‘ভাই, মানিব্যাগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজ-পত্র আছে। আপনি মানিব্যাগ নিয়েছেন তাতে আমার কোন আপত্তি নাই। দয়াকরে টাকা-পয়সা সব রেখে মানিব্যাগটা আমার রুমের পাশে ফেলে রেখে যাবেন।
বি: দ্র: মানিব্যাগটি আমার বান্ধবীর দেয়া। ’
একটি ছোট সাদা কাগজে এই লেখাগুলো লিখে আমার হলের কমনরুমের দেয়ালে লাগানো হয়েছিল কয়েক মাস আগে।
কে লাগিয়েছিল আমি জানি না। তবে যেই লাগাক না কেন, সে কতটা কষ্ট পেয়ে মানিব্যাগ উদ্ধারের শেষ চেষ্টা করেছে, তা বোধহয় না বললেও চলে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি হলেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা দিন-রাত উদ্বেগের মধ্যে থাকে তাদের মানিব্যাগ, মোবাইল, ল্যাপটপ নিয়ে। এই বুঝি চুরি হয়ে যায় সাধের মোবাইলটা বা ল্যাপটপটা। রুম খোলা রেখে বাথরুম থেকে পানি এনে আবার রুমে ফিরে এসে যদি একজন ছাত্র তার মোবাইল খুঁজে না পায়, তবে এর দায়ভার সে কাকে দেবে? কাকে দোষারোপ করবে?
আর এভাবেই দিনের পর দিন গোপনে নীরবে-নিভৃতে বেড়ে যাচ্ছে চুরি, বেড়ে যাচ্ছে আতঙ্ক।
কয়েকটি চুরি:
১। সেদিন সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে দরজা খুলে টয়লেটে ছুটলাম। সকালের এই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, খুব তাড়া দেয়।
আমার রুমমেট রাশেদ ওর বিছানায় ঘুমিয়ে আছে বেশ আরাম করে।
রুমে ফিরে এলাম ১০-১২ মিনিট পরে। এসে দেখি রাশেদ উঠে বসে আছে, ওর চোখে-মুখে বিরক্তি। কি হয়েছে? জিজ্ঞাসা করতেই ও বলে উঠল যে ও ওর মোবাইলটা খুঁজে পাচ্ছে না।
তারপর চলল অনেক খোঁজাখুজি। বিছানার চিপা,লকার, বালিশের তল বাদ গেলনা কিছুই।
আর পাওয়া গেলনা আমার বন্ধুর মোবাইলটি।
২। আই.আই.টি তে পরে সাফায়াত। রুম বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিল। পাশে ছিল মোবাইল।
এক সময় ওর চোখে ভর করল ঘুম। ও তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।
কোমল সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। ঝিরিঝিরি বাতাস। মিষ্টি রোদ।
কিন্তু পাশে ল্যাপটপ আর মোবাইলটা নেই। কোথায় গ্যালো ওগুলো? রুম তো রাতে বন্ধই ছিল।
হঠাত্ খেয়াল হল, জানালার একটা রড ভাঙ্গা।
যাক, কিভাবে চুরি হয়েছে সেটা তো জানা গেল। কিন্তু কিভাবে চোর এতটা সুনিপুনভাবে চুরি করল যে সাফায়াত কিছুই বুঝতে পারল না, তার ব্যাখা পাওয়া গেল না।
৩। এম.এম.এইচ হলে থাকে আমার দুই জুনিয়র বাশার ও রাসেল। ওরা একই রুমে থাকে। দুজনের দুটি ল্যাপটপ। দুটো টেবিলে রাখা।
বাশার ল্যাপটপে মুভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত তখন সাড়ে এগারোটার মত।
রাসেল চা খাওয়ার জন্য বাহিরে আসে। যাওয়ার আগে রুমে তালা মেরে বের হয়।
বড় জোড় ১৫ মিনিট দেরী করল ও।
রমে এল। তালা খুলল।
ল্যাপটপ নেই!
