খাতা দেখে গান করো না, উল্টে পাতা যেতেও পারে। আমি বাক্তিগত ভাবে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে। এই নিয়ে বন্ধুদের সাথে বহু বিনিদ্র তর্করাত্রি পার হয়েছে। দেশের আনাচে কানাচে ছাত্ররাজনৈতিক সংঘাত সংবাদে "ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হোক" যুক্তিতে আমিও আক্রান্ত হয়েছি। কিন্তু আমার অবন্থান-চর্চা ও উদ্দেশ্যর ঘাঁটিতে।
"কেহ নাহি ছাড়ে সূচাগ্র মেদিনী"- তর্কেতর্কে সময় পাড়, মাঝে মাঝে চা পান বিরতি, গালাগালি তখন গলাগলি। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে একটি ছাত্ররাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলাম। তাই ছাত্ররাজনীতির পক্ষে আমার নিলজ্জ ও উচ্চকন্ঠ যৌক্তিক পক্ষপাত। প্রথমেই যে "চর্চা ও উদ্দেশ্য" বলেছিলাম এক এক করে সেই প্রশ্নে আসি।
আসুন বোঝার চেষ্টা করি বর্তমানে একজন ছাত্র কিভাবেন রাজনীতির সাথে সম্পক্ত হয়।
যারা গ্রাম হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তারা তাদের সামাজিক স্তরভেদ অনুসারে রাজনৈতিক দল পছন্দ করে। গ্রামের উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো অবশ্যই ক্ষমতা ভাগাভাগি করা রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী হয়। নোংরা রাজনীতিতে পারিবারিক ও গ্রামীন ঐতিয্যের মারমার কাটকাটে এরা ব্যাপক আক্রমনাত্বক ও সিদ্ধহস্ত। এদলের পুত্ররা বাপ দাদার দল বেছে নেয়। তাদের কেন এই দল কর-জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বলবে " আমার চৌদ্দগুষ্টি ওমুক দল করে আমি তমুক দল কেমনে করি।
আর সরকারিদলে থাকলে বি.সি.এস পরীক্ষায় সুবিধা আছে। " সরকারি চাকরির ক্ষমতা কী গ্রামের সাহেব মাতবর পরিবার দেখে তাদের ভালই জানা। "সচিব ডাব্লু সাহেব আবার নানা বাড়ির আত্নীয়, চিনেন নাকি?" ডান্ডা পিটাতে ওস্তাদ ছেলেরা ছাত্রদল/ছাত্রলীগের প্রথম পছন্দ।
গ্রামের সহজ ধর্মপ্রান ছেলেটি অবশ্যই শিবির করবে। কারণ ছোট হতে সে ইসলাম কমবেশি মেনেছে , নেশা বিড়ি খায়নি , নাফরমান যাত্রা দেখেনি , বিশ্ব্যবিদ্যালয়ে মুগ্ধ মগজ ধোলাই খেয়েছে, লোখাপড়া, অভাব, অভিযোগে সাথীভাইয়ের সাহায্য পেয়েছে।
এধরনের মুরগী ছেলেদের বাঘ বানানোর কোচিং আল্লার নামে দেয়া হয় শিবির নামক সেন্টারগুলোতে।
গ্রামের শিক্ষক, বাবা, চাচা বা শিক্ষিত বড়ভাইয়ের মাধ্যমে হাতে পাওয়া শরৎচন্দ্র , মানিক বন্দোপাধ্যয়, সুলীল পড়া ছেলেটি বাম ছাত্র সংগঠন করবে। পথের দাবী, পদ্মা নদির মাঝি, গর্ভধারিনীর রোমান্টিক ভাবনায় সে সদ্য সিগারেট ধরেছে। এরা মঝারি মানের ত্যন্দর হয় তবে নোংরা নয়। দার্শনিক মুগ্ধতা নিয়ে ক্রমাগত ধোঁয়া উড়ে চলে।
বাদবাকি যার টিউশনি করে পড়ালেখা করা ছেলেপেলেরা কোন রাজনীতির সাথে নাই। রাজনীতি সে ত্যাগ করলেও রাজনীতি তাকে ছাড়ে না । হলে ওঠার জন্য দুই লাইন স্লোগান দিতে হলে দেয়া যেতে পারে তবে ওটুকুই। লেখাপড়া শেষ করে চাকরিটা পেতেই হবে। এরা জিওল মাছ।
কাঁদায় থাকে কিন্তু কাঁদা মাখে না।
