বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সংকটে ফেলার জন্য ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি বড় উপাদান হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাত-আট বছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে চিন্তা মোটেই করতে হয়নি। বরং একসময় মনে হতো, প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের কয়েক বিলিয়ন ডলার বেশি আছে। ফরেন এঙ্চেঞ্জ বা বৈদেশিক মুদ্রা আসে বিদেশে পণ্য ও সেবা বিক্রি থেকে। আর আসে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক সাহায্য এবং অনুদান থেকে।
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত বিদেশে পণ্য ও সেবা ভালোই বিক্রি করে আসছিল। কিন্তু গত ছয় মাস থেকে উল্টো চিত্র ভেসে উঠতে শুরু করেছে। ২০০৯-১০-এ যেখানে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ ৪১ শতাংশ বেড়েছিল, সেই প্রবৃদ্ধি এবার অর্ধেকে নেমে এসেছে। একসময় মানবসম্পদ রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্য রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩৫ শতাংশ। আজ সেই প্রবৃদ্ধিও অর্ধেকে নেমে এসেছে।
যে ১১ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স থেকে পাচ্ছিল সেই অঙ্ক বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই অনেক বিশাল ছিল। আমাদের পণ্যের রপ্তানি ও আমদানি বাবদ চলতি হিসাবে ঘাটতি সব সময়ই ছিল। কিন্তু সেই ঘাটতি পূরণ করে দিত বর্ধিত রেমিট্যান্স প্রবাহ।
সবচেয়ে বড় লক্ষণীয় বিষয় হলো, রেমিট্যান্সে ভ্যালু অ্যাডিশন অনেক বেশি। রপ্তানি আয়ে ভ্যালু অ্যাডিশন ২০-২৫ শতাংশের বেশি হবে না।
কিন্তু রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে ভ্যালু অ্যাডিশন ৮০ শতাংশের ওপর। তাই রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ঘুরে দাঁড়ালেও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি যদি ঋণাত্মক হয় তাহলে সে ফাঁক পূরণ করতে বাংলাদেশকে অনেক বেগ পেতে হবে। বাংলাদেশের জন্য রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে অনেক নতুন বাজার খুলেছে। এর মধ্যে চীন, রাশিয়া ও ভারত অন্যতম। কিন্তু বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে বাজার থাকলেও রপ্তানির সুযোগগুলো পুরো কাজে লাগাতে পারবে না।
বিদ্যুৎ খাতে উন্নতি হলেও অন্যান্য খাতে অবস্থার অবনতি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ তাড়াতাড়ি বেশি বিদ্যুৎ পেতে গিয়ে অনেক ব্যয়বহুল পথে বিদ্যুৎ কিনছে। আমাদের বিদ্যুৎ সংকটের সুযোগ নিয়ে এ দেশীয় কিছু ব্যবসায়ী ও বিদেশি একত্র হয়ে প্রায় ব্ল্যাকমেইল মূল্যে বাংলাদেশের কাছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ওচচগুলো থেকে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে। সেই মূল্য আবার বিদ্যুতের আদি একক ক্রেতা চউই ক্রমে ক্রমে গ্রাহকদের ওপর তুলে দিচ্ছে। গ্রাহকরা পড়েছে বড় বিপদে।
অপশনের কোনো উপায় নেই। হয় বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ কেনো, না হলে অন্ধকারে থাক। শিল্প উদ্যোক্তারা পড়েছে আরো বড় বিপদে।
একদিকে বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য মাত্র তিন বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, অন্যদিকে কম মূল্যে পণ্য উৎপাদন করতে না পারলে বিদেশে প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে। সম্প্রতি যোগ হয়েছে ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার।
এসবের ঊর্ধ্বমূল্য শুধু মূল্যস্ফীতিকে আরো স্ফীত করছে। অনেক খুচরো গ্রাহক জিজ্ঞেস করে, বিদ্যুৎ-গ্যাসের জন্য তাদের আরো কত বর্ধিত মূল্য দিতে হবে? আমি বলি, কত বলা যাবে না, তবে বেশি মূল্য দিতে হবে। সম্প্রতি যে আমাদের ফরেন এঙ্চেঞ্জ রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে এর মূলেও আছে ব্যক্তিখাতের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর জন্য সরকার কর্তৃক উচ্চমূল্যে জ্বালানি আমদানি। হঠাৎ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তেল ও তেলজাত পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। সেই বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেওয়ার মতো আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল কখনোই যথেষ্ট ছিল না।
