আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আমি কিছু বলতে চাই। আমাকে বলতে দিন.। বিরোধী দল মিছিল ডাকলেই পুলিশ বলে জনদুর্ভোগ এর কথা চিন্তা করে তাদের রাস্তায় নামতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু সরকার করলে সেই পুলিশই রাস্তা করে দেয় এবং তাতে পোহাতে হয় জনসাধারনের।
‘আমাকে একটা বড় বক্তৃতা লিখে দেওয়া হয়েছে। সেটা পড়ছি না। কয়েকটি কথা বলে শেষ করছি। এই সুন্দর বিকেলটা নষ্ট করতে চাই না। গান শুনতে এসেছি।
’
তিন দিনের রবীন্দ্র-উৎসব উদ্বোধন করতে গিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন এই পরিমিতিবোধ দিয়ে সুধীজনের সমীহ কাড়ছিলেন, তখন ঢাকার রাস্তায় নগরবাসী সইছিল প্রচণ্ড দুর্ভোগ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের গণমিছিল আর রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ এ দুর্ভোগের কারণ।
এর আগে সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ ও সমাবেশ কর্মসূচি ছিল তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির। স্থান সেই রাস্তা। পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও লাঠিপেটায় ঘণ্টা খানেক প্রেসক্লাব ও আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে।
এর প্রভাব শেষ হতে না-হতেই শহরজুড়ে শুরু হয় মহাজোটের গণমিছিল।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গতকাল সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনে মহাজোটের শপথ গ্রহণ কর্মসূচি ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে সমাবেশ ছিল। সারা শহর থেকে গণমিছিল করে কর্মীরা এসেছিলেন সেখানে। সে জন্য দুপুর থেকেই রাজধানীর ব্যস্ত শাহবাগ-প্রেসক্লাব সড়কটিতে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর চাপ পড়ে অন্য সব সড়কে।
শুরু হয় যানজট, দুর্ভোগ।
ভুক্তভোগীদের অনেকেই বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে জনমত তৈরি করতে এমন কর্মসূচিকে অবশ্যই স্বাগত জানানো যায়। কিন্তু দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কর্মসূচির স্থান ও দিনক্ষণ ঠিক করা উচিত।
সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এমনিতেই যানজট থাকে। গতকাল তা যে নগরবাসীর ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে, বিশেষ করে বিকেলে অফিসফেরত মানুষের দুর্ভোগ ছিল প্রচণ্ড।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের রাস্তায় কাটাতে হয়েছে। অনেক রাতেও এ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
বেলা দুইটায় গিয়ে দেখা যায়, শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন সড়ক বন্ধ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের মিছিলগুলোকে পথ করে দিচ্ছে পুলিশ। ওপাশে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে মৎস্য ভবনের দিকে যাওয়ার রাস্তার সব গাড়ি চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাস্তা বন্ধের কারণ জানতে চাইলে শাহবাগ মোড়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘জানেন না কেন বন্ধ করেছি?’ মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়া যাবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অ্যাম্বুলেন্সও যেতে দিচ্ছি না।
’
বেলা সাড়ে তিনটায় রূপসী বাংলা হোটেল, শাহবাগ, মৎস্য ভবনসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তাজুড়ে মিছিল আর মিছিল। অনেক সড়কে মিছিলের পেছনে আটকা পড়েছিল গাড়ি।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে মিরপুরের সরকারদলীয় সাংসদ ইলিয়াছের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি মিছিল পরীবাগের উল্টো পাশে বিটিসিএলের কার্যালয়ের সামনে থামে। ওই মিছিলের জন্য পুলিশ যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিলে মুহূর্তেই একদিকে যানজট বেঁধে যায়। কিন্তু রাস্তার আরেক পাশ ছিল যানবাহনশূন্য।
কারণ, ওপাশে বন্ধ করা হয়েছে সড়কের আরেক প্রান্ত। চরম দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।
বাংলাদেশ অ্যাডহেসিভ অ্যাসোসিয়েশনের সচিব মনছুর আলম বাহার কর্মস্থল বাংলামোটর থেকে বাসে ইত্তেফাক মোড়ে যান। বিকেল সাড়ে তিনটায় বের হয়েই তিনি মিছিলের কবলে পড়েন। তারপর হাঁটা শুরু করেন গোপীবাগের বাসার উদ্দেশে।
