আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেন্ট মার্টিনস্ এ আমার ঝটিকা সফর....

আমার এক জুনিয়র ফ্রেন্ড মালয়েশিয়ায় জব করে। ছুটিতে দেশে আসলে ঢাকার বাইরে একটা শর্ট ট্রিপ দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়। ২০১০ এর নভেম্বরও এরকম একটা ট্রিপে ঠিক হলো এবার সেন্ট মার্টিনস্ যাবো। তার তো আগ্রহ আছেই, সেন্ট মার্টিনস্ এর প্রতি আমারও অনেক আগ্রহ কারন অনেকবার কক্সবাজার গেলেও তখন পর্যন্ত সেন্ট মার্টিনস্ যাওয়া হয়নি। ২৬ তারিখে সিদ্ধান্ত নিয়ে, ২৭ তারিখ সকালে তা চুড়ান্ত করে রাতের বাসের টিকিট কেটে, শেষ মুহূর্তে বাসায় জানানোর জন্যে ঝাড়ি খেয়ে, নির্দিষ্ট সময় বাসে চাপলাম।

পরদিন ভোরে চট্টগ্রাম পৌছালাম। বাস স্ট্যান্ডেই একটা দোকানে নাস্তা করে কক্সবাজারের বাসে চড়লাম। প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে বেশ আরামেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু পথে কোথায় জানি বাস বদল করে ছোট একটা ভাঙ্গা বাসে টেকনাফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। টেকনাফ পৌছালাম দুপুর দুইটারও পরে। টেকনাফ থেকে তিনটা সি-ট্রাক প্রতিদিন সেন্ট মার্টিনস্ যাওয়া আসা করে, কিন্তু তিনটাই সকাল নয়টায় টেকনাফ থেকে রওনা হয় আর বিকাল তিনটায় সেন্ট মার্টিনস্ থেকে ফিরতি যাত্রা করে।

আমাদের সময় সল্পতার কারনে পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আমার প্রবল অনিচ্ছা থাকলেও সেই দিনই ট্রলারে করে যাওয়া স্থির করলাম। আমাদের থেকে অনেক বেশি ভাড়া নিয়ে (জনপ্রতি ২০০/২৫০ টাকা নিয়েছিলো) আমাদের ছোট্ট একটা ট্রলারে উঠিয়ে দিলো। অনেক মালামালের ফাঁকে কোন রকমে ট্রলারের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ভয়ে ভয়ে বসে পড়লাম (সমুদ্রে আমার খুবই ভয়, খালি মনে হয় এই বুঝি নিচ থেকে একটা বিশাল দানো এসে আমাকে কপ্ করে আস্ত গিলে ফেলবে ) । ট্রলারটা দুলতে দুলতে ভালোই চলছিলো। ভয় কাটানোর চেষ্টায় প্রকৃতির শোভা উপভোগে যখন মাত্র মনোযোগী হয়েছি তখনই ট্রলার নদী থেকে সাগরে পড়লো আর তার দুলুনীও অনেক বেড়ে গেলো।

সলীল সমাধি নিশ্চিত ধরে নিয়ে আমি যখন শুকনো মুখে শক্ত হয়ে বসে আছি তখনি আমাদের ট্রলারটা চলা বন্ধ করে দিয়ে ঢেউয়ের তালে আপন মনে প্রবল দোলা শুরু করল। ইঞ্জিন চলছে, অথছ ট্রলার চলছেনা- ব্যপারটা মাঝিকেও কিছুক্ষনের জন্য হতবুদ্ধি করে দিলো। মাঝির এক সহকারী সাগরে নেমে তদন্ত শেষে জানালো যে, ইঞ্জিন প্রপেলার খুলে পড়ে গেছে !!! এই বিপদের মাঝে আমার শুকনো মুখ দেখে পাশের এক সহযাত্রী হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, ”ভয় পাচ্ছেন?” ভয় আমার রাগকে বাড়তে দিলোনা; আমিও (শুধু ভদ্রতার খাতিরেই) পাল্টা হাসি দিয়ে “হ্যাঁ” বললাম। ততক্ষনে আমাদের মাঝি মোবাইলে কাছাকাছি থাকা আর একটা ট্রলাকে সাহায্যে আহবান জানিয়েছে। প্রায় দশ-পনের মিনিট সাগরে নিঃশ্চল অবস্থায় ভয়াবহ দোল খাবার পর উদ্ধারকারী ট্রলার এসে আমাদের ট্রলারকে টানতে টানতে যখন সেন্ট মার্টিনস্ পৌছে দিলো সূর্য তখন প্রায় অস্তগামী।

ডাঙায় পা রেখে আমি আর কোনদিন এতো আনন্দ পাইনি। যাই হোক, একটা পরিচ্ছন্ন দেখতে হোটেলে উঠে গোসল শেষে কাছের একটা খাবার হোটেলে রাতের খাওয়া সেরে দ্বীপের ছোট্ট মার্কেট (!!! অল্প কিছু দোকানের সমষ্টি আর রাতের বেলা সবচেয়ে আলোকিত ও জনসমাগম অঞ্চল) ঘুরে দেখে অন্ধকার জেটিতে তারাদের নিচে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে এসে ঘুম দিলাম। পরদিন ভোরে আলো ফুটতেই হেঁটে হেঁটে ছেঁড়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। ভোরের নরম আলোয় সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে খুবই ভালো লাগছিলো। আমার বন্ধুটার ছবি তোলার শখ থাকায় আমাদের চলার গতি কম ছিলো।

