আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেন্ট মার্টিন



যাদের পাহাড় সম্পর্কে দুর্বলতা আছে, তাদের মন নাকি সমুদ্র টানে না। আবার সমুদ্রবিলাসীরা নাকি পাহাড়চূড়ার মাঝে সৌন্দর্যের খোঁজ পায় না। কিন্তু তা বুঝব কেমন করে? সেটা বোঝার জন্য পাহাড় আর সমুদ্রের কাছে না গিয়ে তো উপায় নেই। তবে তার খোঁজটা চলুক না কেন? বিতর্ক হচ্ছে সমুদ্র দেখতে কক্সবাজার, নাকি সেন্টমার্টিনস? মনটা যদি সমুদ্র কাব্যে ভাবুক হয়ে থাকে, তবে কক্সবাজার আর সেন্টমার্টিনস যেখানেই হোক না কেন, সোজা চলে যাবেন। তাই হয়তো সমুদ্র দেখলেই সবকিছু ভুলে তার মাঝে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করে নিজেকে।

মানুষ এ জন্যই ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পার হয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকে আশ্চর্য সুন্দর প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনসে ছুটে যায়। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের শেষ স্থলভাগ বদরমোকাম থেকে দক্ষিণ ১২ কিলোমিটার দূরে সাগরের বুকে সেন্টমার্টিনস। মিয়ানমার উপকুল থেকে পশ্চিমে সোজাসুজি এর দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার। আর টেকনাফ থেকে যাওয়ার পথে পার হতে হবে দক্ষিণ নয় কিলোমিটার। কক্সবাজার বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন সকাল সাতটায় টেকনাফের বাস ছাড়ে।

ভাড়া জনপ্রতি ৬০ থেকে ১০০ টাকা। পথটুকু মাইক্রোবাস বা প্যাকেজ ট্যুরের মাধ্যমেও যাওয়া যায়। স্থানীয় প্যাকেজগুলোয় ৬০০ থেকে ২০০০ টাকা অবধি খরচ পড়বে। টেকনাফের সরু পাহাড়ি পথ উঁচু-নিচু, এঁকেবেঁকে চলে গেছে। যেতে যেতে চোখে পড়বে ছোট-বড় টিলা ও পাহাড়।

সেই টিলার মাঝেমধ্যে আদিবাসী মানুষ, তাদের জীবনযাত্রা আমাদের মতো শহুরে মানুষের জীবনের হিসাবনিকাশ ভুল করিয়ে দেয়। আগে সেন্টমার্টিনসে যাওয়া ছিল রীতিমতো ঝক্কি-ঝামেলার। সাগর পেরোতে হতো ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে। এখন বেশ কিছু জাহাজ বন্দরে অপো করবে আপনার জন্য। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রওনা দেয় সি-ট্রাক, কেয়ারি সিন্দাবাদ, ফারহিন ও কুতুবদিয়া নামের জাহাজগুলো।

১০টার দিকে পাওয়া যাবে জাহাজ ঈগল। আসা-যাওয়ার ভাড়া ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা। জাহাজে উঠে মনে হবে সবুজ পাহাড়, আসমানি আকাশ আর নীল সমুদ্র জড়াজড়ি করে ভূস্বর্গ তৈরি করে রেখেছে। ভেঁপু বাজিয়ে জাহাজ রওনা হবে দ্বীপের পথে। অবাক করে দিয়ে সঙ্গী হবে একঝাঁক সামুদ্রিক নাম না জানা পাখি।

জাহাজের সঙ্গে যেন এক দৌড়ের পাল্লা। পাখিগুলো কিসের খোঁজে যেন জোরে উড়ে গিয়ে জাহাজের ডেকের কাছে চলে আসে। তারপর গতি কমিয়ে আবার পেছনে পড়ে যায়। কিছুণ পর বোঝা যাবে স্রোত কেটে যাওযার পথে জমে থাকা মাছের ঝাঁকের জন্য পাখিগুরো চলছে জাহাজের পথ ধরে। সাগরতলের ভিত শিলার উত্তানের ওপর এই সেন্টমার্টিনস প্রবাল দ্বীপের ভিত্তি।

দ্বীপের পশ্চিমে সাগরে ডোবা একটি প্রবাল প্রাচীর আছে। প্রাচীরটি নাকি মালয়েশিয়া উপকুলের প্রবাল প্রাচীরের অংশ। হঠাৎ দেখবেন টেকনাফের সঙ্গে জুড়ে আছে নাফ নদী। সেই নাফ নদী এসে মিলেছে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে। নদী আর সাগরের মিলন নাকি বেশ চোখে পড়ে।

আসলেই তাই। খানিক বাদে লম্বা ভোজবাজির মতো চোখে পড়বে সাদা স্রোতের এক সরলরেখা। তার এক পাশে জলের রং গাঢ় নীল। অন্য পাশে বইছে হালকা নীল-বাদামি-ঘোলাটে জল। নীল জল হলো সাগরের আর ঘোলাটে জলের নাফ নদীকে রেখে জাহাজ এগিয়ে যাবে নীল জলে।

এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে যাবে মন। চলতে চলতে আরও চোখে পড়বে নির্দিষ্ট দূরত্ব করে বেশ কিছু নৌকা জাল পেতে রেখেছে। এগুলো মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জেলেদের মাছ ধরা নৌকা। নদী ও সমুদ্র দুটি সীমান্ত ভাগ করা আছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য; এটি বোঝার উপায় নেই। কিন্তু স্থানীয় মাঝিরা নাকি দিব্যি সেই সীমান্ত আলাদা করতে পারে।