এবার শহরে আসি। রাজনৈতিক বা আরাজনৈতিক উচ্চবিত্ত বাবার "ইয়োম্যান" পোলার কাছে রাজনীতি একটা ন্যাষ্টি বিষয়। বাবা মা বলেছে এসবে জড়ানো যাবে না। তারা মোবাইল সেটের রকমফের, প্রেমিকা, টুটাফাটা ফ্যাশন, ব্লাক লেভেল নেশা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে অন্য কিছু চিন্তা করার সময় থাকে না।
দেশ নিয়ে ব্যাকডেটেড চিন্তা করে লাভ কি? সব গোল্লায় যাক। দেশের বাইরে চলে যাব, ব্যাস সব খতম।
আর মধ্যবিত্ত যারা পাড়াতো, মহল্লাতো বা কলেজে ভাই ভাই কালচারে লীগ বা দলের কোক/সিঙ্গার খেয়েছে তারা টেন্ডারের টাকার স্বাদ তখনই টের পেয়েছে। চাকরি করে তোরা কয় টাকা কামাবি? আমি ছাত্র আবস্থার কই যাই দেখ। আমি ওমুক ভাইয়ের গ্রুপে, তার ভাল লিংক আছে।
স্কুল কলেজে বিভন্ন কালচারাল প্রতিযোগীতা/বই পড়া/রচনা প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়েছে বা চে গুয়েভারকে চিনেছে সে বাম সংগঠন করবেই। কবিতা প্রেমিক হবে, ভাল তার্কিক, ভাল অভিনেতা, রোমান্টিক প্রেমিক হবে। সুন্দর বাচনভঙ্গি ব্যবহার করে ভাল সংগঠক হবে এবং মার খাবে।
গরিব বা ৩য় শ্রেণির কর্মচারির সন্তান মন দিয়ে পড়ালেখা করবে। প্রতাশা কম রেজাল্ট দিয়ে চাকরি ধরবে।
রাজনীতি গরিব মানুষের কাজ নয়। এই মোটমুটি ছাত্রদের শ্রেণীগত রাজনৈতিক অবন্থান ও দল বাছাই প্রক্রিয়া।
এখন আসি চর্চা প্রসঙ্গে। যে লাভ কামাতে মহান ক্ষমতাসীন দলে ছাত্ররাজনীতি করবে সে গ্রুপিং করবেই। কারন গ্রুপিং না করলে কর্মী হিসাবে ভাইয়ের আশ্রয় পাবে না।
ভাইয়ের জন্য কোপাকুপি করে রক্ত নেবে ও অন্য গ্রুপের কাছে দেবে। সাহসী না হলে ভাইয়ের চোখে পড়া যাবে না। আর চোখে না পড়লে সেও কোনদিন ভাই হতে পারবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় নেতার নেত্রস্নেহে সে ভাইকেও উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করবে। বড় নেতা সাহেবদের কাছ থেকে "সব বিরোধীদের ষড়যন্ত্র" জাতীয় যুক্তি আয়ত্ব করে নেবে।
কাঁচা টাকা কামাই হলে মদ ও মেয়ে দুটোতেই ওস্তাদ হয়ে উঠবে। পোলাপান খাওয়াতে দিলদরিয়ার পরিচয় দেবে। কোনমতে ছাত্রত্ব শেষ লিংক ঘসে ভাল চাকরী , কাঁচা টাকার ব্যবসা বা আরও বড় নেতা হবার চেষ্টা করবে। এদের অবস্থা রান্নাঘড়ের ভাঙা বেড়া চেনা বিড়ালের মত- ফাঁক দিয়ে সে মাছ চুরি করবেই যতই পেট ভরা থাক। উদ্দেশ্য যদি সুবিধাবিদী হয় তবে কাজ ভাল হওয়া অসম্ভব।
মহান দলে কিছু কর্মী থাকবে যারা সুযোগের অভাবে সৎ। কিছু না পেয়ে আস্তে ধীরে সটকে পড়বে। নোংরামি নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি করা হলে তারা বলবে-"আসলে আমাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না, এমন হোক আমরা চাই নি। " দুধে ভিজিয়ে "গু" দিয়ে চিতই পিঠা বানালে যে গুগন্ধ দূর না বরং দুধ নষ্ট হয় এটা তারা বুঝেও বোঝে না।
বাম ছাত্রনেতারা বরাবরই উচ্চকন্ঠ।
মূলত প্রতিটি ক্যাম্পাসে মূল বিরোধী দল। কারণ লীগ ক্ষমতায় তো দল আউট দল ক্ষমতায় তো লীগ আউট। শিবির বরাবরই পেছন হতে ছুরি মারতে ওস্তাদ। লীগ বা দল মূলত ক্ষমতা ভাগাভাগি ছাড়া শিবিরের প্রতিপক্ষ নয়। তবে মসনদে আক্রমন হলে তারা কাউকেই ছাড়বে না।
