যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে
১.
বছর পাঁচেক পেরিয়ে গেছে, কিন্তু মৌটুসী এখনও স্বপ্নটা দেখে। কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তা সে স্পষ্ট বুঝতে পারেনা। শুধু টের পায় যে চিৎকার করে কিছু বলতে চাচ্ছে সে। ছুরি হাতে এগুতে থাকা ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করেই কি যেন বলতে চায়। কিন্তু মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হয়না।
মনে হয়, কেউ একজন যেন খুব জোরে তার গলা চেপে ধরেছে। আবার মাঝে মাঝে এমনও মনে হয়, গলার ভেতর বড়সড় কিছু একটা দলাপাকিয়ে আটকে গেছে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। প্রাণপণ প্রচেষ্টাতেও কিছু হয়না, স্বপ্নের ভেতরই ভীষন অসহায় বোধ করে সে। কিছুক্ষণের মধ্যে আশপাশের কোনো জায়গা থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে রক্তের জোয়ার।
লাল টকটকে রক্ত আলকাতরার মতো ধেয়ে আসে।
স্বপ্নের ঠিক এই জায়গাটাতেই চিৎকার করে জেগে ওঠে মৌটুসী। উঠে বসার ফুরসৎ পায় কি পায়না, তবে নাগালের মধ্যে থাকলে সেলিনার লাথিটা ঠিকই খায়। খানিক দূরে ঘুমুতে থাকা কলিদিও কখনও কখনও খেঁকিয়ে ওঠে, খিস্তি দিয়ে বলে, "ঘুম যা মাগি, আল্লাদ চুদাইসনা!"
গুম হয়ে বসে থাকতে হয় মৌটুসীকে, এখানে তার থাকার কথা না। পাঁচ বছরে যতবার দুঃস্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙেছে প্রতিবারই এই একই কথা মনে হয়েছে তার, রুটিন করে, এই জায়গাটা তার হবার কথা ছিলো না।
এক ধরনের অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে। তবে সেই অবসাদগ্রস্ততা দীর্ঘস্থায়ী হয়না, বিশেষ করে যখন তাকে ভাবতে হয়, এ জায়গাটা ছেড়ে আর কোথায় যাবে সে।
মাঝে মাঝে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাতের অন্ধকার হাতড়ে পাতড়ে এগিয়ে যায় মরচে পড়া লোহার গ্রিলগুলোর দিকে। গ্রিলগুলো যেন এক ধরনের নির্মম রসিকতা। আলাদা করে রেখেছে তাদেরকে বাকী সবার থেকে।
যেন গ্রিল না থাকলেই এক হয়ে যাওয়া যায়। গ্রিলের কোনো একটা অংশ খুব অকারণেই শক্তভাবে মুঠ করে ধরে। কখনও ঘুমে ঢলে পড়ে, দাঁড়িয়েই ঘুমায়। কখনও লম্বা করিডোরে আঁধারের শেষপ্রান্ত খোঁজে।
আবার কখনও ঘুম ভাঙার সময় বেশী জোরে চিৎকার করে ফেললে সেন্ট্রি মহিলা চলে আসে।
অকারণ বুটের শব্দের সাথে সাথে টর্চ জেলে একেকটা সেলে আলো মারতে থাকে আর কি কি যেন পরীক্ষা করে। একবার সরাসরি টর্চের আলো এসে পড়েছিলো চোখে, গ্রিলের শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো মৌটুসী, ঘুম ঘুম চোখে। অন্ধকার ভেদ করে হঠাৎ ভেসে আসা আলোর জোয়ারে সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলো ছেলেটিকে। ছুরি হাতে এগিয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো সে সেন্ট্রিকে উপেক্ষা করে।
