আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেন্ট মার্টিন দর্শন--২


দ্বিতীয়বার সেন্ট মার্টিন যাওয়া হল ২০০৮ সালের জানুয়ারী মাসে। পরিবারের ক'জন সদস্য মিলে যাওয়া। আমার প্রবাসী বড় ভাই এবং ভাইঝি কে বেড়াতে নেয়ার জন্য বড় দুলাভাই কক্সবাজার সেন্টমার্টিন যাত্রার উদ্যোগ এবং স্পন্সর করলেন। জানুয়ারী থেকে মার্চ আমার কাজের চাপ একটু কম থাকাতে আমিও এ যাত্রায় সঙ্গী হতে পারলাম। আমি আগে হৈ চৈ শুরু করলাম সেন্টমার্টিনে রাতে থাকতে হবে, সে ব্যবস্থা যেন করা হয়।

দুলাভাই সেরকম ব্যবস্থাই করলেন। এবারে আবার ছোট্টকন্যাটিও আমাদের ভ্রমনসঙ্গী। বেশ তোড়জোড় সহকারে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। ঢাকা থেকে কক্সবাজার ভালভাবেই পৌঁছলাম, রাতে সাগরে গেলাম, আকাশে চাঁদ ছিল না তাই শুধু ঢেউয়ের গর্জন ছাড়া কিছু দেখা গেল না। তারপরও আমরা সাগরে পা ডুবিয়ে খানিক্ষণ হাটলাম, আমার কন্যা জাফনা বীচ চেয়ার গুলোতে সোয়েটার টুপি পড়ে চুপচাপ বসে রইল।

রাতে হোটেলে থাকা হল। সেন্ট মার্টিনে যাবার এবং থাকবার সব ব্যবস্থা আগে থেকে ঠিক করে রাখা ছিল। খুব ভোরে উঠে গোছগাছ এবং নাস্তা সেরে আমাদের গাইডের আনা মাইক্রোবাসে চড়ে টেকনাফের উদ্দেশ্যে চল্লাম, আমাদের পরিবারের গ্রুপ ছাড়া আরো একটি প্রবাসী পরিবার এই সফরে সঙ্গী হল। টেকনাফ পৌঁছানোর পথে আমাদের গাড়ীর কিছু সমস্যা হল, যার ফলে পৌঁছাতে দেরী হল। এদিকে সী ট্রাক ছেড়ে দেয় সময় হলেই।

আমাদের গাইড খুবই চিন্তিত, বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করছিল। নির্ধারিত সময়ের ৫/১০ মিনিট পরে আমরা পৌঁছলাম। আগে থেকেই সবই গুছিয়ে রেডি। গাড়ী থেকে নেমে সব আক্ষরিক অর্থেই ছুটলাম, সীট্রাকে উঠতে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়, সেই পথ ধরে। আমার কন্যা আগে আগে ছুটলো।

হুড়োহুড়ি করে উঠার পরপরই ছাড়লো সী ট্রাক। আমাদের সীট খুজে নিয়ে ব্যাগ রেখে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ালাম। মিষ্টি মিষ্টি শীতের সকালে আমরা চলেছি সেন্টমার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে, বড় ভাই ভিডিও করছেন আর বর্ণনা করে চলেছেন। অনেক দিন আগে দেখা এ পথ, তবু মনে হল নতুন। যতক্ষন দু'পাড়ের অস্তিত্ব দেখা যায় ততক্ষন এ বারান্দা ও বারান্দা ঘুরে ঘুরে দেখা হল।

মোহনায় আসবার পর চারদিকে শুধু পানি, তখন ভিতরে এসে বসলাম। কিঞ্চিত খাওয়া দাওয়া হল। প্রায় ঘন্টা খানেক পর দুর থেকে দেখা গেল দ্বীপের ক্ষীণ আভাস। সবাই উৎস্যুক হয়ে দেখছে দ্বীপটিকে। একসময় সব প্রতীক্ষার শেষ হল, আমরা দ্বীপের মাটিতে পা রাখলাম।

হোটেলে যাবার জন্য ভ্যান পাওয়া কঠিন হবে তাই আমাদের গাইড তাড়া দিল আগে হোটেলে চলেন তারপর আশেপাশে দেখবেন। একেবারে বীচ লাগোয়া হোটেলে যেয়ে দেখা গেল, আগের দিন যারা ছিলেন তারা এখনো রুম ছাড়েন নি। যে সী ট্রাক আমাদের সেন্টমার্টিন পৌঁছে দিল, সেটাই আর আধ ঘন্টা পর এঁদের নিয়ে টেকনাফ চলে যাবে। কাজেই আমরা হোটেলের বারান্দায় বসে প্রবাল দ্বীপের প্রবাল, আর ঢেউ দেখতে লাগলাম। অসম্ভব সুন্দর লাগছিল দুর থেকে সাগরকে, যদিও তখন ভাটা তাই প্রবালগুলো সব দৃশ্যমান, সাগর তখন অনেকটাই দুরে।

