আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লক্ষী সংবাদ

লক্ষী বিবির কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে। দূর থেকেই শোনা যায় তার কোঁকানি। রাত এখন অনেক। সারাদিন বৃষ্টি হয়েছিলো। আকাশে চাঁদ নেই।

ক্ষয়ে আসা মোমবাতির মত দু’একটা তারা এখানে সেখানে। চারিদিকে অন্ধকার। রাতের মত কালো। শুধু লক্ষীর খাটের কোনায় একটা টিমটিমে হারিকেন। তারই একটু আলো এসে পড়েছে চানের কপালে।

তার অপাশে অন্ধকার একটু গাঢ়। সেখানে ছায়ার মত একজন মানুষ এলো চুলে চিরুণী দিচ্ছে । তার নাম ফুলি। ঘুমের মধ্যে চান একবার কাশে ওঠে। ফুলির বুকের ভিতর খচ খচ করে।

ইনসানওদ্দি মরার আগে অমন কাশতো। একদিইন ঘুমের ঘরেই মরে গেল লোকটা। ফুলি খুব কেঁদেছিলো। ‘বাপজান তারে খুউপ ভালো ফাসতো’। আর একবার কাশে চান।

বাইরে কোথাও ডানা ঝাপটায় একটা নিশাচর পাখি। ফুলির ভাল্লাগে না। বৃষ্টির জিন্যে মাটির মেঝে ঠান্ডা। এক মাদুরে ঠান্ডা মানায় না। লক্ষী বিবির ব্যথাটা পুরোনো।

বয়স তো কম হয়নি! যৌবনে লক্ষীছাড়া ছিলো সে। মধুমতির মাঝখানে সাঁতরে গিয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছা করতো। বৈশাখি ঝড়ে দিব্যি সময় কাটতো আম তলায়। এ নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে অনেক । তবু লক্ষী তার মতই ছিলো।

একবার ঝড়ের সময় সিঁদুরে আমের একটা ডাল ভেঙ্গে পড়লো কোমরে। সেই থেকে ব্যাথা। লক্ষী তখন লক্ষীছাড়া। প্রথমে কাউকে বলেনি, ভয়ে। পরে অনেক কিছু করেছে ব্যাথা কমেনি।

ইরফান তখন কোলে। ইরফানের বাপ মরেছে সেও অনেক দিন হল। ছেলে এখন মস্ত জোয়ান। অবশ্য লক্ষী তাকে দেখেনা আজ দশ বছর। লক্ষীর ব্যথাটা তো বহুদিনের।

এখন তেমন কিছু না। মাঝে মধ্যে উলটোপালটা মোচড় লাগে, তখন ছেলের কথা মনে হয়। ‘ছাউলডা তার খুউপ ভালো’। একবার কী একটা মালিশ দিয়েছিলো এনে তাতে ব্যথা কমে। আজ এশার নামাজের সময় হঠাত টন টন করে ঊঠেছে কোমরটা।

আর সেজদায় যাওয়া হয়নি। নামাজের পাটিতে শুয়েই কাঁইকুঁই করছে লক্ষীবিবি। নামাজের মধ্যে এরকম কাঁতরানি সহ্য হয় না ফুলির। এ বাড়িতে সে নতুন নয়। অনেক ত দিন গেল।

বুড়ির এই স্বভাবটা বদলায় নি। তবে ঠিক আগের মত নেই লক্ষী বিবি। চামড়ায় ভাজ্জ পড়েছে। রঙও বদলেছে গায়ের আর ভালো মানুষটা হঠাত করেই একটু খিটখিটে হয়ে গেছে। তবু তাকে ভালো লাগে ফুলির, তার দুঃখে মন খারাপ হয়।

খাটের উপর এসে লক্ষীবিবির কোমরটা টেনে দেয় ফুলি। তার কাতরানি আরও বাড়ে। বিড় বিড় করে কি বলে ফুলি বুঝতে পারে না। লক্ষীর দুঃখটা যে কী সে নিজেও বোঝে না । এক এক সময় এই জগত সংসার তার অচেনা মনে হয়।

এত মানুষের মাঝেও মনে হয় তার আপন কেউ নেই। ‘ইরফান যে ক্যান ফেরে না। জয় বাংলা অইছে আইজ ম্যালাদিন। সগগল মানুষ ফিরে আয়ছে ঘরে’। ইরফান ফেরেনি।

তার কথা কেউ জানে না। পূর্ব কথা ইরফানের তখন ফুল, পাখি ভালো লাগা শুরু হয়েছে। পাশের গ্রামের হিনার সাথে তখনও কথা হয়নি, শুধু চোখাচোখি। যুদ্ধটা বাঁধলো তখনই। কোথায় গেলো ফুল, পাখি।

কোথায় গেল ‘হিনা’। এক একদিন যুদ্ধের খবর আসে। ইরফান চঞ্চল হয়ে ওঠে। বুকের ভেতর থেকে কে যেন বলে, ‘চলে যাব। যুদ্ধে চলে যাবো’।

লক্ষী বিবি প্রথমে রাজি হয়নি। ওই এক্ টাই তার ছেলে। তার সব। ইরফান বলে ছিল্‌, ‘তুই একবার যাতি দে মা। হারামজাদা খান দের এট্টু দ্যাকপো, তুই বাভিস না।

জয় বাংলা অবেই। শ্যাখ সায়েব বলিছে। আমি ফিরে আসঅপোই’। ইরফানরা মিথ্যে কথা বলে না। সে আবার এসেছিলো।

তখন ভাদ্র মাস। সে বছরটাই একটু বাড়াবাড়ি রকমের পানি হয়েছিলো। থঅইথই পানির মধ্যে লক্ষীবিবির বাড়িটাকে দ্বীপের মত মনে হত। ইরফান এসেছিলো ভিজে কাপড়ে। - বিল ঝাপায়ে আইছি মা।