প্রথমে চলল পরষ্পরের জিজ্ঞাসাবাদ। তারপর ব্যাপক খোঁজাখুঁজি।
নাহ্, পাওয়া আর গেল না।
আশ্চর্য ব্যাপার হল, চুরিটা কিভাবে হল সেটা ওরা কেউই বুঝে উঠতে পারল না। চৌর্যবৃত্তি কতটা আধুনিক হয়েছে, ভাবলেই অবাক হতে হয়।
৪। আমার আরেক বন্ধুর দুজন বন্ধু এসেছে বাহির থেকে। ক্যাম্পাস ঘুরতে।
রাতে হলে ছিল আমার বন্ধুর সাথেই।
সকালে উঠে তারা আর তাদের মোবাইল খুঁজে পায় না। পায় না তো পায়ই না।
আমার বন্ধু অপমানিত। আমার বিশ্ববিদ্যালয় অপমানিত।
নিন্দিত। আমি লজ্জিত।
চুরির ভয়াভয়তা:
যে দু’জন জুনিয়রের ল্যাপটপ হারিয়ে গেল, ওরা কষ্ট নিয়ে বলছিল যে, ল্যাপটপ তো আমরা আবার কিনতে পারব। কিন্তু ল্যাপটপে আমার যে ডকুমেন্টগুলো ছিল, যে ফাইলগুলো ছিল, প্রোজেক্টের কাজগুলো ছিল, সেগুলো আমি কোথায় পাব?
শহীদ রফিক-জব্বার হলে থাকে আমার আরেক জুনিয়র জুয়েল। ও শোনালো আরও ভয়াভয় কথা।
কাপড় ধুয়ে বাহিরে মেলে দিলে সে কাপড়ও কে যেন টান দিয়ে নিয়ে যায়। বাদ যায় না গামছা, লুঙ্গি এমনকি আন্ডারওয়ার ও। তাই এখন্ ওরা কাপড় ধুয়ে রুমেই মেলে দেয়। অন্তত চুরির হাত থেকে তো রক্ষা পাওয়া যাবে!
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়, যারা বেশ দরিদ্র পরিবারের সন্তান। অনেক কষ্ট করে, টিউশনি করিয়ে তারা মোবাইল বা ল্যাপটপ কেনে।
চুরি হয়ে গেলে অনেকের পক্ষেই খুব তাড়াতাড়ি নতুন করে কিনে ফেলা সম্ভব হয় না। এ ধরণের ঘটনা তাদেরকে মারাত্মক অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দেয়।
মানসিক ক্ষতিটাও কম হয় না। আমরা সবাই আমাদের মোবাইল বা ল্যাপটপটাকে খুবই ভালবাসি। সেটা চুরি হয়ে গেলে খারাপ লাগার পরিমাণটাও ব্যাপক।
অনেকে তো আছে মুখ গোমরা করে দিনের পর দিন পরে থাকে। খাওয়া-দাওয়া করে না। মনে মনে কষ্ট পেতে থাকে। ভাবে, ইস্ আর একটু সচেতন হলেই হয়ত আমারটা চুরি হত না!
চোর কে ?
