আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিকশন: পালাও!

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে [১০০% ফিকশন] ১. আর সবদিনের মতোই বেশ মনোযোগ দিয়ে চ্যানেল আইয়ের ন'টার খবর শুনছিলেন প্রফেসর সেলিম হায়দার। শুনতে শুনতে অজান্তেই একসময় তাঁর হাত নিশপিশ করে ওঠে; পুরু গোঁফ আর মোটা-ফ্রেম-মোটা-কাঁচের চশমার আড়াল ভেদ করে ছড়িয়ে পড়া তৃপ্তির হাসিটুকুও লুকিয়ে রাখতে পারেননা তিনি। অবশ্য এই মুহূর্তে সেটার প্রয়োজনও নেই। খবর হচ্ছিলো অধুনা জনপ্রিয় কুয়েতের গণতন্ত্রপন্থী নেতা হামিদ তালিবের বাংলাদেশ সফর নিয়ে। উত্তর আফ্রিকার আরব বসন্তের ছোঁয়া এসে লেগেছে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যেও, জনতার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আগামী বছর নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছেন কুয়েতের বর্তমান আমীর।

একই সাথে অন্যান্য পেট্রোডলারের দেশগুলোর আমীররাও কিছুটা নমনীয় হয়ে গণতন্ত্রায়নের পক্ষে নানান আশ্বাস দিতে শুরু করেছেন। এই আশ্বাস আদায়ের আন্দোলনের প্রধান ভূমিকা যাঁর, তিনিই হামিদ তালিব। আরব বসন্তের ফলশ্রুতিতে ২০১২তে জেগে ওঠা পেট্রো-বসন্তের অবিসংবাদিত নেতা বলা হয় তাঁকে। হামিদ তালিব তাঁর পনেরো সদস্যের দল নিয়ে আজ বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। পশ্চিমা মাধ্যমের ভ্রূ-কূঁচকানিকে খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন, "মুসলিম বিশ্বকে গণতন্ত্রের মশাল হাতে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে বাংলাদেশ"।

নব্বইয়ে এরশাদের পতনের পর গত দুই যুগ যে ধীরপদে হলেও গণতন্ত্রের পথে এগিয়েছে তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার এই দেশটি -- বাংলাদেশের সেই যাত্রাপথ থেকে কিছু শেখার জন্যই তালিবের এই ভ্রমন। মিটিমিটি হাসতে হাসতেই সেলিম হায়দার ঠিক করে ফেলেছেন কি দিয়ে শুরু করবেন তাঁর পরবর্তী "কটূকথা" কলামের প্রথম লাইন। অত বেশী ভাবতে অবশ্য হয়নি এই তুখোড় কলামিস্টকে, সামান্য চেষ্টাতেই পেয়ে গেছেন তার পাঞ্চলাইন, একদম সেটা দিয়েই শুরু করবেন এভাবে -- 'বর্বর আরবের ভীড়ে যৎসামান্য উন্নত মানসিকতার ব্যক্তিটি অন্তত স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে "মিসকিনে"র দেশ বাংলাদেশ থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে। ' কটূকথার শুরুটুকু এর চেয়ে খাসা আর কি হতে পারে? লেখা শুরু করার জন্য সোফা ছেড়ে প্রায় উঠেই পড়েছিলেন সেলিম হায়দার, কিন্তু শেষ মুহূর্তে স্ত্রী সেলিনাকে দুটো চায়ের কাপ হাতে বৈঠকখানায় আসতে দেখায় এ যাত্রা লেখা শুরুর অভিলাস খানিকটা দমাতে বাধ্য হন। চা-টা শেষ করা যাক।

এই সিদ্ধান্তে অবশ্য তাঁর শাপে বরই হলো বলতে হবে, কারণ তা নাহলে হয়তো খবরের বাকীটুকু আর দেখা হতোনা, কয়েকঘন্টা ধরে তৈরী করা পুরো লেখাটাই মাঠেমারা যেত। চা খেতে খেতে স্ত্রীকে আরবদের বর্বরতা নিয়ে ছোটোখাটো জ্ঞান দিচ্ছিলেন সেলিম। তখনই চ্যানেল আইয়ের খবর পাঠিকার কন্ঠের অতিমাত্রিক উদ্বেগ আর উত্তেজনার কারণে টিভিতে চোখ রাখতে বাধ্য হন। "সামথিং রং?" ভাবতে না ভাবতেই টেলপে বেশ বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা দেখতে পান, "ঢাকায় দুর্বৃত্তের আক্রমণে আরব নেতা হামিদ তালিব নিহত। " খবর পাঠিকাও বারবার উচ্চারণ করে যাচ্ছেন, "এইমাত্র পাওয়া খবরে জানা গেল কুয়েতের গণতন্ত্রবাদী নেতা হামিদ তালিব ঢাকার র‌্যাডিসন হোটেলে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন।

