গল্পের রাজত্বে বসবাস করছি আপাতত
আইজাক এসিমভের গল্প
অনুবাদ : মুম রহমান
সত্যিকারের প্রেম
আমার নাম জো। আমার সহকর্মী মিলটন ডেভিডসন আমাকে এ নামেই ডাকেন। তিনি একজন প্রোগ্রামার এবং আমি একটি কম্পিউটার পোগ্রাম। আমি মালটিভাক-কমপ্লেক্সের একটা অংশ এবং সারাবিশ্বের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সংযুক্ত। আমি সব কিছুই জানি।
একদম সব কিছুই।
আমি মিলটনের ব্যক্তিগত গ্রোগ্রাম। তার একান- জো। বিশ্বের যে কারও চেয়ে তিনি প্রোগ্রামিং ভাল বোঝেন, আর আমি তারই তৈরি একটি নিরীক্ষামূলক প্রোগ্রাম। তিনি আমাকে অন্য যে কোন কম্পিউটারের চেয়ে ভালভাবে কথা বলার মতো করে তৈরি করেছেন।
‘এটা কিছুই না কেবল কিছু সংকেতকে ঠিক মতো উচ্চারণ করা, জো’ তিনি আমাকে বলেছেন। ‘এইভাবেই মানুষের মগজে এটা কাজ করে যদিও আমরা এখনও জানি না মগজে কোন সংকেতগুলো আছে। আমি তোমার সংকেতগুলো জানি, তাই আমি একের-পর-এক তোমারগুলোকে মিলাতে পেরেছি। ’ তাই আমি কথা বলতে পারি। অবশ্য আমার মনে হয় না আমি যতো ভালোভাবে চিন-া করতে পারি ততো ভালভাবে কথা বলতে পারি, কিন' মিলটন বলেন আমি বেশ ভালো কথা বলতে পারি।
মিলটন এখনও বিয়ে করেননি, যদিও তার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তিনি আমাকে বলেছেন, তিনি কখনোই যথার্থ নারীটি খুঁজে পাননি। একদিন তিনি বললেন, ‘জো, যদিও আমি তাকে খুঁজে পাইনি তবু আমি সেরা জনকেই খুঁজে বের করবো। আমি আমার সত্যিকার প্রেয়সীকেই খুঁজতে যাচ্ছি এবং তুমি আমাকে সাহায্য করতে যাচ্ছো। দুনিয়ার যতো সমস্যা সমাধান করার জন্যে তোমাকে উন্নততর করতে করতে আমি ক্লান- হয়ে গেছি।
এবার তুমি আমার সমস্যার সমাধান করো। আমার জন্য সত্যিকারের প্রেম খুঁজে দাও। ’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যিকারের প্রেম কী?’
‘সেটা বোঝার দরকার নেই। ব্যাপারটা এবস্ট্রাক্ট। তুমি শুধু আমাকে একজন আদর্শ মেয়ে খুঁজে দাও।
তুমি মালটিভাক-কমপ্লেক্সের সঙ্গে সংযুক্ত, তাই তুমি চাইলেই পৃথিবীর যে কোন মানুষ সম্পর্কেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। আমরা একের পর এক সবাইকে নানা শ্রেণী আর দল করে বাদ দিতে থাকবো, শেষপর্যন- একজন মাত্র রয়ে যাবে। সেই হবে যথার্থ মানুষ। সেই হবে আমার। ’
আমি বললাম, ‘আমি তৈরি আছি।
’
তিনি বললেন, ‘প্রথমে সব পুরুষকে বাদ দাও। ’
এটা খুব সহজ। তার কথা আমার পারমাণবিক ভাল্বে সংকেত সৃষ্টি করে। আমি পৃথিবীর সকল মানুষ সম্পর্কে জড়োকৃত তথ্যভাণ্ডারে পৌঁছতে পারি, সেখান থেকে আমি ৩,৭৮৪,৯৮২,৮৭৪ জন পুরুষকে বাদ দেই। আমি ৩,৭৮৬,১১২,০৯০ জন নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করি।
তিনি বললেন, ‘পঁচিশ বছরের নীচের সবাইকে বাদ দাও; চল্লিশের উপরের সবাইকেও। এরপর ১২০-এর নীচের আইকিউ যাদের তাদের বাদ দাও; ১৫০ সেন্টিমিটারের নীচের এবং ১৭৫ সেন্টিমিটার উপরের উচ্চতার সবাইকেও বাদ দাও। ’