পারেনি। গলায় কি যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছিলো, আর সববারের মতোই। তবে সেবার ঘোর কেটেছিলো অন্যভাবে, বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছে সেন্ট্রির লাঠির প্রচন্ড আঘাতে। ঠাস ঠাস করে লাঠির আঘাতের সাথে সাথে সেন্ট্রি বলেছিলো, "খানকি মাগি, রাইত দুপুরে নাটক করস্!"। ব্যাথাটা ভুগিয়েছিলো অনেক দিন।
মাঝে মাঝে মৌটুসীর মনে হয় সমস্যাটার কথা ডাক্তারকে বলে। বছরে দু'বার ডাক্তাররা এসে পরীক্ষা করে মহিলা জেলের কয়েদীদের, মূলত শারীরিক সমস্যা নিয়ে। মৌটুসীর বয়েস জেলে কাটানো পাঁচ বছর মিলে সবে বাইশ হলো, এই বয়েসে তেমন কোন সমস্যা থাকার কথা না। ডাক্তাররাও সমস্যা পায়না। একটা কাগজের ওপর সাত-আট জায়গায় নিল কালির স্ট্যাম্পে "স্বাভাবিক" লেখা সিল মেরে দেয় ডাক্তার, সেটা হাতে নিয়ে জেলারের টেবিলে জমা দিতে হয়।
পাঁচ বছরে পাঁচ দু'গুনে দশবার। প্রতিবারই একই রকম, কোন হেরফের নেই। মাঝে মাঝে শুধু ডাক্তার বদলায়। গত দু'বছর ধরে ভেবে এসেছিলো মৌটুসী, ডাক্তারকে বলবে স্বপ্নটার কথা। ডাক্তারকে বলবে যে সে এটার হাত থেকে বাঁচতে চায়।
বলার সাহস পায়নি। বিশেষ করে তুলির গল্প শোনার পর।
প্রতি বৃহস্পতিবার সকালে সেলাইর কাজ করে যাদের সাথে তাদের একজন তুলি। গ্রামের মেয়ে, চেয়ারম্যানের ছেলের হাতে ধর্ষিত হবার পর বিচার চাওয়ার চেষ্টা করেছিলো মেয়েটির পরিবার, শহুরে শিক্ষিত এক নীতিবাগিশ আত্মীয়ের উপদেশে। কাজের কাজ কিছু হয়নি, বরং কিছু টের পাবার আগেই অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ মাথায় নিয়ে জেলে ঢুকে গেছে মা আর ছোটবোন সহ।
তাও তিনজন আলাদা জেলে। শহুরে আত্মীয়ও লাপাত্তা। এই মেয়েটি মাঝে মাঝে একটা শেয়াল দেখতে পায়, হিংস্র ধরনের দাঁতাল শেয়াল, স্প্যানিশ বিশালকায় ষাঁড়গুলোর মতো খুনে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর মনে হয় যেন রক্তাক্ত মাংসের জন্য ছোঁকছোঁক করছে। একবার ডাক্তারকে বলেছিলো সে সমস্যাটার কথা। ডাক্তার কতটা শুনেছে জানতে পারেনি সে, তবে ঘুমের ওষুধ ধরিয়ে দিয়ে উপদেশ দিয়েছিলো যে এসব কম কম দেখতে।
তা না হলে নাকি পাগলা গারদ সেলে পাঠিয়ে দেবে কর্তৃপক্ষ। পাগলা গারদের ভয়ে মেয়ের শেয়াল দেখা কমেনা বরং বেড়ে যায়, তবে মুখ ফুটে সেটা বলার সাহসটুকু ঠিকই কমে শূণ্যের কোঠায় নেমে আসে। সেলাইর কাজের সময় সবসময় পাশাপাশি বসে তুলি আর মৌটুসী। প্রায়ই মৌটুসী দেখে, অদৃশ্য কিছু একটার উপস্থিতি টের পাচ্ছে তুলি, আতংকে কেঁপে উঠছে।
২.