একটি রুম গোছানো হলে সেটাতে সবার ব্যাগ রেখে আমরা ছুটলাম সাগরের পানিতে। আমার মেয়ে তো মহা খুশি, ভেজা বালির উপর খালি পায়ে হাটছে। আমি ওকে কোলে নিয়ে বেশ খানিকটা ভেতরে যেয়ে পানিতে বসিয়ে দিলাম, সে পানিতে নামবে না। বেশ সমস্যায় পড়লাম। বেলাভূমিতে ওকে একা রেখে সাগরে নামাও যাচ্ছে না, আবার সাগরে নামবো না তাই বা কি করে হয়।

ঐ সময়টায় জাফনার ছিল খুব কাপড় ধোয়ার শখ, আমি তাকে একটা প্রবালের কাছে বসিয়ে বললাম, তোমার জামাটা এটার উপর নিয়ে কাঁচো আর এই পানি দিয়ে ধুতে থাকো। আর আম্মু না আসা পর্যন্ত কোথাও যাবে না। সে রাজী, প্রবল উৎসাহে এবং গভীর মনযোগের সাথে তার কাপড় কাচা এবং ধোয়া চলল। অনেক ট্যুরিষ্ট এটা দেখে বেশ মজা পেয়েছিল, ফেরার দিন অনেকেই জাফনা কে জিজ্ঞেস করছিল তোমার জামাটা এনেছ তো! আমি আর ভাইঝি সাগরে নামলাম, চারদিকে প্রবাল, সাবধানে যেতে হচ্ছে কারণ কিছু কিছু প্রবাল বেশ ধারালো, কয়েকবার পায়ে খোঁচা খেলাম। আমরা অনেকখানি ভেতরে চলে গেছি, এক সময় ওকে বললাম আমি কিন্তু সাঁতার পারি না, আর আমার ব্যালেন্স খুব কম, পড়তে গেলে তোকে ধরে থাকবো।

ও বলে ফুপি এইটা কি বললা আমি তো তোমার ভরসায় আসছি আমার নিজের ও ব্যালেন্স কম। কেবল জোয়ার আসছে পানি ধীরে ধীরে বাড়ছে, কাজেই আর ভিতরে না যেয়ে ওখানে থাকাই স্থির করলাম। অনেকক্ষন সাগরে থেকে মেয়ের জন্য উঠে এলাম। তারপর বিকেলে আবার ঘুরতে বের হলাম। বিকেলে ছিল ভরা জোয়ার তবে বেশ ঠান্ডা বাতাস, দুপুরে না ডুবিয়ে বিকেলে ডুবানো ভালো ছিল এরকমই মনে হল।

আমরা সূর্যাস্ত দেখার জন্য বেলাভূমি দিয়ে হাটাহাটি করলাম। একসময় সূর্যটা লাল হল তারপর টুপ করে সাগরে ডুব দিল। এসময়টা এত মন কেমন করা, উদাস উদাস, অথচ ভীষণ রোমান্টিক। সবাই যার যার মত বিমুগ্ধতা নিয়ে সূর্য ডোবা দেখলো, কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই যার যার আপন ভুবনে মগ্ন।

সূর্যদেবের অন্তর্ধানের পর আধো আলো তে পথ চিনে চিনে নিজ ডেরায় ফিরে এলাম আমরা। জাফনা হাটতে চায় না, ওকে কোলে নিলেন দুলাভাইয়ের অফিসের এক কলিগ, আর আমি বাঁচলাম। হোটেলে জেনারেটর চলছে। অন্য একটা গ্রুপ ছিল আমাদের হোটেলে, বেশ মজা করছিল তারা, হৈচৈ, গান বাজনা। উপরে বসে শুনছিলাম।

সন্ধ্যায় একপ্রস্থ মাছ ভাজা আর মোগলাই খাওয়া হল। এরপর আমারা দুজন (ফুপু ভাইঝি) বের হলাম। কন্যাকে বড়দের জিম্মায় রেখে। আকাশে চাঁদ নেই। নিকষ কালো অন্ধকার চারদিক।