সমুদ্রের সঙ্গে মানুষের এখানেই নাকি নিবিড় নীরব দোস্তি। কপাল ভালো থাকলে সাগরপথে চোখে পড়বে শুশুক কিংবা লইট্যা মাছ। তবে চোখ হতে হবে অনুসন্ধিৎসু। আড়ই থেকে তিন ঘন্টা পর পৌঁছে যাবেন সেন্টমার্টিনস। দ্বীপখানা উত্তর-দক্ষিণ লম্বা।

জিঞ্জিরা, গলাচিপা, দক্ষিনপাড়া, ছেরাদিয়া দ্বীপগুলো মিলে সেন্টমার্টিনস। বিশাল সমুদ্রসৈকত। সৃষ্টিকর্তা অকৃপণভাবে সুন্দরের প্রাচুর্যকে জুড়ে দিয়েছেন দ্বীপটির সঙ্গে। রোদের আলোয় ঝিলমিল করে নীল জলরাশি। সহস্র নারিকেলগাছ হেলে আছে এলোমেলো।

হয়তো দেখবেন মাছধরার নৌকাগুলো নোঙর ফেলে অলস ভঙ্গিতে পড়ে আছে। আর সাগরপাড়ের প্রবালপাথর এদিক-সেদিক পড়ে আছে। ভুল করে বারবার এ সৌন্দর্যকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করবে। সাগরের এই সৌন্দর্য একেক সময় একেক রকম। সকালের সূর্যোদয়ের সময় আকাশ আর সমুদ্রের অসংখ্য রঙের বিচ্ছুরণ সূর্যাস্তের সময় অন্য এক রূপ ধারণ করে।

দুপুরে সমুদ্রের অন্য এক চরিত্রায়ণ। রাতে সে ধারণ করে আরেক রূপ। সেন্টমার্টিনসে রাতটা থেকে গেলে সুযোগ থাকে ছোঁড়া দ্বীপ যাওয়ার। এই দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন ছেঁড়া দ্বীপে কোনো জনবসতি নেই। কিন্তু মনোমুগ্ধকর ঐশ্বরিক সৌন্দর্য যেন উপচে পড়ে ছেঁড়াদ্বীপে।

সবুজ কেয়াবন, অজস্র ঝিনুক, শামুক পড়ে থাকা বেলাভূমি, এলোমেলো প্রবাল পাথর দুই পাথরের মধ্যে জমে থাকা পানিতে রংবেরঙের মাছ, কাঁকড়া সবকিছু আপনার পা দুটোকে করে রাখবে আড়ষ্ট, চোখ দুটোকে করবে অপলক। মনের মাঝে চলবে এক অসম্ভব আন্দোলন। সেই অনুভূতি প্রকাশের কোনো শব্দ নেই। ছেঁড়াদ্বীপ ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করে না। ছেঁড়াদ্বীপে যাওয়ার জন্য সেন্টমার্টিনস থেকে আছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও ছোট ট্রলার।

দল বেঁধে বড় জলযান নিলে খরচ পড়বে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা। যেতে সময় লাগবে আধঘন্টা। আবার জোরকদম চালিয়ে দেড়-দুই ঘন্টা পথ পাড়ি দিলেও সেন্টমার্টিনস থেকে ছেঁড়াদ্বীপে পৌঁছানে যাবে। তবে জোয়ার-ভাটার সময়টা মাথায় রাখতে হবে। সেন্টমার্টিনসের অধিবাসীরা প্রায় সবাই জেলে।

শুঁটকি তাদের প্রধান ব্যবসা। দ্বীপের রাস্তা ধরে ঘুরতে বের হলে বিশাল এলাকাজুড়ে জাটকাসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি চোখে পড়বে। এখানে প্রায় ৪০ জন মাঝির শুঁটকি রয়েছে। সেন্টমার্টিনসে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, ব্যাংক, পেস্ট অফিস, থানা-ফাঁড়িসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে। দ্বীপের সমুদ্রঘেঁষে একপাশে আছে কচ্ছপের হ্যাচারি।

ধীরে-সুস্থে প্রায় এক ঘন্টায় পুরো দ্বীপ বেড়িয়ে আসা যাবে। বাজারের কাছে ছোট ভ্যানগাড়িতে পুরো দ্বীপ বেড়িয়ে আসতে লাগবে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। দ্বীপটি জমজমাট থাকে মাঝরাত অবধি। দিনে এসে দিনে যেতে চাইলে তাড়াতাড়ি করে খেয়ে সমুদ্রসৈকতে যেতে হবে। কারণ বেলা তিনটায় সব জাহাজ টেকনাফের উদ্দেশে রওনা দেয়।

আর শতভাগ সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে চাইলে থেকে যেতে পারেন। পর্যটকদের সেই সুবিধা দেওয়ার জন্য বেশ কিছু হোটেল গড়ে উঠেছে। স্থানীয় লোকজনের কাছেই প্রাসাদ প্যারাডাইস, হোটেল অবকাশ, শ্রাবণী, প্রিন্স হেভেন, ব্লু মেরিন, সি-ভিউসহ বিভিন্ন হোটেলের খবর পেয়ে যাবেন। ভাড়া পড়বে মৌসুম অনুযায়ী এক হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।