মৌটুসীরও শেষমেষ দুঃস্বপ্নের কথা কাউকে আর বলা হয়না।
শুধু মাঝে মাঝে যখন আশপাশের সব কিছুকে শূন্য অস্তিত্বহীন মনে হয়, সময়কে মনে হয় থেমে গেছে জেলের সেলের ছোট্ট জানালাটার ওপাশে মেঘের দাপটে, তখন তার ইচ্ছে হয় কাউকে সব খুলে বলে। কাউকে জানায় যে আসলে সে মুক্তি চায়।
এমনই এক মেঘলা দুপুরে ছাদ থেকে ছুটতে ছুটতে নেমে এসেছিলো তার ছোট ভাইটি, দশ-এগারো বছরের শীর্ণকায় কিশোর মিশুক বেহুঁশের মতো চিৎকার করে শুধু বলতে পারছিলো, "আম্মা! আম্মা! আম্মা! আম্মা ..."।
মিশুকের চিৎকারে বাড়ীর সবাই ছুটে গিয়েছিলো ছাদের দিকে, কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরী হয়ে গেছে। মফস্বলের তিনতলা বাড়ীর ছাদ থেকে গাছের ডাল ধরে ঝুলে দুষ্টুমী করা যায়।
তবে বাড়ীর ভাড়াটেদের মেয়ে, কলেজে পড়া অস্টাদশী মৌসুমী সেরকম কোন দুষ্টুমীর ছলে গাছের ডালে ঝুলে ছিলোনা। ছাদে দাঁড়িয়েই নারকেলের ডালের সাথে বেঁধেছিলো দড়ির একপাশ, অন্যপাশ দগদগে ঘা তৈরী করে সেঁটে ছিলো তার গলার কাছে। বিস্ফারিত চোখ, বাঁচবার শেষ আশা কি করেছিলো কিছু? শেষ মুহুর্তে এসে? এসব জানেনা মৌটুসী। কারণ, বড়বোনের শবদেহ সে দেখতে পায়নি। ঢাকায় ছোটমামার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো সে এসএসসি পরীক্ষার পর।
ফিরে এসে দেখেছে বোনের কবর, তাও দূর থেকে।
অদ্ভুত রকমের ছিলো এর পরের ঘটনা প্রবাহ। যে মাস্তানের যন্ত্রণা আর উপদ্রবের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলো মৌসুমী, সেই মাস্তানের কিছু হয়নি। বরং বাসা ছাড়তে হয় মৌসুমী-মৌটুসীর বাবা শহিদুল্লাহ মিয়াকে। গলায় দড়ি দিয়ে অভিশাপ ডাকানোর দায়ে বাড়িওয়ালাকে দিতে হয় বাড়তি পাঁচ মাসের ভাড়া।
জরিমানা হিসেবে, প্রতিবেশী মুরুব্বিদের ফয়সালায়।
এখানেই সব শেষ হলেও বেঁচে যেতেন শহিদুল্লাহ মিয়া আর তার স্ত্রী নাজমুন নাহার। কিন্তু বড় মেয়ের মৃত্যুর মাস দুয়েকের মধ্যেই বাসা বদলে আসা নতুল এলাকার মাস্তান কল্লোলের সাথে যখন তাঁদের ছোট মেয়ে মৌটুসীকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা নিয়ে নানান কথা ছড়ায় প্রতিবেশীদের মুখে -- তখন নতুন করে তাঁরা বুঝতে পারেন সব শেষ হয়নি। বড় মেয়ের করুণ পরিণতির কারণেই কি ছোট মেয়েটি পাড়ার মাস্তানকে ফিরিয়ে দিতে সাহস পায়নি? অথবা, বড়বোনের মৃত্যু কি ছোট বোনকে একটুও ছুঁতে পারেনি যে সে ওরকম এক মাস্তানের সাথে ঘোরাঘুরি শুরু করেছে? এহেন নানান ধরনের হতাশায় আচ্ছন্ন হতে থাকেন তারা, একের পর এক।