বিস্তারিত খবর আমাদের হাতে আসামাত্রই প্রচার করা হবে। " মুহূর্তের জন্য বিস্ময়ে হা হয়ে যান সেলিম হায়দার। খানিকটা বিমর্ষও বোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এই প্রফেসর। তবে সেটা ঠিক যতটা হামিদ তালিবের মৃত্যুর কারণে, তারচেয়ে অনেকগুন বেশী পাঞ্চলাইনটার কারণে। কত চমৎকার একটা বাক্য দিয়ে শুরু করবেন ভেবেছিলেন! অথচ এখন আর লেখাটিরই হয়তো কোনো মর্ম থাকবেনা।

সদ্যমৃত লোককে "বর্বরদের মাঝে সামান্য উন্নত" বলে উল্লেখ করা যায়না। হাজার হোক, পত্রিকার কলাম আর বৈঠকখানার আড্ডা এক না। ২. র‌্যাডিসন হোটেলের সামনে এয়ারপোর্ট রোড মোটামুটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু বিমানবন্দরগামী আর বিমানবন্দর থেকে আসা গাড়িগুলোর চলাচলের জন্য দু'পাশে একটি করে লেন খোলা। র‌্যাডিসন হোটেল কর্ডন করে ফেলেছে র‌্যাব আর সেনাবাহিনির নয়টি গ্রুপ।

তিনটি গ্রুপ হোটেলের তিনটি প্রবেশপথে, আর তাদেরকে কাভার দেয়া হয়েছে বাহিরে ছয়টি গ্রুপ দাঁড় করিয়ে। র‌্যাডিসন হোটেলও সিল করে দেয়া হয়েছে। কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে দেয়া হচ্ছেনা। দেশের প্রায় সবগুলো টিভি আর সংবাদপত্রের লোকেরা এসে জড়ো হয়েছে র‌্যাডিসনের সামনে এয়ারপোর্ট রোডের ওপর। আর শত শত আমজনতার ভীড়।

পুলিশ এর মধ্যেই কয়েক দফা ধাওয়া করে জনতাকে হটানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু যেদেশে হাজার হাজার মানুষ বলতে গেলে রাস্তায়ই জীবন কাটায় তাদের ঠেকাবে কিভাবে। রাস্তার একপাশ থেকে দৌড়ে তারা বড়জোর অন্যপাশে যায়। শুধু দেশী মিডিয়াই নয়, বিদেশী টিভিগুলোতেও কাভারেজ শুরু হয়ে গেছে। রাত সাড়ে দশটার দিকে চার্টার্ড প্লেনে মুম্বাই থেকে চলে এসেছে সিএনএন, বিবিসিসহ ডজন খানেকের মতো বিদেশী মিডিয়ার প্রতিনিধি। এমনকি রাত একটার দিকে আলজাজিরার করেসপন্ডেন্টও চলে এসেছেন খোদ দোহা থেকে।

বিশ্বজুড়ে টিভি চ্যানেলগুলোর আলোচনায় এখন ঢাকা। হামিদ তালিব বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত ব্যক্তিত্ব, উত্তর আফ্রিকায় জন্ম নেয়া আরব বসন্ত তাঁর হাত ধরে প্রসারিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে, নতুন নাম পেয়েছে "পেট্রো-বসন্ত"। আগামী বছর কুয়েতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে যে তিনি জিতে আসছেন, এটা প্রায় সবারই মুখে মুখে। তাঁর উন্মেষের সাথে সাথে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে নতুন নেতৃত্বের জন্ম হবে, এটাও কোনো উচ্চাভিলাষ ছিলোনা। তাঁর দিকে তাকিয়ে সমগ্র বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পুরো বিশ্ব অস্থিরতার হাত থেকে বেঁচে যাবে, এমনটাই ছিলো তাঁকে নিয়ে মোটাদাগে সবার প্রত্যাশা।

সেই ব্যক্তির এমন মৃত্যু বিস্ময়কর। একইসাথে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে এ ধরনের বিশ্বমানের ব্যক্তিত্বের নিরাপত্তার পর্যাপ্ততা, কারা খুনটি করেছে, বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদ প্রায় নির্মূল বলা হচ্ছিলো অথচ তারপরও এমন ঘটনা কিভাবে ঘটলো -- এরকম নানাবিধ আলোচনায় মুখর বিশ্বের সবক'টি গণমাধ্যম। (চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.