মাঝে সূর্যদয় দেখার জন্য কিছুক্ষন যাত্রা বিরতি করলাম। প্রায় দুই ঘন্টা হেঁটে ছেঁড়া দ্বীপে পৌছালাম। ভেজা বালিতে হাঁটতে ভালো লাগে বলে স্থানীয়দের নিষেধ সত্ত্বেও আমি খালি পায়ে ছিলাম। ছেঁড়া দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছাতেই নিজের এই হঠকারীতার মাশুল দেয়া শুরু করতে হলো। ধারালো প্রবাল ঠিকমত হাঁটা কষ্টকর করে দিলো।

প্রবালের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ছেঁড়া দ্বীপের শেষ সীমায় যাওয়া হলোনা আমার। খালি পায়ে যতটা সম্ভব ঘুরে দেখলাম। এক জায়গায় ছোট্ট একটা (চার ফিট বাই পাঁচ ফিট মতন) প্রাকৃতিক চৌবাচ্চা দেখে তাতে নামার খুব শখ হলেও সাথে বাড়তি কাপড় না থাকায় নামলাম না। তবে ছেঁড়া দ্বীপ ছেড়ে আসার পর সেজন্য খুবই আফসোস হয়েছিলো। ( ) যাই হোক, ঘোরাঘুরি শেষে সাগরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন বালুতে বসে থাকলাম।

সেন্ট মার্টিনস্ এর বিশাল ডাবের মিষ্টি পানি খেয়ে যখন আবার সেন্ট মার্টিনস্ ফিরে আসার চিন্তা করছি তখন দুইজন জেলে তাঁদের থেকে মাছ আর কাঁকড়া কিনে খাওয়ার অনুরোধ করলো। তাঁদের কাউকেই মনঃক্ষুন্ন করতে চাইলাম না। তাই একজনের থেকে একটা মাছ ভাজা আর অন্য জনের থেকে চা খেলাম। মাত্র ধরে আনা মাছটা খেতে খুবই ভালো লেগেছিলো। খাওয়া শেষে একটা ছোট্ট ইঞ্জিন বোটে ছেঁড়া দ্বীপ থেকে আবার সেন্ট মার্টিনস্ ফিরে আসলাম।

ততক্ষনে দুপুর হয়ে গেছে। সেদিনই সেন্ট মার্টিনস্ থেকে ফেরার ইচ্ছা থাকায় আমরা সি-ট্রাক এর টিকেটের খোঁজে বের হলাম। আমার বন্ধুটার আবার ট্রলারে চাপার ইচ্ছা থাকলেও আমি “সেন্ট মার্টিনস্ এ থেকে যাবো তবুও ট্রলারে করে ফিরবোনা” বলার পর সি-ট্রাকে করে ফেরার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। আমাদের সহজ-সরল পেয়ে আবারও টিকেটের দাম বেশি রাখলো। টিকেট কেটে এসে আমরা হোটেলের বিল শোধ করে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে আসলাম।

অন্য একটা হোটেলে লাঞ্চ করে সি-ট্রাকে উঠলাম। আমাদের বেশ অবাক করে দিয়ে ঠিক তিনটায় সি-ট্রাক টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা করলো। আয়েশ করে বসে সি-ট্রাকের হালকা দোলায় দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের বেসামাল হয়ে যাওয়া দেখে মনে মনে বেশ হাসছিলাম। নিরাপদে এবং নির্ভয়ে ( ) টেকনাফ পৌছে একটা দোকানে বনরুটি আর চা খেয়ে আমরা চট্টগ্রামের বাসে চড়লাম। রাত বারোটারও পরে চট্টগ্রাম পৌঁছে হোটেল "গোল্ডেন ইন" চেনে এমন একজন রিকশাওয়ালা খুঁজে বের করলাম।

(শুনেছিলাম অল্প খরচে এই হোটেলটা মোটামুটি ভালো, এতো রাতে হোটেলের খোঁজে ঘুরতে ইচ্ছা করলোনা)। হোটেলে পৌছে গোসল করে ঘুম দিলাম। সকালে উঠে আশেপাশে একটু ঘুরে একটা হোটেলে নাস্তা করে রেল স্টেশনে গেলাম। ঢাকাগামী কোন ট্রেনের টিকেট না পেয়ে রাতের বাসে টিকেট করলাম। তারপর ফয়েজ লেক গেলাম।

প্রথমে সেখানের ছোট্ট চিড়িয়াখানা দেখলাম। এরপর আমার ফ্রেন্ডটার একটা ফ্রেন্ড দেখা করতে আসলো। তিনজনে লাঞ্চ করে নৌকায় লেকে ঘুরলাম কতক্ষন। সন্ধার আগে লেক থেকে ফিরলাম। আমার ফ্রেন্ডটাকে তার ফ্রেন্ডটার সাথে রেখে আমি আমার দুই আত্মীয়ের সাথে দেখা করে আসলাম।

তারপর বাসে উঠে দুই ঘুমে (চট্টগ্রাম টু কুমিল্লা আর কুমিল্লা টু ঢাকা) ভোরের আগেই ঢাকা পৌছে গেলাম। বাস স্ট্যান্ড কিছুক্ষন অপেক্ষা করে আলো ফুটলে সিএনজি চেপে বাসায় চলে আসলাম। । । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।