বাবা মায়ের মানসিক যন্ত্রণা কিছুটা হলেও টের পেয়েছিলো মৌটুসী, নিদেনপক্ষে এক ছাদের নিচে থাকলে যতটুকু অগ্রাহ্য করা যায়না ততটুকুর কল্যাণে।
কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তা কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরী করেনি। কল্লোলের সাথে তাকে আইসক্রীম খেতে দেখা যায়, কলেজ ফাঁকি দিয়ে সদর জেলার সিনেমায়ও গিয়েছে বলে গুজব ছড়ায়। মৌটুসীর মা যখন মোটরসাইকেলের পেছনে চেপে প্রেমিকের কোমর জড়িয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া মেয়ের গল্প শোনেন প্রতিবেশীদের মুখে, তখন তাঁকে এসব অবিশ্বাস করার জন্য উল্টো গল্প তৈরী করতে হয়। যে বৃহস্পতিবারে সিনেমা দেখা নিয়ে গুজব জমে ওঠে, সে বৃহস্পতিবারে জ্বরের কারণে যে মৌটুসী কলেজেই যায়নি, এ কথা তাকে জনে জনে বলতে হয়, ফিসফিস করে। এমনকি ডাক্তারের সার্টিফিকেট বের করে দেখানোর অভিনয়ও করতে হয়।
কেউ হয়তো বিশ্বাস করে, কেউ ঠোঁট ওল্টায়।
লোকের কুৎসা, কৌতুহলী দৃষ্টি বা ঠোঁট বাঁকানি, সবকিছু উপেক্ষা করেই কল্লোলের সাথে প্রেম চলে মৌটুসীর। কল্লোল যেন তার আলাদিনের যাদুর প্রদীপের দৈত্য। রিক্সা ডেকে দেয়া থেকে শুরু করে রাত বারোটার সময় ফ্লেক্সিলোড করে মোবাইলে টাকা ভরে দেয়া, সবকিছুই সে করতে পারে। মুহূর্তের মধ্যে।
অবশ্য মৌটুসীর মতো অসম্ভব রকমের আকর্ষণীয়া এবং সুন্দরীর জন্য এসব করতে কল্লোলের কোন সমস্যা হয়না। পুরো সম্পর্কটায় নিজের অবস্থান নিয়ে তার মনে কোন প্রশ্ন জাগেনা। মৌটুসী তার ওপর নির্ভরশীল, এই অনুভূতিটুকুই তার শরীরের যাবতীয় হরমোনকে পর্যাপ্তভাবে উন্মাদনার যোগান দেয়।
এমনি এক সন্ধ্যায়, কমলের রেস্টুরেন্টের পশ্চিমকোণার বুথে মৌটুসীর বিশেষ আলাপ চলে কল্লোলের সাথে। এখানে ওরা প্রায়ই বসে, কথাবার্তা বলে।
তবে সেদিনের সন্ধ্যেটা ছিলো ভিন্ন। সন্ধ্যে কেন বেছে নিয়েছিলো মৌটুসী জানা যায়নি, হয়তো যা বলার তার গাম্ভীর্য বাড়ে। অথবা হয়তো একটু বাপ-মা'র অবাধ্য হতে চেয়েছিলো। তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না, যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই প্রথম কল্লোল জানতে পারে মৌটুসীর মনের গভীরে আটকে থাকা কষ্টের কথা। কথা বলতে গিয়ে বারবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছিলো মৌটুসী।
রেঁস্তোরার গোপন খোপে পর্দার এদিক সেদিক দিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেছিলো নিষ্কর্মা গোছের উৎসাহী লোকজন। নারীকন্ঠের কান্নার উৎস আর কারণ জানার জন্য।
৩.