আমি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। সত্যি কথা বলতে কি, আমি ব্যক্তিগত ভাবে কখনওই বিশ্বাস করতে পারি না যে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন ছাত্র চুরি করতে পারে।
আমার দুর্ভাগ্য, ইদানিং আমাকে এ কথাটিও বিশ্বাস করতে হচ্ছে।
একজন মানুষ চুরি করে প্রয়োজনে। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র খাওয়া-দাওয়া বা খাতা-কলম কেনার অভাবের কারণে চুরি করে না। তাদেরকে চুরিতে প্ররোচিত করে একটি ভয়াভয় নাম- নেশা। হিরোইনখোররা চৌর্যবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে।
কারণ তাদেরকে নেশা করতেই হবে,সে টাকা থাকুক বা না থাকুক। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যতদিন নেশা রাজত্ব করবে ততদিন চুরি ঠেকানো সম্ভব বলে মনে হয় না।
মেয়েদের হলে অনেক বিধিবদ্ধতা থাকলেও ছেলেদের হলে সেসব থাকে না। যে কেউ প্রায় যখন-তখন চাইলেই ছেলেদের হলে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে পারে। তাদের মধ্যে দু-একজন যে চুরির চিন্তা নিয়ে আসে না, সেকথা কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না।
যদিও সন্দেহ করতে ইচ্ছে করে না, তবুও বলতেই হচ্ছে, চুরির সাথে জড়িত থাকতে পারে হলের কর্মকর্তারা যারা হল পরিচ্ছন্ন রাখা সহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। আমি জানি, হলের এইসব দায়িত্বে থাকা লোকজন খুবই অমায়িক হয়। তারা ছাত্রদের সাথে সবসময়ই ভালো সম্পর্ক বজায় রাখে। কিন্তু, অভাবেই যে স্বভাব নষ্ট হয়।
ভালোবাসা যেমন একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না, চুরি হওয়া জিনিস-পত্রও তেমনি আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায় না।
চুরির শিকার অনেকেই মুখ লুকিয়ে কাঁদে। অনেকে মন খারাপ করে বসে থাকে। আপাতভাবে ছোট ব্যাপার মনে হলেও এর প্রভাবটা বেশ ক্ষতিকর।
এছাড়াও:
শুধু ছেলেদের হল নয়, চুরি হয় মেয়েদের হলেও। বিস্ময়কর হলেও ব্যাপারটা সত্য।
দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই চুরির ঘটনা ঘটে থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়( Click This Link ), চুয়েট( http://www.prothom-alo.com/detail/news/140321 ) সহ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই চুরির নজির আছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তো একবার মেয়েদের হলে এক ছেলে চোরকে ধরা হয়েছিল( http://www.prothom-alo.com/detail/news/162785 )। কি ভয়ানক ব্যাপার!
এক বান্ধবীর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, ওদের হলে এক আপু ছিল, তার সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম ছিল। তিনি নাকি কারও ভাল কিছু দেখলেই চুরি করে ফেলতেন।
অথচ তিনি নাকি বেশ ধনী ঘরের সন্তান ছিলেন।
তাই হলের চোর বা চুরির ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট কারন দেখানো যায় না।
তাহলে উপায়? :
১। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অবস্থা এমনই যে আমার মনে হয় হলের প্রতিটি রুমে একটি করে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো জরুরী হয়ে পড়েছে।
কিন্তু এ আসলে সম্ভব নয়।
২। বিকল্প উপায় হিসেবে উঠে আসে সচেতনতা। কিন্তু একজন মানুষের পক্ষে কতক্ষণ খুবই সচেতন থাকা সম্ভব। মানুষ আনমোনা হবেই।
কিন্তু চোরেরা বোধহয় কখনও ই আনমোনা হয় না। উদাস হয় না। ওরা সুযোগ খোঁজে। সবসময় সচেতন থাকে।
৩।
এর পরের উপায় হিসেবে বলতে পারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতা। হলে চুরির ব্যাপারটা যদি তাঁরা একটু গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতেন তাহলে হয়ত আমার মত সাধারণ ছাত্ররা উপকার পেত।
৪। চোরের শাস্তি। যদিও অধিকাংশ সময়ই চোর ধরাছোঁয়ার বাহিরে থেকে যায়, তবুও চোর ধরা পড়লে তার শাস্তি দেয়াটা জরুরী।
সেটা অন্য চোরদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেবে।
শেষে:
বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন। স্কুল-কলেজ জীবনে যে যাই করিনা কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিজেকে পরিশুদ্ধ করাটা খুবই জরুরী। হলের চুরিগুলো সাধারণত আমাদের কাছের মানুষগুলোই করে থাকে। আমাদের বন্ধুত্ব-বিশ্বাস সবকিছুকে আহত করে অনেকেই চুরি করে নেয় আমাদের মোবাইল,মানিব্যাগ,কাপড়-চোপড় কিংবা ল্যাপটপ।
লেখাটি লিখেছি অনেক কষ্ট নিয়েই। সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনে এসে কেউ যদি চুরি করা শেখে, তাহলে মনে কি কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক নয়?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।