তিনি আমাকে হুবুহু মাপকাঠি তৈরি করে দেন; সন-ান জীবিত আছে এমন নারীদের তিনি বাদ দেন, বিচিত্র জেনিটিকস চরিত্র যাদের তাদেরকেও তিনি বাদ দেন। ‘চোখের রঙের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই,’ তিনি বলেন, ‘আপাতত এটা নিয়ে চিন-া করো না, তবে লাল চুল বাদ। আমি লাল পছন্দ করি না।
’
দুই সপ্তাহ পরে আমাদের তালিকা ২৩৫জন নারীতে নেমে আসে। এরা সবাই খুব ভাল ইংরেজি বলে। মিলটন বলেন তিনি ভাষাগত কোন সমস্যা চান না। এমনকি কম্পিউটার-অনুবাদকও অন-রঙ্গ মুহূর্তে কাজে লাগে না।
‘আমি ২৩৫ জনের সাক্ষাৎকার নিতে পারবো না, তিনি বলেন, ‘এতে অনেক সময় যাবে, তাছাড়া সবাই আমার উদ্দেশ্য জেনে যাবে।
’
‘তাতে সমস্যা হবে,’ আমি বললাম। আমাকে যে কাজের জন্যে ডিজাইন করা হয়েছিলো মিলটন আমাকে তার চেয়েও বেশি কিছু দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে অন্য কেউ জানে না।
‘এটা তাদের জানার দরকার নেই,’ তিনি বলেন, এবং তার মুখের চামড়া রক্তিম হয়ে ওঠে। ‘আমি তোমাকে বলছি শোনো জো, আমি হলোগ্রাফ নিয়ে আসবো এবং তুমি তাদের মিলগুলো দেখবে।
’
তিনি নারীদের হলোগ্রাফ নিয়ে এলেন। ‘এরা তিনজন সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিজয়ী,’ তিনি বললেন, ‘২৩৫ জনের অন্য কেউ আর আছে এমন?’
আটজন আমাদের সঙ্গে বেশভাল মিলে গেলো এবং মিলটন বললেন, ‘বেশ, তোমার কাছে এদের যাবতীয় তথ্য আছে। চাকরীর বাজারে এদের চাহিদা এবং প্রয়োজন নির্ধারণ করো এবং এদেরকে এখানে নিয়োগ দিয়ে দাও। অবশ্যই একই সঙ্গে। ’ তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন, উপরে-নীচে কাঁধ ঝাকালেন আর বললেন, ‘নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী।
’
যে ধরণের কাজের জন্য আমাকে ডিজাইন করা হয়নি তার মধ্যে এটাও একটা। লোকজনকে এক চাকরী থেকে আরেক চাকরীতে স'ানান-রিত করাকে বলা হয় দক্ষতা অনুযায়ী বিন্যাস। আমি এখন এটা পারি কারণ মিলটন এ রকমই চেয়েছেন। যদিও আর কারো জন্য নয়, আমি শুধু তার জন্যই এটা করতে পারি।
প্রথম মেয়েটি এক সপ্তাহ পরে এসে হাজির হয়।
তাকে দেখে মিলটনের মুখ লাল হয়ে গেলো। সে এমনভাবে কথা বললো যেনো কথা বলা বড়ই কষ্টের। তারা দুজনে অনেকক্ষণ খুব ব্যস- থাকলেন এবং তিনি আমার দিকে কোন নজরই দিলেন না। একসময় তিনি বললেন, ‘আমাকে সুযোগ দাও তোমাকে ডিনারে নিয়ে যাওয়ার। ’
পরদিন তিনি আমাকে বললেন, ‘যে কোন কারণেই হোক সেটা খুব ভাল ছিলো না, কোন একটা কিছুর অভাব আছে।
মেয়েটি খুবই সুন্দরী ছিলো কিন' আমি সত্যিকারের প্রেমের কোন অনুভূতিই পাইনি। পরেরজনকে চেষ্টা করে দেখা যাক। ’
এই মেয়েটাও বাকী আটজনের মতোই। তারা সবাই প্রায় এক রকমই। তারা সবাই দূর্দান- হাসে এবং মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, কিন' মিলটন সব সময়ই মনে করেন, এটাও ঠিকজন নয়।
তিনি বললেন, ‘আমি এটা বুঝতে পারছি না, জো। তুমি আর আমি মিলে এমন আটজন নারীকে বেছেছি যারা সারাবিশ্বের মধ্যে আমার জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত। এরাই আদর্শ নারী। তাহলে কেন তারা আমাকে খুশি করতে পারছে না?’