এরপরের ঘটনা ঘটে সপ্তাখানেকের মধ্যেই। মৌটুসীদের আগের বাসা বিজয়পুর বাজার থেকে নতুন বাসা নতুনবাজার এলাকা পাঁচ কিলোমিটারের মতো দূর। বিজয়পুর বাজার থেকে একটা টেম্পোতে চেপে বসেছিলো সে, মাঝপথে হাজীর হাটে নেমে রিক্সায় চাপে।
আগের দিন কল্লোলের কাছ থেকে নিয়ে রেখেছিলো দু'শো টাকা, বান্ধবীদের আইসক্রিম খাওয়াবে বলে। সেই টাকার অল্প কিছু অংশ খরচ করে সে চলে আসে বিজয়পুর বাজারে, পড়ন্ত বিকেলে। মাকে বলে এসেছিলো জেসমিনদের বাসায় যাবে, রাতটা থাকবে। জেসমিনকেও বলে রেখেছিলো রাত কাটাবে। সে রাত কাটানো হয়নি।
শৈশব থেকে বিজয়পুরেই বড় হয়েছে সে, সবকিছু কত বেশী চেনা। রিক্সা এসে সোজা থামে নির্মল কাকার বইয়ের দোকানের সামনে। মোটামুটি বড়সড় আকারের দোকানটি বাজারের শেষ মাথায়, অর্থাৎ উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত বাজারের দক্ষিণ-পূর্ব মাথায়। নির্মলের বাসাটিও ঠিক দোকানের পেছনেই। বাজারের মুখের উল্টোদিকে মানে, দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটা দরজা আছে যেটা দিয়ে ছোটবেলা থেকেই মৌসুমী-মৌটুসীরা কাকীমার ঘরে যেত।
ফুটফুটে দুটো বোন, ছোট্ট উপশহরে সবার কাছে রূপকথার রাজকন্যার মতো আদর পেতো তারা। সেদিনও দোকানে দাঁড়িয়ে বই পড়তে পড়তে সেই দরজা দেখে মনে পড়ে যায় মৌটুসীর, কতদিন কাকীমার সাথে দেখা করেনা। হাতে সময় আছে কিছুটা, সময়টুকু কাকীমার সাথে এটা ওটা গল্প করে কাটানো যায়, ভাবতেই চলে যায় পেছনের দরজার দিকে।
সন্ধ্যে সাতটার খানিক পরে কাকীমার ঘর থেকে বের হয়ে নির্মল কাকার দোকানের পেছনে আবার ফিরে আসে মৌটুসী। যদিও প্রস্তুতি ছিলো টার, তাও খুব লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা তাকে করতে হয়না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টিসীমায় মোটরবাইকে চাপা একটা ছায়ামূর্তি ভেসে ওঠে। এগিয়ে আসছে কল্লোল। সেদিনও আর সব দিনের মতোই সময়মতো এসে পড়ে সে। কুচকুচে কালো লেদার জ্যাকেট, লেদার প্যান্ট।
একটা গাছের আড়ালে থেকে বাইকে বসা কল্লোলের ওপর চোখ রাখে মৌটুসী।
তার দু'চোখে ধ্বংসদেবীর আগুন, হাজার বছর ধরে পোড়ানো আগ্নেয়গিরির লাভার মতো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো যেন। কল্লোলকে সে বিশ্বাস করে নি তা নয়। কিন্তু তাও, যে আগুন চোখে নিয়ে কাটিয়েছে গত কয়েকটি মাস, সে আগুনের একটা পিপাসা আছে। সে পিপাসা মেটাতেই নিয়তির মতো চলে আসতে হয়েছে তাকে, খানিকটা অবচেতনভাবেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাজারের দিক থেকে এগিয়ে যেতে দেখা যায় ছেলেটিকে, লম্বাটে গড়ন।
আগের চেয়ে শুকিয়েছে বোধ হয়, হাঁটার ভঙ্গিতেও আত্মবিশ্বাসের ছাপ কমে গেছে বলে মনে হচ্ছিলো মৌটুসীর। অন্ধকারে কল্লোলের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানিক নামের সেই পিশাচটির ছায়ামুর্তিটি দেখে অবধারিতভাবেই ঘৃণায় জ্বলে উঠেছিলো সে। তার ইচ্ছে হচ্ছিলো দৌড়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায় বদমাশটার। কল্লোলের বেল্টের পেছনে লুকিয়ে রাখা চাইনিজ কুড়ালটি নিয়ে নিজ হাতে কুপিয়ে মারে অমানুষটাকে। কল্লোলের মোটরবাইক থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে তাই সাপিনীর মতো ফুঁসতে থাকে মৌটুসী।
নিজে না করতে পারুক, নিজ চোখে দেখতে তো অন্তত পাবে।
তারপর কাঁদবে, দিদির ছবি জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদবে মৌটুসী। দিদির কবরে চলে যাবে, কারো কোন কথা শুনবেনা। কবর জড়িয়ে ধরে কাঁদবে। সারাজীবনে কখনও একা একা হাঁটেনি মৌটুসী, সবসময় একটা হাত ধরে ছিলো দিদির হাত, এজীবনে ঐ হাতের তুলনায় বেশী নির্ভরযোগ্য হয়ে আর কিছুই ধরা দেয়নি তার কাছে।