আবার বিল ঝাপায়েই যাতি হবে। তার সাথে আর একজন ছিলো। সে দিনটার কথা লক্ষীর প্রায়ই মনে পড়ে। সেটা ছিলো তার সুখের দিন। তার ইরফান দ্যাশের জন্যি যুদ্ধ কত্তিছে।

ভারি খুশি লেগেছিলো তার । ছেলের সাথে তার অনেক কথা বলার ইচ্ছে হয়েছিলো। তবে ছেলে ব্যস্তছিলো তার বন্ধুকে নিয়ে। বলেছিলো, ‘মা রে, কথাতো ফুরোয়ে যাচ্ছে না’। এ দিগি এটটা কাজ আছে।

ওরে বুঝোয়ে কতি অবে। তোরে জন্যি পরান পুড়তিছেলো, তাই এট্টু দেকে গিলাম’। লক্ষী বিবি ছেলের কথা কতক বুঝেছিলো কতক বোঝেনি। ইরফানকে সে সময় তার অচেনা লেগেছিলো। তবু যাবার সময় বলেছিলো, বাজান ইবার দা না গেলি অয় না? ইরফান বলেছিলো, মানষির চোখির পানি তুই যতি দেখতিস, এই বিলির পানির চাইয়ে বেশি’।

শুধু মায়ের চোখের পানিটাই সে দেখতে পারেনি। সন্ধ্যার পরে বিলের পানিতে ছলাত ছলাত শব্দ তুলে ফিরে গিয়েছিলো ইরফানরা। লক্ষীবিবিও এসে দাঁড়িয়েছিলো বিলের পাড়ে। অন্ধকারে ইরফানের ভিজে ওঠা চোখের কোনা সে দেখতে পারেনি। যতক্ষণ ইরফানদের চলে যাবার শব্দ শোনা যাচ্ছিল, ততক্ষণ নিজে কে সামলে রেখেছিলো সে।

তার পর চোখের পানিতে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো তার পথ ঘাট। সে কথা ইরফানরা হয়তো জানে হয়তো জানে না। আর কোনদিন ফেরেনি সে। লক্ষীবিবি এর পর পথে পথে কেঁদে বেড়িয়েছে। ছেলের কথা ভেবে তার সারটা দিন কেটে যেতো।

নাওয়া খাওয়ার কথা মনে থাকতো না। যুদ্ধ শেষে কত মানুষ ফিরে এলো! প্রতিদিন মানুষ আসতো জোয়ারের পানির মত। কত রকম সে মানুষ। শহরের মানুষ, গঞ্জের মানুষ, ভিন গাঁয়ের মানুষ। কিন্তু ইরফানের খবর কেউ দিতে পারতো না।

লক্ষীবিবির দিন কাটতো পথ চেয়ে। এমনি করেই একদিন চান কে কোলে করে এলো ফুলি। বানের জলের মত ভেসে ভেসে। ফুলির কেউ আছে কী না তা সে জানে না। তার স্বামীও যুদ্ধ থেকে ফেরে নি।

রাজাকার আর খানরা মিলে যেদিন বাড়িটা জাবালিয়ে দিলো, সে দিন যে ফুলি কীভাবে বেঁচেছিলো ফুলি তা মনে করতে চায় না। এর পর অনেক ঘাটের পানি খেয়ে, থিতু হয়েছে লক্ষীর সংসারে। তার কেউ আছে কীনা এখনও সে জানে না। এতো দিনেও কেঊ তার খোজ নেয় নি। সে অনেক কথা।

সাম্প্রতিক লক্ষীবিবির কোন মেয়ে নেই। ইরফানের বিয়ে দিলে এত দিনে চানের মত একটা পোতা হত তার। ‘সে কি বাইচে আছে?’ মুন্সী বাড়ির হুজুর একবার নানান রকম আঁক কেটে, কাঁচি ঘুরিয়ে বলে ছিল, ইরফান ভালো আছে’। এই দশ বছরে ওই টুকু ছাড়া ছেলের আর কোন খবরই পায়নি সে। লক্ষী বিবি হঠাত করেই জোরে জোরে কেদে ওঠে।

ব্যথাটা কোথায় ফুলি বোঝে না, আরো ভালো করে মালিশ করা শুরু করে। লক্ষী বলে, ‘ও ফুলি, ইরফান আসপে?’ ফুলি কিছু বলে না। সাড়া না পেয়ে ক্ষপে ওঠে লক্ষী। কথা কইস নে ক্যা, এ নোটির বিটি, আমার ছাওয়ালডা কী তয় মিথ্যে কথা কয়? এত দিন পর ছেলেকে মিথ্যে বাদী ভাবতে ইচ্ছে করে না তার। ‘ ছাওয়ালডা তো কোন দিন মিথ্যে বাদী ছেলো না।

সে তো কোন দিন মিথ্যে কথা কই নি। দেহিস সে আসপেই। ফুলি এবারও কিছু বলে না। তার মানুষটাও নেই। চান কোন্ দিন বাপ বলা শেখে নি।

যুদ্ধ করতে সি যে গেল, আর কোন দিন ফেরত আসে নি সে। তবি ফুলি কাঁদে না। সে হাসেও না আজ বছর। শুধু চানের কথা ভেবে মনটা কেমন হয়ে যায়। যুদ্ধের বছর ফুলি একটা কথা শিখেছে।

‘পুষ্যি মানুষ দুমকা বাতাসের লাহান। মেঘ আসলি তারে আর বাইন্দে থুয়া যায় না’। চান বড় হচ্ছে।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।