকে সামাজিক নীতিবোধ শিক্ষার প্রথম ধাপ বলা যায়। জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো, যদি তোমার ভেতরে আলো থাকে সে আলো পরিস্ফুটিত হবেই।
কুচ্ছিত হাঁসের ছানা নামক গল্পটা এখানেই সমাপ্ত হয়।
তবে কতিপয় সাহিত্যিক বিবর্তনবাদের প্রভাবে সামান্য বঙ্কিম পথ গ্রহন করেছেন। সেটার সূচনা ঠিক আদর্শবাদ প্রচারের অনীহায় সীমিত নেই। প্রশ্নটা আরও সরল- যদি বিবর্তনবাদ সঠিক হয় তাহলেও মানুষও একটা পশু। যদি অন্য সব পশুর জীবনে তেমন সামাজিক নিয়ন্ত্রন না থাকে সাহিত্যে কেনো থাকবে? এই মানুষকে দেখার অবস্থানটা সঠিক না ভুল এটার দার্শনীক মীমাংসা অসম্ভব।
সাপ তার লেজ খাচ্ছে, এ সাপের ভবিষ্যত নির্ধারনের জায়গায় গিয়ে কি সমাধান দেওয়া সম্ভব। ছাগল দেখলে মানুষ আশ্চর্য হয় না তবে যখন ছাগল 2 পায়ে দাঁড়িয়ে যায় সেটা দেখে খানিকটা আগ্রহ জাগে। পরবর্তিতে যখন ভাবনা পরিস্কার হয় তখন বুঝতে পারি অনুশীলনে সব সম্ভব। একজন দার্শনিক হিসেবে ফ্রয়েডের নাম তুলে আনার পর তেমন আগ্রহ হয়েছিলো এক 2 পায়া চাগলের দিকে।
যৌনতাবিষয়ক নীতিমালা দিয়ে যে সামাজিক অনুশাসনের সূচনা সেখানে আরও কিছু সামাজিক নীতিবোধ প্রবিষ্ট হয়।
ইশ্বরকল্পনা পুষ্ট হয়- পুরাণ কোরান রচিত হয়- মোহাম্মদ নীতিবাগীশ হয়ে মর্ত্যধামে বিচরন করেন। তার বাগ্মিতা নিয়ে সংশয় নেই। যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে দক্ষ বিপনন কর্মির মতো তার মুখ থেকে অমৃতভাষন নেমে আসে। সকল প্রশ্নের জবাব টিনি অনায়াসে দিয়ে যান,যা কিছু ব্যাখ্যাযোগ্য আর যা কিছু ব্যাখ্যাতীত সবই তার অসাধারন বাগ্মিতায় বিক্রিত হয় - সময়ের সাথে বিকৃত হয়। ( এটার সমাধান শাফিক রাহমান কিভাবে করবেন তা জানার আগ্রহ আছে।
কৃকেট এবং ক্রিকেট এক হলেও বিক্রিত আর বিকৃত ঠিক একই অর্থ বহন করে না)
তার কামোত্তেজনা আর কাম সংবরন, তার আসঙ্গলিপ্সা তার রমন সবই প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় পঠিত হয় ইবাদত হিসাবে।
অবশেষে অবশিষ্ট থাকে যা টা হলো প্রশান্তি। আমরা এই দীর্ঘ আলোচনায় একটা পরিসমাপ্তিতে আসি। প্রশন্তির জায়গাটাকে চিহি্নত করার পর দায়বদ্ধতা শব্দটাকে তেমন ভীতিপ্রদ মনে হয় না। যা কিছু মানসিক প্রশান্তি হরন করে তাই বিতর্কিত সাহিত্য হয়, তাই নতুন সামাজিক নীতিমালার সূচনা করে।
তাই বিকল্প আদর্শবাদের পরিসর তৈরি করে। এভাবেই আমরা চুঁড়া থেকে অধঃপতিত হয়ে আবার স্রোতের শীর্ষে জেগে উঠি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।