দিদি ছাড়া কখনও সে ছিলোনা, স্কুলের খেলার মাঠ, বাড়ীর ছাদ, নানা বাড়ীর পুকুর বা নির্মল কাকার বইয়ের দোকান -- সবখানেই হঠাৎ একা বোধ করলেই যে অবয়বটির উপস্থিতি তাকে স্বস্তি দিতো, সেটি দিদির। সেই দিদি চলে গেলো, কিছু না জানিয়েই।
এ নিয়ে তার অভিমান ছিলো, কষ্ট ছিলো, আর্তনাদ ছিলো -- সব এক হয়ে জন্ম নিয়েছিলো হিংস্রতা, প্রতিশোধপরায়ণতা। সেই হিংস্রতার প্রতিফলন ঘটবে আর কয়েকটি মুহূর্ত পরই, কল্লোলের চাইনীজ কুড়ালের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে মানিকের শরীর -- ভেবে এক ধরনের অসুরীয় সুখ অনুভব করছিলো সে। কল্লোল তাকে বলেছিলো, "অরে আমি গুলি কইরাও মারবার পারি, কিন্তু তুমার ভইনরে যা করছে তার লেইগা অরে আমি কুপাইয়া কুপাইয়া মারুম।
"
কল্লোলের মোটরবাইক থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে বিশাল কড়ই গাছের পেছনে লুকিয়ে তাই উত্তেজনায় কাঁপছিলো মৌটুসী। আর মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত, তারপর চুপচাপ ঢুকে যাবে নির্মল কাকার বইয়ের দোকানে।
৪.
কল্লোল ধরা পড়েছিলো, একই সাথে ধরা পড়েছিলো পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকা মৌটুসীও। চিৎ হয়ে পড়ে থাকা মানিকের মৃতপ্রায় লাশ কিছুক্ষণ পরপরই ডাঙায় মাছের মতো ফাল দিয়ে উঠছিলো। তবে বেশীক্ষণ টেকেনি।
মাত্র বিশগজ! মুহূর্তের চেয়েও কম সময়। মানিকের কলার চেপে ধরে প্রায় শূণ্যে উঠিয়ে ফেলেছিলো কল্লোল, অসহায় মানিককে শুধু সজোরে মাথা নাড়াতে দেখা গেছে।
তারপরই ঘটে ঘটনাটা, খুব দ্রুত। শূণ্যে তুলে ধরা মানিককে আছড়ে রাস্তার পাশে ফেলে কল্লোল, মুহুর্তের জন্য ল্যাম্পপোস্টের আলোতে দেখা গিয়েছিলো যন্ত্রণায় কাতর একটি মুখ। গালভাঙা, ফর্সা, লম্বাটে মুখ; চোখের ওপর চশমাটা ছিটকে পড়ে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে।
বোনের হত্যাকারীর মৃত্যযন্ত্রণায় পৈশাচিক আনন্দ পাওয়ার বদলে হঠাৎ করেই কেঁপে উঠেছিলো মৌটুসী সে দৃশ্য দেখে। অদ্ভুত অনুভূতি, ভয়, কষ্ট, মায়া, অনুতাপে মেশানো। বুঝতে পেরেছিলো সে, বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে কোথাও।
মুহুর্তও নেয়নি, চীৎকার করে উঠেছিলো সে, কিন্তু আজও সে বোঝেনা অত জোরে চীৎকার করার পরও কেনো তার গলা দিয়ে সামান্য শব্দটুকুও বের হলোনা।
"কল্লোল থামো, উনি না, উনি না, অন্য একজন!" বলতে চেয়েছিলো সে।
শেষমেষ দু'হাত সামনে বাড়িয়ে এলোপাতাড়ি দৌড়ে কল্লোলকে নিবৃত্ত করতে ছুটে গিয়েছিলো, কিন্তু মাঝে মাঝে বিশ গজও অনেক বেশী দূরত্ব হয়ে যায়। ততক্ষণে একহাতে চাইনিজ কুড়াল আর অন্যহাতে ধারালো নয় ইঞ্চি ছোরা দিয়ে মানিকের শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিলো কল্লোল।
শোনা গিয়েছিলো কয়েকটা গগনবিদারী চিৎকার। হত বিহবল দু'জন তরুণ-তরুণী। আর ছুটে আসা লোকজনের কোলাহল।
এরপরের ঘটনা মৌটুসীর মনে নেই, মনে আছে শুধু এক ধরনের শুনশান নীরবতা গ্রাস করে ফেলেছিলো চারদিক। কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিলোনা সে, চারপাশে কি হচ্ছে বুঝতেও পারেছিলোনা। টের পেয়েছিলো লোকে এসে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে আর কল্লোলকে। আর দেখেছিলো যন্ত্রনায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া একটা নিরপরাধ মৃত মুখ। লোকটির একটি হাত উপরের দিকে তোলা, বাঁচার কি আকুতি!
