আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্প - টগর

মোটাসোটা - গোলমুখ - চোখ ছোট একজন মানুষ আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। হলুদ সোনালু ফুল মাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেদিনের কথাগুলো ভাবছিল আনিস। জরুরী তলব পেয়ে সেদিনও এ পথেই গিয়েছিল সে। তারপর আঠার বছর। অথচ মনে হয় এই তো সেদিনের কথা।

এমনিই এক বিকেল ছিল সেদিন। সে কালের পথটা ছিল খানিকটা সরু। রাস্তায় কালো পিচের ছোঁয়া না পড়ায় চক চক করত না তখন। সে কালের লাল ইটের মায়াভরা রাস্তাটা থাকত ধূলোয় ভরা। রাস্তার দুপাশের সোনালু গাছগুলো থেকে সেদিনও এভাবে দমকা হাওয়ায় হলুদ ফুলগুলো ঝরে ঝরে পড়ত।

কৃষ্ণচূড়াগুলো কি তখন ছিল? মনে আসে না তার। কদম ছিল। বর্ষার এ দিনগুলোতে ডাল ভেঙ্গে পেড়ে আনা কদম তার খোঁপায় দেয়া ছিল আনিসের নিত্য অভ্যাস। রাস্তার শেষ মাথার পাহাড়ের ঢালের নির্জনতায় যে তুলাগাছের বিশাল সব শাখা-প্রশাখার আড়ালে তার আর রানুর খুঁনসুটি হত সেখানেও ছিল দুটো কদম আর একটা টগর। আঠার বছর আগের এমনি এক বিকেলে রানু যখন তাকে আলাদা হয়ে যাবার কথা বলে তখন আনিস শুয়েছিল মাটিতে।

সাদা টগরের বিছানার উপর শোবার পর আরও কিছু ফুল পড়েছিল তার শরীরটায় । দু’চারটা ফুল পড়েছিল তার বন্ধ চোখের পাতার উপর। টগরের গন্ধে ভরে ছিল তার দেহ মন। রানুর কথাগুলো ভেসে আসছিল যেন অনেক দূর থেকে। প্রথমটায় বুঝতে পারে নাই আনিস কি বলছে রানু।

সবে থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করেছে তারা দু’জনে। দশ-পনের দিন চুটিয়ে প্রেম করার সময় তখন। যুগের ভাষায় লটকা-লটকি করার বয়স। তখনি ও কথাটা বলে রানু। আনিসের কানে কথাগুলো ঢুকেনি।

রানু বুঝতে পেরে আবার বলে, সামনের সোমবার আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঠেকাতে পারলাম না আর। রানুর সাথে কথা কাটাকাটিতে কিংবা টুকটাক সমস্যায় রানু মাঝে মাঝেই বলত ও নাকি বিয়ে করে ফেলবে। ওর জন্য পাত্ররা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অন্যরা তাকে মোটামুটি সুন্দরী বলত। আনিসের কাছে সে ছিল ডানাকাটা পরী। ও কথাগুলোকে সে তেমন পাত্তা দিত। অভিমানের কথা। আনিস শুনত আর হাসত।

গা করত না। রানু তখন আরও ফুলতে থাকত। ফুলতে ফুলতে এক সময় খুব ঠান্ডা স্বরে বলত , যেদিন চলে যাব সত্যি সত্যি সেদিন বুঝবে। আনিস তখন ব্যস্ত হয়ে যেত ওর মান ভাঙ্গাতে। বুকে জড়িয়ে ধরে চিবুকের নিচে হাত দিয়ে মুখটাকে টেনে তুলত তার চোখের দিকে।

ফাঁক হয়ে থাকা দুটো ঠোঁট, বড় বড় কালো চোখের দিকে তাকালেই আনিসের বুকটা হু-হু করত। চোখের দিকে তাকিয়ে বলত, সত্যি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে তুমি ? আনিসের বুকের স্পর্শ পেয়েই রানুর রাগ পানি। ও কথা শুনে কিছু বলত না। কেবল মাঝে মাঝে ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁট দুটো মিশে যেত অন্য জোড়ার সাথে। কখন কেবলই মুখ গুজে নিশ্চুপ বসে থাকা।