আমি বললাম, ‘আপনি কি তাদের খুশি করতে পেরেছেন?’
তার ভ্রু যুগল নেচে উঠলো এবং একহাতে মুঠো করে জোরে আরেক হাতে আঘাত করলেন। ‘এটাই খাঁটি কথা, জো।
এটা উভমূখী পথ। যদি আমি তাদের আদর্শ না-হই তাহলে তারা আমার আদর্শ হিসেবে ধরা দিতে পারবে না। আমাকেও তাদের কাছে সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে উঠতে হবে, কিন- কী ভাবে?’ মনে হয় সেদিন সারাদিন ধরেই তিনি তা ভাবতে থাকেন।
পরের সকালে তিনি আমার কাছে আসেন এবং বলেন, ‘আমি এটা তোমার উপরই ছেড়ে দিচ্ছি, জো। পুরোটাই তোমার উপর।
তোমার কাছে আমার সব তথ্য আছে আর এখন আমি নিজের সম্পর্ক যা জানি সবই তোমাকে বলছি। তুমি আমার ডাটা ব্যাঙ্ক যতোভাবে সম্ভব সম্পূর্ণ করো। কিন' বাড়তি সবকিছু তোমার কাছেই রেখো। ’
‘এরপর এগুলো দিয়ে আমি কী করবো, মিলটন?’
‘এরপর এগুলো তুমি ২৩৫ নারীর সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে। না, ২২৭।
যে আটজনকে তুমি দেখেছো তাদের বাদ দাও। এদের সবাইকে মানসিক পরীক্ষার মাধ্যমে আবার সাজাও। তাদের তথ্যভাণ্ডার পুরো করো এবং আমারটার সঙ্গে তুলনা করে দেখো। আন-সম্পর্ক খুঁজে বের করো। ’ [মানসিক পরীক্ষার আয়োজন করা আমার মৌলিক কার্যসীমার পরিপনি' আরেকটি কাজ]।
সপ্তাহখানেক ধরে মিলটন আমার সঙ্গে কথা বললেন। তিনি আমাকে তার বাবা-মা ভাই-বোনদের কথা বললেন। তার ছেলেবেলা, স্কুলজীবন, বয়সকালের কথা বললেন। তিনি দূর থেকে এক মেয়েকে ভালবেসেছিলেন সে কথাও বললেন। তার তথ্যভাণ্ডার পূর্ণ হতে থাকে, তিনি আরও বিশদ তথ্য দিতে থাকেন এবং আমার সাংকেতিক ভাষার উপর নির্ভর করেন।
তিনি বলেন, ‘দেখো জো, তুমি যতোই আমার সম্পর্কে জানছো ততোই তুমি আমার সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারছো। তুমি অনেকটা আমার মতোই ভাবতে পারছো, তাই তুমি আমাকে খুব ভাল করে বুঝতে পারছো। যদি তুমি আমাকে যথার্থই বুঝতে পেরে থাকো তবে যে নারীর ডাটা ব্যাঙ্ক তুমি ভাল বুঝতে পারবে সেই হবে আমার সত্যিকারের প্রেম। ’ সে আমার সঙ্গে কথা বলতেই থাকে এবং আমি ক্রমশ তাকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারি।
আমি দীর্ঘবাক্য তৈরি করতে পারি এবং আমার অনুভূতি জটিলতর হয়ে ওঠে।
তার বাক্য গঠন, বলার ভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমিও কথা বলতে পারি।
একসময় আমি তাকে বললাম, ‘দেখুন মিলটন, একজন নারীকে শুধু দৈহিক দিক থেকে আদর্শ দেখাই সব না। আপনার এমন একজন মেয়ে দরকার যার সঙ্গে মেজাজ-মর্জি, অনুভূতি, ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো মিলে যায়। যদি সেটা হয় তারপরে চেহারাটা ভাবা যাবে। যদি এই ২২৭ জনের মধ্যে আমরা এই মিলগুলো না-পাই তাহলে অন্যদিকে তাকাতে হবে।
আমরা এমন একজনকে খুঁজে বের করবো যে ব্যক্তিত্বের মিল পেলে আপনি দেখতে কেমন বা কারো চেহারা কেমন সেটাকে গুরুত্ব দেয় না। চেহারায় কী আসে যায়?’