বাম দল ঠেঙাতে লীগ, দল, শিবিরের ঐক্য মনে হয় দেশের রাজনীতির সবচেয়ে বিরল ঘটনা। শিবিরের চিন্তাকে বেঠিক বলার মত বিশ্লষণী শক্তি বাম দলগুলোর আছে বলে বরাবরই নাস্তিক আপপ্রচারের চোঙা শিবিরের মুখে থাকে। আল্লাহ-বিল্লার নামে অস্ত্র দিয়ে দখল কর ক্ষমতা, মারহবা মারহাবা ! আমিরসাব পোলাউ মাংস খেয়ে শিবিরকর্মীর জন্য যে দোয়া খায়ের করবে তাতে জান্নাত নিশ্চিত। আর দেশ হবে জান্নাতের বাগিচা। বাম সংগঠন গুলো মার খেতে খেতে এখন হারমোনিয়াম গলায় প্রতিবাদ করছে।
বহু তত্ব বহু ভাগ। ভাগে ভাগে কর্মী অভাব প্রকট। অভাবে অভাবে স্বভাব নষ্ট অথবা নিক্রিয়তাই ভবিতব্য।
সবই হতাশ পরিস্থিতির নামতা। তবু আমি ছাত্র রাজনীতির পক্ষে।
এর কারণ হতাশার চেয়েও আশাদ্বিপ্ত। উদ্দেশ্য ও চর্চার বদল অনেক ভাল কিছুর শুরু করতে পারে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের গৌরবউজ্জল ৫২ ও ৭১।
কারণ গুলো পয়েন্ট করে দেই-
১.দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র ও অশিক্ষিত। ক্ষুধা মানুষকে ঘিরে রাখে।
দেশ ও জাতির চিন্তা তাদের কাছে অবান্তর। ছাত্রদেরই মোহমুক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা করার সুযোগ থাকে। সিলেবাসের বাইরে দেশ নিয়ে চিন্তার খোরাক পাওয়া যায় রাজনীতি হতে।
২.দেশের মূল কলকাঠি রাজনৈতিক ব্যাক্তির হাতে। রাজনীতি না বুঝলে দেশটার চালচলন বোঝা যাবে না।
না বুঝে না শুনে কি করতে কাজের মত কাজ পারি আমরা? চায়ের কাপ হাতে দেশকে গালাগালি করাই হবে একমাত্র কাজ।
৩.ছাত্ররা একদিন পেশাজীবি হবে। পেশা রাজনীতির বাইরে কখনওই নয়। সে দেশিয় প্রতিষ্ঠান হোক আর মাল্টিন্যাশনাল হোক। রাজনৈতিক অংক না জানার কারনে সেবাদাস আমরা অগোচরেই দেশের ক্ষতি করে চলছি।
যেমন- রাজনৈতিক চিন্তা ও পুঁজি নিরপেক্ষ আচরণ দিয়ে
ইসলামি হাসপাতালে টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা বা টাকার জন্য কাজ করে জামাতকেই শক্তিশালি করছি, আমরা টেরও পাচ্ছি না।
৪.বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি নিরোপেক্ষ জায়গা নয়। তাই ইলেকশন এর পর ভিসি পরিবর্তনের হিরিক পড়ে। সরকারী টেন্ডারে বানানো ছাদের নীচে থাকতে হয়, খেতে হয়, ক্লাস করতে হয়। রাজনীতি না বুঝলে শুধু কুফলই ভোগ করতে হবে, ভিত্তিমূল অচেনা থাকবে, প্রতিবাদ দিকভ্রান্ত হবে।
৫.বাজারে চাল,ডাল, তেল, নুনের দাম রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক কারনে পরিবর্তন হয়। ভোটের আগে বিভিন্ন দলের বা রাষ্ট্রের কর্মপরিকল্পনা রাজনৈতিক জ্ঞান ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়। ফলাফল নবীনদের হাতে ডিজিটাল মার্কার জয় ও জনগনের একই ভোগান্তি একই অন্ধকার।
রাজনীতির মাঠে লড়াই থাকবে, লড়াই করে বেঁচে থাকতে হবে। লড়াকু মানষিকতার ঐক্য ছাড়া অস্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যাবে না।
৮৯-৯০ সাক্ষী দেয়, কী করে অস্ত্র প্রতিবাদী কন্ঠস্বরের কাছে মাথা নত করে। সত্য, শুভবোধের জয়সুনিশ্চিত। একটু পা চালিয়ে সাথী.....একটু পা চালিয়ে সাথী। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।