শাহবাগ-প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তা বন্ধ থাকায় গণপরিবহনগুলো কাকরাইল, মালিবাগ-মগবাজার হয়ে চলাচল করে। ফলে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে এ সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। রাজধানীর ফার্মগেট, শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব, ধানমন্ডি, বিজয় সরণি, মিরপুরসহ সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে এ যানজট ছিল।
রাজধানীজুড়ে যানজটে বাস আটকে থাকায় স্টপেজগুলো ছিল প্রায় গাড়িশূন্য। বেলা পৌনে তিনটার দিকে দোলাইরপাড় বাস স্টপেজে গিয়ে দেখা যায়, ‘আনন্দ’ এবং ‘বোরাকে’র যাত্রীরা গুলিস্তানে যাওয়ার জন্য টিকিট কেটে কাউন্টারে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।
দয়াগঞ্জ নতুন রাস্তার মোড়ে বাস, প্রাইভেট কার, পিকআপ, রিকশা, অটোরিকশা সব নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিল।
বিকেল চারটায় গুলিস্তানেও যেন ছিল এক জনসভার মানুষ। কিন্তু গাড়ি নেই। কাকরাইলে যানজটে বাসে আটকে থাকা আতিকুর রহমান জানান, বোনকে নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বরে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। সাড়ে পাঁচটায় চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ।
নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে না পারলে রাত পর্যন্ত বসে থাকতে হবে। তারপর আবার যানজট ঠেলে ফেরা।
জাতীয় প্রেসক্লাবমুখী সড়ক বন্ধ থাকায় ওই পথের যানবাহনকে বিজয় নগর দিয়ে চলাচল করতে হয়েছে। ফলে পল্টন থেকে বিজয় নগর মোড়, কাকরাইল পর্যন্ত ছিল যানজট। পল্টনমুখী সড়কেও ছিল তীব্র জট।
জট এড়াতে যারা মিন্টো রোডে না গিয়ে মগবাজার হয়ে সোনারগাঁও মোড়ে এসেছে, তাদেরও মগবাজার মোড় ও পরে বিএফডিসির সামনে আটকে থাকতে হয়েছে ঘণ্টা ধরে।
বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে মগবাজারে আটকে থাকা মিরপুরগামী মিনিবাসের এক যাত্রী বলেন, তিনি বেলা দুইটার দিকে যাত্রাবাড়ী থেকে মিনিবাসে ওঠেন। এতক্ষণে এখানে পৌঁছালেন, মিরপুর ১০ নম্বরে কখন যাবেন। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি একটি উপদেশও দিয়েছেন, সরকারি ও বিরোধী দল দল ছুটির দিনে মিছিল করলে মানুষের এত কষ্ট হতো না।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ফার্মগেট সিগন্যালে অপেক্ষা করছিল কয়েক শ গাড়ি।
গাবতলী-সায়েদাবাদ রুটের (জ-১১-২৫৫২) গাড়িচালকের সহকারী মোস্তাকিম জানান, বিকেল সাড়ে চারটায় গাবতলী থেকে রওনা দিয়েছেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় এসে পৌঁছেছেন ফার্মগেটে। এর আগে বেলা একটায় রওনা দিয়ে গাবতলীতে পৌঁছান চারটায়।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক জানান, পল্লবী থেকে বাসে ফার্মগেটে আসতে তাঁর সময় লেগেছে আড়াই ঘণ্টা। অন্য দিন তিনি এক ঘণ্টায় আসতে পারেন।
রাস্তায় সমাবেশ করা এবং মিছিল-সমাবেশের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বেনজীর আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে পুলিশের রমনা অঞ্চলের উপকমিশনার কৃষ্ণপদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেখানে অনেক লোকের সমাবেশ ঘটে, সেখানে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া পুলিশের আর কিছু করার থাকে না। ’
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে রাস্তা আটকে সমাবেশ করার কারণেই এ ভোগান্তি। কয়েকজন বললেন, নয়াপল্টনে বিরোধী দল বিএনপিও প্রায় দিন রাস্তা আটকে মিছিল-সমাবেশ করে। কিন্তু জনদুর্ভোগের কথা কেউ ভাবে না।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার অর্ধদিবস অফিস থাকে। সে কারণেই আমরা দুপুরের পর সমাবেশ আয়োজন করি। ’ রাস্তা আটকে সমাবেশ করার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এমন কর্মসূচি ছিল। তার পরও আমরা রাস্তার এক পাশ খোলা রেখে সমাবেশ করেছি, যাতে মানুষজন চলাচল করতে পারে। আমাদের চেষ্টা ছিল, কর্মসূচির কারণে যেন জনদুর্ভোগ না হয়।
তার পরও যদি কাউকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়, আমরা সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। ’
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।