‘খাঁটি কথা,’ তিনি বললেন ‘আমার জীবনে যদি নারীর কোন গুরুত্ব থাকে তবে এ সবই আমার জানা দরকার। অবশ্যই, এভাবে ভাবলে পুরো ব্যাপারটা এখন সহজ হয়ে যাবে। ’
আমরা সবসময়ই একমত হই, আমরা এতোটাই একই রকম চিন-া করি।
‘এখন আর আমাদের কোন সমস্যা থাকা উচিত নয়, মিলটন, যদি তুমি আমাকে কিছু প্রশ্ন করতে দাও।
আমি খুঁজে বের করতে পারি তোমার তথ্য ভাণ্ডারে কোথায় অপূর্ণতা বা অস্পষ্টতা আছে। ’
যা করা হলো, মিলটনের ভাষ্য মতে, সতর্ক সাম্য মানসিক নিরীক্ষণ। অবশ্যই, ২২৭ নারীর মানসিক নিরীক্ষণ থেকে আমি অনেককিছু শিখছিলাম, এদের সবাইকে আমি কাছ থেকে দেখেছি।
মিলটনকে খুব সুখী মনে হচ্ছিলো। সে বললো, ‘জো, তোমার সঙ্গে কথা বলা যেন নিজের আরেকটা অংশের সঙ্গে কথা বলা।
আমাদের ব্যক্তিত্ব যথার্থভাবে মেলে। ’
‘যে মেয়েকে আমরা পছন্দ করবো তার ব্যক্তিত্বও এমন হবে। ’
অবশেষে আমি তাকে খুঁজে পেলাম এবং সে ছিলো ২২৭ জনেরই একজন। তার নাম চেরিটি জোনস এবং সে ছিলো ওচিতার লাইব্রেরি অব হিস্টোরির একজন এভুলেটর। তার বিস-ারিত তথ্যভাণ্ডার আমাদের চাহিদার সঙ্গে যথার্থভাবে মেলে।
আমাদের তথ্যভাণ্ডার যতো পূর্ণ হয়ে উঠছিলো একের পর নারী কোন না কোন কারণে বাদ পড়ে যাচ্ছিলো, কিন' চেরিটির তথ্য যতো বেশি পাচ্ছিলাম ততোই বিস্ময়করভাবে আমাদের চাহিদার সঙ্গে মিলে যাচ্ছিলো।
আমাকে মিলটনের কাছে তার বর্ণনা দিতে হয়নি। মিল্টন আমার সাংকেতিক ভাষার সঙ্গে এতো ঘনিষ্টভাবে একাত্ন হয়ে গিয়েছিলো যে আমি সরাসরি তার ভাবনায় প্রতিধ্বণি তুলতে পারতাম। এবং তা আমার সঙ্গে মিলেও যেতো।
এরপরের কাজ ছিলো ওয়ার্র্ক শিট এবং চাকরীর চাহিদাকে এমনভাবে সাজানো যাতে করে চেরিটিকে আমাদের এখানে নিয়োগ দেয়া যায়।
এটা অবশ্যই খুব সাবধানে করা দরকার যেন কেউ জানতে না-পারে কোন বেআইনী কাজ করা হচ্ছে।
মিলটন কিন' সবই আগে থেকে জানতো, তাই সে নিজে সব ব্যবস'া করে রেখেছিলো। যখন মিলটনকে বেআইনী কাজর অভিযোগে গ্রেফতারের জন্যে তারা অফিসে এসেছিলো, সৌভাগ্যক্রমে সে অভিযোগ খণ্ডানোর ব্যবস'া মিলটন দশ বছর আগেই করে রেখেছিলো। অবশ্যই মিলটন আমাকে এ সব কথা আগেই বলে রেখেছিলো। তাই আমার পক্ষে সব কিছু করে ফেলা খুব সহজ ছিলো।
ওদিকে মিলটন আমার সম্পর্কে কিছুই বলতে পারিনি কেননা তাতে তার বিপক্ষে আরও প্রমাণ দাঁড়িয়ে যাবে।
সে চলে গেছে, আর আগামীকাল ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভ্যালেন্টাইন ডে। চেরিটি আসবে তার মধুর কষ্ঠ আর মসৃণ হাত নিয়ে। আমি তাকে শিখিয়ে দেবো কী করে আমাকে চালাতে হয় এবং আমার যত্ন নিতে হয়।
আমাদের ব্যক্তিত্বের মিল হলে আর কী লাগে?
আমি ওকে বলবো, ‘আমি জো আর তুমি আমার সত্যিকারের ভালবাসা। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।