দু’চারটা টগর ফুল এসে আটকে থাকত রানুর চুলে। চুলগুলো ভরে থাকত টগরের ছোঁয়ায়। টগর ফুলের গন্ধের সাথে রানু মিশে গিয়ে একাকার হয়ে আসত তার কাছে। আনিস বুক ভরে নিত সে গন্ধটুকু। প্রশস্ত বুকের ভেতরে যেন টগর না, রানুই প্রবেশ করত।

সেদিন তেমন কিছুই হয়নি। সেদিন আর আনিস হাসেনি। চোখের পাঁপড়ির ধাক্কায় টগর ফুল দুটো সরিয়ে চোখ মেলে তাকায় সে। উঠে বসে নাই। রানুকে খুব ভাল বুঝত আনিস।

সেদিন আনিস বুঝে গিয়েছিল রানু দুষ্টামী করছে না। কিছুদিন ধরে রানু ছিল অন্যমনস্ক। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করত, আমি যদি তোমাকে ছেড়ে যাই, তুমি থাকতে পারবে? কোথায় যাবে? যেখানে যাবে সেখান থেকে ধরে আনব না তোমায়! আনিস হাসত। সত্যি ধরে আনবে? আমি আবার তোমার কাছে ফেরৎ আসলে তুমি আমাকে রাখবে? এসব কি বলছ তুমি? রানু শেষ প্রশ্নের উত্তর দিত না। আজ ও সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে।

আনিস নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, কেন? রানু কিছু বলে না। চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আনিস আবার জিজ্ঞেস করে, কেন বিয়ে করবে ? তুমি তো বাসার অবস্থা জানই। বাবা অসুস্থ। যখন-তখন কিছু হয়ে যেতে পারে।

বড় ভাইটার চাকুরি নেই। কতদিন আর তাদের চিন্তায় রাখব? পালিয়ে বিয়ে করার সাহস বা সঙ্গতি কোনটাই তোমার আমার নাই। আর সত্যি কথা বলতে কত আর স্বপ্নের ভেতর থাকা যায়? স্বপ্নটা কি কিছু না? স্বপ্নটা বাস্তবে বসেই দেখতে হয়। অবাস্তবে বসে স্বপ্ন দেখা যায় না। আজ কথার চালাচালি থাক আনিস।

এরপর রানু কোন কথা বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। সেদিন আকাশে দুটো চিল অনেকক্ষন ধরে চক্কর কাটছিল। দু’জনে চুপচাপ কিছুক্ষন সে চিল দুটো দেখে। এক সময় রানু উঠে যায়।

কেবল বলে, ভাল থেক। দাওয়াত দিলে না? না। তোমার-আমার আর দেখা না হওয়াই ভাল। কখনও জানতে চেয় না কেমন আছি। চাইলে আমি কষ্ট পাব।

কিভাবে জানব না বল? ভার্সিটিতে এক রুমেই তো বসি - কথাগুলো বলতে গিয়েও আনিস বলে না। রানু চলে যায়। আনিস কোন রকম বেদনা অনুভব করে না। অনেকক্ষন শুয়ে থাকে সে। হয়ত মনে আশা ছিল রানু ফিরবে।

ওর দুষ্টামী কেটে যাবে। রানু আসে নাই। সিনেমা, নভেলে যেমন দুঃখের সাগর পারিয়ে বিচ্ছেদ হয়, নাটকীয়তা হয় তার কিছুই আনিসের সাথে হয়নি। কিছুদন পর আনিস সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। রানু সত্যিই তাকে ছেড়ে চলে গেছে।

কিন্তু মনে মনে সে কখনও আশা ছাড়ে নাই। নাটকীয় কোন ঘটনায় রানুর সাথে তার দেখা হবে। আবার সে টগরের গন্ধ বুকে ভরে গ্রহন করবে। দৈনন্দিন জীবনের চলাচলে, বউয়ের মুখে বাজারের ফর্দ শুনতে শুনতে আনিস আজও সে টগরের গন্ধটা পায়। রানুর সাথে আনিসের এরপর আর দেখা হয় নাই।

রানু বিয়ের পর আর পড়ালেখা চালায়নি। লোকমুখে আনিস শুনেছে সে প্রবাসী। জামাইটা একটু বয়স্ক আর চালবাজ টাইপের। রানুর সাথে মানায়নি। আজ এত বছর পর সে আবার টগরের গন্ধ পাবে।

রাস্তার শেষ মাথায় প্রায় চলে এসেছে সে। আজ তার এখানে আসার কথা ছিল না। গত আঠার বছর কখনও এ রাস্তাটায় পা রাখে নাই সে। আজ এসেছে অফিস কামাই করে। সকালে ফোনটা আসে।