৫.
মাঝে মাঝে মেঘলা দিনে জেলের গ্রিল সজোরে আঁকড়ে ধরে আকাশ-পাতাল ভাবে মৌটুসী।
নিজের জীবনটা নষ্ট হয়েছে, জেলের গারদে এসে আটকে গেছে, এ নিয়ে কেন জানি অতটা কষ্ট হয়না। আসল খুনটা কল্লোল করেও পার পেয়ে গেছে গডফাদারের কল্যাণে, এলাকার এমপির বডিগার্ড হিসেবে এখন সে গাড়ী হাঁকায়, মানুষের সালাম পায়। সেটা নিয়েও তেমন কষ্ট অনুভব করেনা সে। এমনকি কল্লোলের পাপ লঘু করার জন্য তার বিরুদ্ধে "যৌনতার বিনিময়ে প্ররোচনা"র যে মিথ্যে অভিযোগ এনেছিলো কল্লোলের উকিলপক্ষ, তা নিয়েও অত রাগ হয়না তার। প্রতিশোধের বিনিময়ে শরীর দাবী করলে কল্লোলকে হয়তো সে তাও দিতো।
তবে মাঝে মাঝে ভীষন কষ্ট হয়, সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। একটা মুখ আর উপরের দিকে তোলা একটা হাতের কথা মনে পড়ে, তীব্রভাবে মনে পড়ে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় একেকটা আঘাতের সাথে সাথে কি ভয়ংকর ভাবে কুঁকড়ে যাচ্ছিলো মানিক নামের ঐ অচেনা নিরপরাধ লোকটির মুখ! কি বীভৎসভাবে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে বেরিয়ে আসছিলো তার শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে! কি করুণভাবে একটা হাত উঠে আসছিলো উপরে, কিছু একটা ধরার আশায়, বাঁচবার শেষ আশায়।
মৃতপ্রায় লোকটার মুখে, দেহে সে নিরপরাধ দিদির অবয়ব টের পায়। "এসব দেখে দিদি কি খুশী হবে?" প্রায়ই প্রশ্নটা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
অজান্তেই দু'হাত সামনে এগিয়ে যায় তার প্রায়ই। কিছু একটা ধরতে চায়, কাউকে থামাতে চায়, কিছু একটা বলে চিৎকার করে নিজেকে হাল্কা করতে চায়। অদ্ভুত এক কারাগারের অস্তিত্ব অনুভব করে সে চারপাশে। কারাগারের ভেতরে আরেক কারাগার। জেল থেকে হয়তো বেরুতে পারবে কোনদিন, কিন্তু কোথায় গেলে ঐ কারাগার থেকে মুক্তি পাবে তা সে জানেনা।
যেখান থেকে কোন না কোন গন্তব্যে যাবার অপেক্ষায় থাকে সবাই, সেই জেলের সেলে বসেও কোথাও যাবার আর কোন জায়গা থাকেনা তার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।