কিন্তু আজ সরকার স্বইচ্ছায় এক ধরনের বন্দিত্ব অবস্থা গ্রহণ করে নিয়েছে। ব্যক্তিখাতের ওচচগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে পূর্বনির্ধারিত মূল্যে। এমনকি না কিনলেও তাদের কিছু অর্থ দিতে হবে। অন্যদিকে জ্বালানিও দিতে হবে সরকারকে। বিদ্যুৎ যারা বিক্রি করছে তাদের মধ্যে যারা বিদেশি মালিক আছে, তারা লাভকে বিদেশি মুদ্রায় আবার দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।
বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে কত বিলিয়ন ডলার জমা থাকবে_তা নির্ভর করে চাহিদা-সরবরাহের ওপর।
বিদেশি মুদ্রার চাহিদা হু হু করে বাড়ছে, অথচ এর জোগানের প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। এ অবস্থায় আগামী তিন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এঙ্চেঞ্জ রিজার্ভ যদি আরো কমে যায়, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। অন্য কথায় যাওয়ার আগে আরো দুটো কথা বলতে চাই। বাংলাদেশ আপাতত বড় রকমের কোনো বৈদেশিক সাহায্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগ পাচ্ছে না, যা থেকে ডিপ্লেটেড (উবঢ়ষধঃবফ) বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলকে পূরণ করতে পারবে।
কেন পাচ্ছে না? আমার মতে, সেটা অর্থনীতির চেয়েও রাজনৈতিক ইস্যুর সঙ্গে বেশি যুক্ত। কেন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ হলো? শুধু কি দুর্নীতির কারণে? এখানে অন্য অনেক উপাদান আছে। দেশের রাজনীতিতে একটা অস্থিরতা চলছে। সরকার ও বিরোধী দলগুলো সাংঘর্ষিক অবস্থানে চলে গেছে। এমনকি আগামী নির্বাচন নিয়েও একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
অনিশ্চয়তার অর্থনীতিতে কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না। তাই দেশের ধনিক-শিল্পপতি এবং বণিক শ্রেণীরাও বড় বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। তাহলে তাদের জমাকৃত এবং যারা বিভিন্ন সুবিধা ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের অর্থকড়ি কোথায় যাচ্ছে? এদের অর্থকড়ি কথিত কালো টাকা হয়ে একটা বড় অংশ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে বলেই আমার মনে হয়। বাংলাদেশ ফরেন এঙ্চেঞ্জের কার্ব মার্কেটে ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য ধনিক শ্রেণীদের ক্যাপিটাল ফ্লাইটও দায়ী।
অন্যদিকে ওভার-ইনভয়েসিং এবং আন্ডার-ইনভয়েসিংও বেড়ে যেতে পারে।
কারণ বাংলাদেশে কেউ ট্যাঙ্ দিয়ে ব্যবসা করতে চায় না। আবার এই দেশকে কম নিরাপদ মনে করে তারা আয় করে টাকায় আর বাইরে রেখে দেয় বা নিয়ে যায় ডলারে। বিশ্বে মার্কিন ডলার এখন অত আকাঙ্ক্ষার মুদ্রা নয়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুদ্রা অনবরত ডলারের বিপরীতে মূল্য হারাচ্ছে। এর মূল কারণ যতটা না টাকার মূল্য হারানো, তার থেকে বেশি বড় কারণ হলো বিভিন্ন কারণে ডলারের চাহিদার উল্লম্ফন।
বর্তমানে ফরেন এঙ্চেঞ্জ রিজার্ভ নিয়ে এত শঙ্কা কেন? শঙ্কার কারণ হলো, বর্তমানের হ্রাসমান রিজার্ভের কারণে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আমদানি করতে পারবে না। আমদানি কমলে সরবরাহ কমবে এবং মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপও হবে এক ধরনের ক্যাপিটাল কন্ট্রোল। সেটা আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক মহল মেনে নেবে না। তবে বাংলাদেশ ডঞঙ-এর অধীনে দেয় সুবিধা ব্যবহার করে যতটা করতে পারে, সেটা অবশ্যই করতে পারবে।
বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার আরো কমে গেলে বাংলাদেশের ডলার-ইউরোতে পেমেন্ট ক্ষমতা আরো হ্রাস পাবে। এ অবস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ আরো নিরুৎসাহিত হবে। বাংলাদেশের সংকট বাংলাদেশকেই মোকাবিলা করতে হবে। সরকারি ব্যয় অবশ্যই কমাতে হবে এবং দেশে বিরাজিত রাজনৈতিক সংকটেরও সমাধান করতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।