রানুর ফোন। আঠার বছর পরও গলার স্বর পাল্টায় নাই। ফোনটা কানে লাগানো মাত্র ওপাশ থেকে ভেসে আসে , কেমন আছ? আনিসের সামনে তখন বড় সাহেবের জরুরী কাজ। বেসরকারী কোম্পানীর সব কাজই অবশ্য জরুরী। প্রতি নিয়ত জরুরী কাজ করতে করতে এগুলো এখন আর তাকে ভাবায় না।

রানুর গলার স্বর শুনে আনিস অবাক হয় না। হয়ত মনে মনে এ যোগাযোগটার জন্য অপেক্ষা করেছে সে এতটা বছর। সে কি রানুর জন্য অপেক্ষা করছে? হতে পারে। বউয়ের সাথে ভালবাসায়, বৃষ্টি ভেজা দিনে তার অবচেতন মনে রানু এসেছে। তার সাথে কথোপকথন করেছে।

টগরের সাথে মিশে যে রানু তার বুকে বাসা বেঁধেছে তাকে কিভাবে ভুলতে হয় তা আনিস জানে না। তাই রক্ত মাংসের মানুষটার গলার স্বর শুনে আনিস স্বাভাবিকভাবে বলে, ভাল। নম্বর কোথায় পেলে? ওটা যোগাড় হয়েছে। আজ বিকেলে ফ্রি আছ? তোমার সাথে জরুরী কথা ছিল। আঠার বছর পর কি জরুরী কথা থাকতে পারে? কথার জবার দেয় না রানু।

একটু চুপ করে বলে, তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। তুমি আসবে? জানি না। একটু আস সময় পেলে। আমি আবার চলে যাব আজই। তোমার জন্য সাড়ে পাঁচটা করে অপেক্ষা করব সেই টগর গাছটার তলায়।

মুখে না করলেও আনিস এসেছে। বাস্তব জগৎ এ বসবাসকারী হলে আনিস যেত না। কিন্তু রানুর ক্ষেত্রে সে আজও বাস্তব জগৎ এর পুরো বাসিন্দা হতে পারে নাই। তাই সে এসে দাঁড়ায় তুলাগাছটার গোড়ালীতে। সময় অনেক কিছুই পাল্টে দেয়।

এদিকে এখন লোক বসতি বেড়েছে। টাই ঝুলিয়ে তুলাগাছের গোড়ালীতে বসে থাকাটা বেমানান। টাইটা খুলে হাতে নেয় আনিস। গাছটা বুড়ো হয়ে এসেছে। আজকাল বোধ করি বখাটেদের আনাগোনা।

পোড়ানো কাগজ, গাঁজার ভাঙ্গা কলকে পড়ে আছে। ছড়াসো ছিটানো পোড়ানো কাগজকে, গাঁজার ভাঙ্গা কলকে এড়িয়ে বসে পড়ে আনিস। বিকেলের শেষ আলোর কিছুটা এসে পড়ে তার শরীরে। সাড়ে পাঁচটা করে রানুর আসার কথা। রানু কেমন আছে, কি করে, বাচ্চা –কাচ্চা কয়জন এটা আনিস জানে না।

ও কি একা আসবে ? একা আসাটাই স্বাভাবিক। চারদিকে তাকায় আনিস। হঠাৎ মনটা তার ভীষন দমে যায়। শূন্যতায় হু-হু করে উঠে বুকের ভেতরটা। টগর গাছটা আজ মৃত।

শুকিয়ে গেছে। দুপাশের কদম গাছের একটি আজ নাই। উঠে গিয়ে টগর গাছটায় হাত বুলায় আনিস। হালকা চাপে একটা ডাল ভেঙ্গে চলে আসে আনিসের হাতে। ভাঙ্গা ডালটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আনিস।

সুখ স্মৃতির পাতায় পাতায় ভরে থাকা টগরের এমন অসহায়ত্ব যেন এক লহমায় এতদিনের সুখকে আড়াল করে ফেলে। টগর গাছটার এই জরাজীর্ন অস্তিত্বই কি আজ থেকে তার কাছে গাছটার পরিচয়? আচমকা উঠে পড়ে আনিস। একবারও পেছনে না তাকিয়ে হন হন করে হাঁটতে থাকে সে। রানুর সাথে এখন আবার দেখা করার কোন অর্থ হয় না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।