আমাদের হাতে কোন টর্চনেই, মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনটা দিয়ে আলো ফেলে পথটা দেখে নিচ্ছিলাম। বেলাভূমিতে বসলাম, উপরে আকাশ দেখে আমিতো থ। লক্ষ কোটি তারা আকাশে, সারাটা আকাশ জুরে তারা আর তারা। আনন্দে পাগল হয়ে যাবার মত অবস্থা। জোৎস্না নেই বলে কিছুক্ষন আগেও যে আক্ষেপ টা ছিল সেটা চলে গেল বরং নিজেকে ভাগ্যবান মনে হল, নইলে এমন তারা ভরা আকাশ আমার জীবনে আর দেখা হত না।

আমি মফস্বলে অনেক থেকেছি, ঢাকার আকাশের চেয়ে গ্রামের আকাশে তারা বা জোৎস্না দুটোই ভীষণ প্রাণবন্ত; তবে কোনটাই আজকের রাতের মত নয়। এত সুন্দর মেঘহীন তারাভরা আকাশ, অজান্তেই গান চলে এল কন্ঠে। একের পর এক পান গাইছি, আনন্দ বা কষ্ট প্রকাশের জন্য এছাড়া আর কোন মাধ্যম আমার জানা নেই। নাচতে জানলে হয়তো নাচতাম। অনেকক্ষন পর ভাবলাম হাটি, আমরা অনেক হাটলাম, গান গাইলাম।

মন প্রান ভরে উপভোগ করলাম অন্ধকার রাতে সাগরের বিশাল প্রাণশক্তিকে, হিমহিম শীতল বাতাসকে, আকাশের অসম্ভব সুন্দরকে। বেঁচে থাকাটা আসলেই কি সুন্দর। অনেকটা সময় পর আমরা ফিরে এলাম। রাতের খাবার খেয়ে ঘুম। হোটেলে রাত এগারোটায় জেনারেটর বন্ধ হয়ে যাবে তাই প্রতি রুমের সামনে একটা করে হারিকেন দিয়ে গেল।

আমরা ভোরে উঠে সূর্য ওঠা দেখবো এমন প্লান করে ঘুমাতে গেলাম। ভাইঝি টা ভীষণ খুতখুতে, হোটেলের বিছানা তার নোংরা মনে হতে লাগলো, সে বেচারা রাতে ঘুমাতেই পারলো না । তাই ভোরে উঠা হল না। একটু সকাল হলে আমরা দুইজন বের হলাম, এবারও পিচ্চিকে বাদ দিয়ে। আমরা ভাবছিলাম পুরো দ্বীপটা হেঁটে চক্কর দিব।

পূবদিক বরাবর হাটতে শুরু করে ভুল হল, রোদ পড়ছে একদম মুখে ফলে আরাম লাগছে না। অনেকটা হেটে অনেক শামুক, ঝিনুক কুড়ালো, আমিও ওকে বেছে দিলাম। বুঝলাম পুরো দ্বীপ ঘুরতে অনেক সময় লাগবে, এদিকে নাস্তা খাবার জন্য বারবার ফোন করছে। আমরা আবার একই পথে ফিরলাম। নাস্তার পর আমরা ভ্যান নিয়ে বাজারে ঘুরলাম, যেটুকু সম্ভব দেখলাম।

ফেরার আগে আর একবার সাগরে ডুবাতে হবে। এবার মেয়েকে নিয়ে গেলাম। ওকে বালু দিয়ে ঘর বানানো শিখিয়ে দিলাম, বললাম বালু দিয়ে ইচ্ছামত খেল। সে তো মহা খুশী হয়ে বালুকাদা সারা গায়ে মাখালো, ঘর বানালো, বেশি বেশী পানি থাকার জন্য সে ঘর একটুতেই ভেঙ্গে গেল। তারপরও নিজের শিল্পকর্মকে সে আনন্দের সাথে দেখালো," দেখো বেগুণী ঘর বানিয়েছি"।

বালি দিয়ে বেগুনী ঘর কেমনে হয় এইসব প্রতিভাবানরাই বলতে পারে! সাগরে একটু ডুবালাম, তখন জোয়ার যায় যায়। এরপর ফিরবার জন্য গোছগাছ, এবার ও ফিরতে ইচ্ছে করছে না। একদিনে হবে না এরপর সাতদিনের জন্য আসবো, মনে মনে ভাবলাম। একই রকম ভাবে আবার ফেরা। প্রবাল দ্বীপের প্রবাল দ্বীপ এবং নৌকা জাফনা র কাপড় কাচা সী ট্রাক আমাদের সাগর পারের হোটেল
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।